তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা
১৯৬৭ সাল। জানুয়ারী মাসের কোন এক দুপুর।
রোদের আলোয় ঝলমলে দ্বিপ্রহর ঠান্ডা হয়ে আসছে। সকাল থেকে চারিদিকে হইচই লালবাগে। পুরান ঢাকার সরু রাস্তাগুলোতে গিজগিজ করছে পুলিশের গাড়ী।
নিরাপত্তাবাহিনীর সবাই তটস্থ, যার যার দায়িত্বে তারা সতর্ক।
পূর্ব পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী লোক গভর্ণর মুনায়েম খান আসছেন। এ সংবাদে এলাকাবাসীরও আগ্রহের কমতি নেই। তারাও ফিসফিস করছে। দূরে দাঁিড়য়ে তামাশা দেখছে।
বেলা তিনটা। ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে লালবাগ শাহী মসজিদের সামনে এসে গাড়ী থামল। গভর্ণর গাড়ী থেকে নামলেন। বাসা থেকে পায়জামা পাঞ্জাবী পরে এসেছেন তিনি। গাড়ি থেকে নেমে বুকপকেটে ভাঁজ করে রাখা টুপি বের করে মাথায় দিলেন।
তার দুপাশে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র দেহরক্ষী। তাদের বুটের আওয়াজে ভয়ঙ্কর শব্দ হচ্ছে। বাড়ীঘরের জানালা দিয়ে মহিলারা উঁকি দিয়ে দেখছে এ দৃশ্য। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর। কি বিশাল সৈন্যবহর।
বাচ্চারাও হা করে তাকিয়ে আছে।
লালবাগ শাহী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে তিনি ডানদিকের রুমে গেলেন।
এ রুমে একজন মাওলানা থাকেন। অন্ধকার এ রুমটিতে বসতে গভর্ণরের অস্বস্তি লাগে। তারপরও তাকে আসতে হয়।
আগেও তিনি এসেছেন কয়েকবার। তিনি জানেন, এ মাওলানাকে ডাকলে তিনি গভর্ণর হাউসে যাবেন না। খোদ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা এ বিষয়টি জানেন। মাওলানার কাছে তাদের প্রয়োজন বেশি।
মাওলানা বসে আছে পাটিতে।
তার সামনে রাখা কিতাবের পাতায় ডুবে আছেন তিনি। এ সময়টা তার বিশ্রাম এবং পড়াশোনারও। রুমের এক কোণায় একটি চকি। অতি সাধারণ একটি তোষকের উপর পুরনো চাদর বিছিয়ে দেয়া আছে। চকির সামনে ছোট একটি টেবিল।
মাটিতে বসতে হয়। রুমটিতে কোন ফ্যান নেই। টেবিলের উপর হাতপাখা আছে। চকি এবং টেবিলের আশেপাশে বইপত্র দিয়ে ঠাসা। একটি আলমারিও আছে।
তালা মারা।
দেশের গভর্ণর আসছেন। তাতেও এ মাওলানার কোন ব্যস্ততা নেই। তিনি তার রুমে বসে নিজের কাজে মগ্ন। কে আসছে, কেন আসছে, এসব নিয়ে তার ভাবার সময় নেই।
দরজায় ঠকঠক শব্দ।
আসসালামু আলাইকুম।
আমি মুনায়েম খান, আপনার কাছে এসেছি। ভেতরে আসতে পারি?
ওয়া আলাইকুমুস সালাম, জ্বী, আসুন।
গভর্ণর রুমের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
মাটিতে পাটি বিছিয়ে বসার সাদামাটা আয়োজন। এর চেয়ে চকির জায়গা বড়। চাদর বিছানো আছে।
হুজুর, আমি কি উপরে বসবো নাকি নীচে?
আপনার যেখানে খুশী, বসুন।
গর্ভণর নীচেই বসে পড়লেন।
শীতল পাটিতে বসতে তার তেমন মন্দ লাগছে না। তিনি মাওলানার মেজাজ মর্জি বুঝতে চাইছেন। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। মাওলানা নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন। তার চেহারা দেখে ভেতরের ভাব বোঝার উপায় নেই।
হুজুর! আমি এসেছি, আমার আগমনে কি আপনি খুশী হলেন?
মোটেই না। পীর ফকিরদের দরবারে শাসক নেতাদের আগমন মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। তারা দুনিয়ার লাভের জন্য এসেছেন নাকি আখেরাতের কল্যাণের জন্য, বোঝা যায় না। অনেকেই দুনিয়ার স্বার্থে আসেন। আলেমদের মধ্যে ঐ আলেম অনেক মন্দ যে রাজাদের দরবারে পড়ে থাকে।
মাওলানার ভাবলেশহীন এমন কথায় ঢোক গিললেন গভর্ণর। ভেতরে তার উশখুশ করছে। এ মাওলানার কি কোন ভয়ডর নেই।
হুজুর! আমি আসলাম। আপনি তো আমাকে সম্মান দেখিয়ে উপরে বসার জন্য বললেন না!! আমি কি এটুকু সম্মানের পাত্র নই?
হু, দেখুন, কোন জালেমকে সম্মান করলে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে।
আমি চাই না, আপনাকে সে সম্মান দেখিয়ে আল্লাহর আরশ কাঁপাতে। ওত সাধ্য আমার নেই।
তবে কি আমি জালেম?
জ্বী জনাব! আমি আপনাকে এবং আপনার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে জালেম মনে করি। আপনারা পারিবারিক আইনের নামে যা করেছেন, তাতে আল্লাহ এবং রাসূলের সীমালঙ্ঘন করেছেন। কাজেই আপনারা জালেম।
আপনার এ আগমনে আমি বিচলিত। আমার মধ্যে এখনও অশাান্তি বিরাজমান।
গভর্ণর মুনায়েম খান থতমত খেয়ে গেলেন। মুখের উপর এমন কথা এ মাওলানা বলতে পারেন! এমন ধারণা তিনি এ জনমে করেন নি।
তাদের মধ্যে কিছু কথা হল।
মুনায়েম খান প্রাণপণ কোশেষ করলেন, মাওলানার সাথে হাসিখুশীর আলাপ জমাতে। তিনি ব্যর্থ হলেন।
রওয়ানা হওয়ার আগে গভর্ণর বললেন, হুজুর! আমাকে কিছু নসিহত করেন।
নসিহত করার মতো কিছু নেই। ৬১ সালের এ আইন বাতিল করুন।
দেশে পর্দার প্রতি গুরুত্ব দিন। আপনার গর্ভণর হাউসে সবচেয়ে কমদামের চাল ব্যবহার করুন। আপনার খাবার দাবারে সাধারণ জনগণের মতো আহারের আয়োজন করুন। কিয়ামতের মাঠে এ দেশের হাজার হাজার মানুষের হক নষ্টের অভিযোগে আপনাকে জবাবদিহী করতে হবে।
গভর্ণর সাহেব মাওলানার ব্যক্তিত্ব ও নির্লোভ অহমিকা দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
তিনি পকেটে হাত দিয়ে তৎকালের ছয়শ টাকা বের করলেন।
হুজুর! আমার আরয! এই টাকা আমার বেতন থেকে দিচ্ছি। কোন সন্দেহ সংশয় নেই, আপনার মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য। একবেলা গোশতের আয়োজন করবেন। আমার পক্ষ থেকে সামান্য মেহমানদারী।
জনাব, ্ ছয়শ টাকা আপনি দিয়ে দিচ্ছেন। তার মানে বেতনের বাকী অংশে আপনার সংসার চলে যাবে। তবে কি আপনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এ ছয়শ টাকা অতিরিক্ত নিচ্ছেন না? আপনি কি হযরত উমরের রুটি হালুয়ার ঘটনা ভুলে আছেন? এ টাকা আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করব না। আপনি নিজের হাতে তা মাদরাসার ম্যানেজারের কাছে দিয়ে দিন।
মাওলানা একবারও টাকাগুলোর দিকে তাকালেন না।
মুনায়েম খান ম্যানেজারের কাছে জমা দিয়ে বের হলেন লালবাগ থেকে।
এই মাওলানার জীবন নিয়ে আমার নতুন ধারাবাহিক......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।