আমার 'কলম' আজো আছে আমার সাথে, আমার কষ্টের সঙ্গী হয়ে,আমার সুখের ভাগ নিয়ে দেনা-পাওনা চুকিয়ে,এক চিলতে হাসি হয়ে...
প্রচন্ড রকমের অনিচ্ছা নিয়েই ব্যাগ গোছাতে লাগল তনু। কোন মানে নাই এসবের...সে যতোই রাগ করুক,আর যতোই ঝগড়া করুক,তার এসব কাজকর্ম নিয়ে নুমানের কোন মাথা ব্যাথা নেই। যদি থাকতো তাহলে গত তিনদিন যাবত যে তনু এতো রাগ,চিৎকার করছে তা দেখা সত্ত্বেও নুমান গাড়ির টিকেট কেটে ওর সামনে এনে রাখতো না।
টিকেট দেখার পর তনু আর কোন কথা বলল না,কিছুক্ষন টিকেটের দিকে তাকিয়ে থেকে কাবার্ড থেকে ল্যাগেজ বের করে জিনিস পত্র গোছাতে লাগল।
নুমান সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নীরবে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় যেয়ে বসল।
এ রকম ঝগড়া তনু আর নুমানের মধ্যে নতুন কিছু না। প্রতি বছর ঈদ আসলে বাড়ি যাওয়া নিয়ে দু'জনের মধ্যে ছোট-খাটো ঝড় উঠবেই। তনু চাইবে ওর বাবার বাড়ি ময়মনসিংহ ঈদ করতে যেতে আর নুমান কুমিল্লা তার বাবার বাড়ি। হাজার দফা যুক্তি-তর্কের পর ব্যাগ ব্যাগেজ গুছিয়ে তনু চলে যায় তার শ্বশুড় বাড়ি,দু'দিন পর ফিরে এসে যখন বাবার বাড়ি যায় তখন ওদিক ওর সব কাজিনরা ছুটি শেষ করে যার যার বাড়ি ফিরে আসতে শুরু করে। মন খারাপ আর আফসোস নিয়ে তনু ফিরে ঢাকায়।
এবার অবশ্য তনু রোজার ঈদের পর থেকেই নুমানকে বলছিল,কোরবানী টা ও বাবার বাসায় করবে,কারন ঈদের পরের দিন ওর চাচাতো বোনের বিয়ে,অনেক দিন সবার সাথে দেখা হয়না,বিয়ে উপলক্ষে সবার সাথে দেখা হবে,কিন্তু কোনভাবেই নুমান রাজী হলোনা। কারন,ঈদের পরের দিন ওর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশে আসবে প্রায় চার বছর পর। সে উপলক্ষে ওরা সব বন্ধু একসাথে হবে। সুতরাং সে কোনভাবেই অন্যদিকে যেতে পারবে না...
অনেকক্ষন ধরেই তনুর ফোন বাজছে,কিন্তু তনু ইচ্ছে করেই ফোন ধরছে না।
কারো সাথে এই মুহুর্তে ওর কথা বলার কোন ইচ্ছে নাই।
আবারো ফোন বাজছে,বিরক্ত হয়ে মোবাইল হাতে নিল,তনুর মা ফোন দিচ্ছে। রিসিভ করে ফোন কানে দিয়েই কাজ করতে লাগল,
--বল,আম্মু,কি বলবা?
--আসসালামু আলাইকুম!কিরে? তুই এইভাবে কথা বলছিস কেন?কি হইছে?
--নতুন করে কি কিছু হতে হবে?পুরনো যা হইছে তা কি যথেষ্ট না?
--মানে?!!কি বলছিস কিছুই বুঝতেছিনা!!
--বুঝবা কেন?আমার কথা কি দুনিয়ার কেউ বুঝে নাকি?ময়মনসিংহে তো ছেলের আকাল পড়ছিল,তাই আমাকে সবাই মিলে কুমিল্লার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছো,এখন তোমরা সবাই একদিকে আর আমি আরেকদিকে...!
এই রকম একটা অশান্তি থাকলে কি আর নতুন করে কোন ইস্যু লাগে ভালো না থাকার???!
তনুর মা হেসে ফেললেন মেয়ের কথা শুনে...
--হায়রে পাগলী!এতো দিন পরেও এ নিয়ে এতো রাগ করলে হয়?সবার ভাগ্য কি আর এক রকম হয় বল?এখন যা হয়েছে সেটার সাথে মানিয়ে নে,আর তুই তো ঈদের একদিন পর আসছিস ই...একদিন না হয় দেরি হলো এই যা...
--বাহ আম্মু!তুমিও দেখি তোমাদের জামাইয়ের সুরে কথা বলছো!আমাকে কি তোমাদের মানুষ মনে হয় না?এই দুনিয়ার জ্যাম,জার্নি করে যাবো একদেশে দু'দিনও বিশ্রাম নিতে পারবো না,আবার ছুটবো আরেক দেশে!সেখানেও যে শান্তিমতো দু'টো দিন থাকবো তা না,আবার ছুটতে হবে ঢাকাতে অফিস ধরতে...!
--হুমম...কি আর করবি বল?এই আমাদের মেয়েদের জীবন...আর এমন অবস্থায় তুইতো আর একা না,তোর মতো এমন অনেকেই দুই দেশে বিয়ে করে দিন পাড় করছে,দুই দিকে ব্যালেন্স করে চলা কি আর এতোই সহজ বল?একটু তো ধৈর্য ধরতেই হবে...।
তনু কোন কথা আর বলে না,মা বুঝতে পারে তনু কাঁদছে...অনেক অভিমান হয়েছে,থাক,কাঁদুক...
তনু কোন কথা না বলে ফোন রেখে দেয়। হাতের কাজ ফেলে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে টেরই পায়নি।
একটা বই নেবার জন্য রুমে ঢুকে নুমান দেখে তনু বিছানার এক পাশে ঘুমিয়ে আছে,সারা বিছানা কাপড় দিয়ে ছড়ানো।
সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে হাতের বইটা রেখে কাপড় গুলো একপাশে রাখে,তারপর তনুর মাথার নিচে আস্তে করে বালিশ দিয়ে মোবাইলটা সাইলেন্ট অপশনে রেখে নিজের স্টাডি রুমে ঢুকে নুমান। চেয়ারে মাথা রেখে আপন মনেই হেসে ফেলে...!এই বাড়ি যাওয়া নিয়ে বাসায় গত ২/৩দিন ধরে কি যুদ্ধ অবস্থাটাই না করে রেখেছে তনু! পারেও মেয়েটা...রাগ একবার উঠলেই হলো,কোনভাবেই থামানো যাবেনা,যতক্ষন না নিজে থেকে থামবে। আর যতক্ষন রাগ থাকবে সামনে যে থাকবে যাই থাকবে তার উপরই রাগ ঝাড়বে। রাগ ঠান্ডা হয়ে গেলে সব ঠিক।
নুমান ভালো করেই জানে,ও যদি এখন তনুদের বাড়ি যাওয়ার টিকেট করে আনতো তাহলে তনু আরো ক্ষেপতো,শুধু ক্ষেপতোই না,সেই টিকেট ফেরত দিয়ে কুমিল্লা যাওয়ার টিকেট করিয়ে আনতো।
হাজার কিছু হোক,নুমানদের বাসা আর নুমানের ইচ্ছে তনু খুব ভালো ভাবেই মেইনটেইন করবে। মাঝ খান থেকে নিজের ইচ্ছে পূরন না হবার রাগ ঝাড়বে নুমানের উপর। নুমান সে জন্য চাচ্ছিল,এইবার ঈদটা তনুদের বাসায়ই করতে কিন্তু মা বার বার ফোন করে একই কথা,ঈদ এখানে করতে হবে,ঈদের দিন সকালে ছেলের মুখ না দেখলে নাকি তার ঈদ ই মাটি হয়ে যাবে। কি আর করা...!মায়ের কথা তো আর ফেলা যাবে না। সো তনুর রাগ সহ্য করতেই হবে।
দুপুরে খেতে বসেও নুমান খেয়াল করল তনু আগের মতোই গরম মেজাজে ঠান্ডা অবস্থায় আছে!কাল সকালে বাড়ি যাবে,তনু যদি এমন অবস্থায় থাকে তাহলে তো বাসার এই অবস্থার কথা কুমিল্লা পর্যন্ত যাবে,আর যদি একবার মায়ের কানে যায় তনুর রাগের কথা তাহলেতো কথাই নেই!মা দুনিয়াদারী ভেবে লংকা কান্ড করে ফেলবে!
বিকেল বেলা নুমানকে কিছু না বলেই তনু বের হয়ে গেলো,ফিরল রাতে,হাতে শপিং ব্যাগ। নুমান নিজের কিছু জিনিস ল্যাগেজে রাখার জন্য রুমে এসে দেখল,তনু নিজের জন্য নতুন শাড়ি কিনেছে,সেই সাথে সবার জন্য টুকটাক গিফট,তবে নিজের জন্য কিছুই দেখলো না, নুমান একটু বিরক্ত হলো,সব ঈদেই কি সবাইকে গিফট দিতে হবে?!শুধু শুধু টাকার অপচয়! এই মেয়ে রেগে গেলে কারো কথা শুনে না,ইচ্ছে হয়েছে কতো গুলো টাকা খরচ করে এসেছে!শুধু শুধু...!ধুর...!
তনু আড় চোখে দেখতে লাগল নুমানের এক্সপ্রেশন। মনে মনে হাসল,কেমন লাগে এখন?টাকা খরচের কষ্টে জ্বলতেছে!আর এদিকে আমি যে কষ্ট পেলাম?সেটা কিছু না?হুহ...জ্বলো আরো বেশি করে জ্বলো। এইবার গ্রামে যেয়ে তোমার মায়ের কাছে তোমাকে যদি বকা না শুনাইছি?এই শাড়ি যদি আম্মার পছন্দ না হয় তাহলে বলবো এটা তুমি কিনেছো!তখন বুঝবে কি মজা...!
সেই কখন থেকে সিএনজি তে বসে আছে দু'জন জ্যাম ছাড়ার কোন লক্ষনই নেই,ওদিকে বাস ছাড়ার সময় ঘনিয়ে আসছে,নুমানের চিন্তায় কপালে ঘাম জমতে শুরু করছে,তনুর দিকে তাকালো,কোন বিকার নেই...!দিব্বি কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে। এখন পর্যন্ত নুমানের সাথে কথা বন্ধ তার।
এইভাবে কতক্ষন কথা না বলে থাকা যায়...!নুমানের ইচ্ছে করতেছে জ্যামের উপর জমা রাগ গুলো তনুর উপরে ঝাড়তে!
তনু খেয়াল করলো নুমান অনেকক্ষন ধরে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে! ভাবে তো মনে হচ্ছে তনুর উপর রাগ ঝাড়ছে!তনু ওর দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে ভ্রু নাচালো ,জবাবে নুমান কার্টুন মার্কা একটা স্মাইল দিয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরালো। দু'জনের মুখেই অস্পষ্ট হাসির রেখা...!
জ্যাম ছাড়ার কোন লক্ষন নেই,হাঁটা ছাড়া মনে হয় না আর কোন উপায় আছে,কিন্তু টিকাটুলি থেকে বাসস্টপ পর্যন্ত রাস্তা খুব কম ও না। নুমান তাকিয়ে দেখল অনেকেই রিক্সা,সিএনজি ছেড়ে হাঁটা শুরু করেছে,অগ্যত সেও ভাড়া মিটিয়ে নামল,তনুর দিকে তাকিয়ে বলল,
--চল,বাকিটা পথ হেঁটেই যাই,জ্যাম ছাড়ার আশায় থাকলে আর বাড়ি যেতে হবে না।
তনু নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
--বাড়ি যেতে না হলে তো ভালোই হয়,কিন্তু আমি এই প্যাক প্যাক রাস্তা দিয়ে ল্যাগেজ হাতে নিয়ে এতো দূর হেঁটে যেতে পারবো না,আমার নতুন স্যান্ডেলটা নষ্ট হয়ে যাবে!!
নুমানের ইচ্ছে করল দাঁত মুখ খিঁচে একটা ঝাড়ি দিতে,শেষ মুহুর্তে এসে নিজেকে সামলে বলল,
--ওকে ম্যাডাম,আপনি বরং এখানেই বসে থাকেন,আমি যাই,আর হ্যাঁ,পারলে এখান থেকে ময়মনসিংহ যাবার বাসে উঠে যাবেন। ওকে?যত্তোসব ঢং!!
বলে দুটো ল্যাগেজ হাতে নিয়ে একাই হাটা শুরু করল।
সেদিকে তাকিয়ে তনু হাসি চাপতে চাপতে বলল,
--এই যে স্যার,আপনি আমার ল্যাগেজ নিয়ে যাচ্ছেন ক্যান?হিহিহি।
নুমান সেদিকে কান না দিয়ে হাটতে লাগল।
শাড়ি পেয়ে তনুর শ্বাশুড়ি খুবই খুশী হলেন,কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে শাড়িটা কে কিনেছে টা প্রশ্ন করতেই,তনুর আগে নুমান বলে উঠল,
--আম্মা,আমি কিনি নাই,তোমার বউ মা কিনেছে,আমাকে কি জীবনে দেখছো ওমন শাড়ি কিনতে?
তনু চেঁচিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ওর শ্বাশুড়ি বলল,
--আমিও তো সেটাই বলি,তুই আর তোর বাবা দু'জনের পছন্দই তো হলো ক্যাটকেটে কালার,আর তনুর পছন্দ হলো একদম আমার মনের মতো,আমি তো শাড়ি দেখেই বুঝেছি এটা তনুর পছন্দে কেনা।
বলেই শ্বাশুড়ি বউ একসাথে হেসে ফেলল...কিছুক্ষন দু'জনের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে নুমান কপট রাগ দেখিয়ে উঠে চলে গেল।
ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে নুমান দেখল বিছানায় নতুন পাঞ্জাবী,
বুঝল তনু কিনেছে।
পাঞ্জাবী হাতে নিয়ে হেসে তনুর দিকে তাকালো নুমান,তারপর মুখটা গম্ভীর করে বলল,
--কি দরকার ছিল,শুধু শুধু টাকা খরচ করে এই রকম একটা আধমরা পাঞ্জাবী কেনার?নাহ...তুমি যেইভাবে টাকা খরচ করো না,আমি তো অল্প দিনেই ফকির হয়ে যাবো...!
তনু কোমড়ে হাত দিয়ে ওর দিকে ঘুরে বলল,
---তোমার তাই মনে হয়?আমি তোমাকে ফকির বানিয়ে ফেলবো?তাহলে তো ভালোই হয়!আমি আজকাল একটাও ইয়াং ফকির দেখি না চারপাশে,তোমাকে দেখলে ভালোই লাগবে...!
নুমান হাসতে হাসতে বলল,
--ঠিক আছে,ভালোই হবে,মানুষ তোমাকে ফকিরের বউ বলবে!আমিও শুনে শান্তি পাবো...হাহাহা
তনু চোখ ছোট করে ভ্রু কুঁচকে নুমানকে ঠেলে ঘর থেকে বের করতে করতে বলল,
--হইছে,আর আমাকে দোষ দিতে হবেনা,আমি জানিতো আমার কোন কাজ,কোন কিছুই আপনার পছন্দ হয় না,এখন যাও নামাযে যাও...
বলে দরজা লাগিয়ে দিল। অনেকক্ষন পর দরজা খুলে তনু দেখে নুমান ঠায় দারিয়ে আছে,ওকে দেখে হেসে বলল,
--ঈদ মোবারক, পাঞ্জাবীটার জন্য থ্যাংকস। অনেক সুন্দর হয়েছে...
তনুও হেসে বলল,
--ঈদ মোবারক... এই পাঞ্জাবীতে তোমাকে সুন্দর লাগছে...
(উৎসর্গঃপ্রিয় সুমু এবং মামুন ভাইকে। তোমরা দুইজন ঝগড়া কর, রাগ ক্র আর যাই করো না কেন আমার দেখা অসাধারন একটা জুটি তোমরা।
অনেক অনেক দোয়া আর শুভ কামনা রইল তোমাদের জন্য...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।