আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য গার্লিক ব্যালাডস: কথা বলো না'র অনবদ্য কথা

সাহিত্যে নোবেল হয়ে পড়েছিল ইউরো কেন্দ্রিক। গত পাঁচ বছরে চারবারই সাহিত্যে নোবেল উঠেছে ইউরোপের সাহিত্যিকদের হাতে। এবার তাই জোর গুঞ্জন ছিল, ল্যাটিন আমেরিকা বা এশিয়ায় যাচ্ছে সাহিত্যের নোবেল। কিন্তু সেই গুঞ্জন বা কানকথার কোথাও মো ইয়ানের নাম উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবোত্তর চীনা কথাসাহিত্যের রাখাল মো ইয়ানের হাতেই শোভা পাবে এবারের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার।

ছোট্ট গুয়ান মোয়ে যেন অস্থির রাজনীতির শিকার না হয়, সেই ভয়েই পিতামাতা বলেছিলেন চুপ থাকতে। কে না জানে, যত কথা তত শত্রু। তাই গুয়ান মোয়ে হয়ে গেছেন মো ইয়ান। যার বাংলা অর্থ মুখে কুলুপ আঁটো বা কথা বলো না। মুখ হয়তো বন্ধ করেছিলেন মো, কিন্তু নিজের ভাবনার সব কথা নির্দ্বিধায় বলে গেছে তাঁর কলম।

লোককাহিনী আর ইতিহাসের পরম্পরায় মোর উপন্যাসে উঠে এসেছে আধুনিক চীনা নাগরিকদের জীবনযাত্রা। মো ইয়ানের নোবেল জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তাঁর ‘হ্যালুসিনেটরি রিয়ালিজম’ বা মতিভ্রম বাস্তবতা। যাতে মূর্ত হয় আবহমান চীনের কৃষকের জীবনচরিত্র আর সংগ্রাম। খেটে খাওয়া মানুষের নিরন্তর যুদ্ধ। যা তার ফেলে আসা শৈশবেরই অনুবাদ।

মতিভ্রম বাস্তবতার গভীরে প্রবেশ করতে পাঠককে ডুব দিতে হবে মো ইয়ানের উপন্যাস রেড সরঘাম, দ্য গার্লিক ব্যালাডস ও বিগ ব্রেস্টস অ্যান্ড ওয়াইড হিপস উপন্যাস ত্রয়ীতে। এখানে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত মো ইয়ানের বহুল পঠিত উপন্যাস দ্য গার্লিক ব্যালাডস নিয়ে আলোকপাত করা হলো... মো ইয়ানের ব্যঙ্গপূর্ণ ও কাব্যিক কথামালার অনবদ্য এক সৃষ্টির নাম দ্য গার্লিক ব্যালাডস। নিউইয়র্ক টাইমস মো’র ‘দ্য গার্লিক ব্যালাডস’ বা রসুন গাঁথাকে বর্ণনা করেছে সাহিত্যের কাঁচামালে ভরপুর ও ঘটনাবহুল অসাধারণ এক উপন্যাস হিসেবে। যেই আখ্যানে বর্ণিত হয়েছে, প্যারাডাইজ নামের রুঢ় আর ক্ষমাহীন এক অঞ্চলের কৃষকদের কথা। এখানে প্রদেশের কর্তাব্যক্তিরা কৃষকদের শুধু একটি ফসল উৎপাদন করতে বাধ্য করে।

অনেকটা বাংলা অঞ্চলে ইংরেজদের অত্যাচারে নীল চাষের কাহিনীর মতো। প্যারাডাইজ অঞ্চলের কৃষকরা বাধ্য হয়ে রসুন চাষ করে। কিন্তু সেই একই কর্তারা নিজেদের পকেট আর গুদামঘর ভরাট করে যখন বলে তারা আর ফসল কিনতে পারবে না, তখন ক্রুব্ধ হয় অসহায় কৃষক সমাজ। অলস আর একগুঁয়ে অত্যাচারি শাসকদের আখড়া এই প্যারাডাইজ প্রদেশ। যারা সুযোগ পেলেই পিছিয়ে থাকা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কৃষককূলের ওপর বর্বর অত্যাচার চালায়।

তাদের জীবনে সন্ত্রাস, রাহাজানি, চুলোচুলি নৈমিত্তিক ঘটনা। একটা গুমোট ভাব সব সময় এসব মানুষকে ঘিরে রাখে। কোনমত বেঁচে থাকাই যেন তাদের জীবনের প্রথম ও শেষ কথা। ট্যাঙ শাসনামলের কবি দু ফু’র সেই উক্তির মতো, সবাই যেন ভরপেট স্কিমে বন্দী। কিন্তু দ্য গার্লিক ব্যালাডসে বর্ণিত কল্পনার খামখেয়ালি ও অত্যাচারি শাসকদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই তো বাস্তবেও আছে।

চোখ মেললেই দেখা যায় মো ইয়ানের বর্ণিত শোষকদের। বাস্তবের সেসব শাসকরা গার্লিক ব্যালাডসকে সহজে মানবে কেন! তাই মোটেই আশ্চর্য হবার মতো বিষয় নয়, প্রকাশ হবার পর মো ইয়ানের গার্লিক ব্যালাডস চীনে নিষিদ্ধ হয়েছিল। যদিও ততদিনে চারটি উপন্যাস আর অসাধারণ কিছু ছোট গল্পের জন্য বেশ জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেছিলেন মো। তাঁর আরেক উপন্যাস রেড সরঘাম নিয়ে ততদিনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। লেখায় প্রকৃতির অনবদ্য ছোঁয়া, অসুরীয় দখলবাদ, অদ্ভুত সব স্বপ্ন আর মতিভ্রমে ভরা তরল বাস্তব জীবনের মূর্ততায় ততদিনে তিনি জনসাধারণের আরও কাছের লেখক হয়ে গেছেন।

দ্য গার্লিক ব্যালাডসের সেসব খামখেয়ালি দুর্নিতিবাজ শাসকদের বিচরন রাষ্ট্র থেকে পরিবার পর্যন্ত। দু’জন রসুন চাষী, যারা কিনা আবার চাচাতো ভাই জাও ইয়াং (ভেরা জাও) আর জাও মা (ঘোড়া জাও) এই উপন্যাসের মূল চরিত্র। যাদের ঘিরে আবর্তিত হয়েছে অন্যান্য চরিত্রগুলো। প্রাদেশিক সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের সময় পুলিশের হাতে বন্দী হয় দুই জাও ভাই। অন্য অনেক বিদ্রোহীর সঙ্গে জাও ইয়াংকে নির্দয়ভাবে প্রহার করে জেল দেয় সরকার।

আর উপন্যাসের নায়ক জাও মা নিজেকে মুক্ত করে। দুই চাচাতো ভাইয়ের কষ্টেভরা কিন্তু মিলনাত্নক এই উপন্যাস পাঠকদের কাছে মূর্ত হয় ক্যালাইডস্কোপে দেখা সুন্দর রঙের মতো। চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোর মতো মো ইয়ানের দ্য গার্লিক ব্যালাডসে দেখা যায় ছোটখাটো কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের বিস্তৃতি। যেমন ঝাং কু নামের এক অন্ধ চারণকে দেখা যায় গ্রিক কোরাসের মতো বিপর্যয় উদঘাটন করে। দ্য গার্লিক ব্যালাডস যেমন রসুনচাষীদের বিপ্লবের গল্প, তেমনি হৃদয় নিংড়ানো এক ভালোবাসারও আখ্যান।

বিয়ে ঠিকঠাক জেনেও প্রতিবেশী রসুনচাষীর অষ্টাদশী কন্যা ফ্যাঙ জিনজুকে ভালোবাসার বন্ধনে জড়ায় জাও মা। জিনজুর বিয়ে ঠিক হয়ে থাকাটাও অনেক জটিল সমীকরণে ভরা। জিনজুকে পরিবারের পছন্দের পাত্রের কাছে বিয়ে দিলে ওর বড় ভাইয়ের কপাল খুলে যাবে। জিনজুর ভাইয়ের এক পা নেই। জিনজুর বিয়ে দিলে সে পাবে এক সুন্দরী বউ।

কিন্তু প্রেমকে জয়ী করতে সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় জাও মা ও জিনজু। কিন্তু প্যারাডাইজ প্রদেশের সবার বিরুদ্ধে কতটা লড়াই করতে পারবে এ প্রেমিক জুটি? কারণ প্যারাডাইজ হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে ভালবাসা আর সমৃদ্ধি সর্বদা দুর্নীতি আর হিসেব-নিকেশের বলি হয়। এ প্রেমিক জুটি তুমুল ঝগড়া করে, তাদের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়, একে অন্যের পদলেহন করে। কিন্তু ভালবাসা তবু ফুরায় না। অরুচিকর আর পচনধরা এক সমাজে বসবাস করে ওরা।

যেখানে সকাল হয় প্রশ্রাব, মরা ইঁদুর, পঁচা রক্তের গন্ধে। তার সঙ্গে ব্যপ্তিশীল থাকে রসুনের গন্ধ। যা আটকে থাকে ভালোবাসার শরীরেও। মো ইয়ানের বর্ণনায় যা অনেক জাগতিক, “তার উদর থেকে গরম বাতাসের তরঙ্গ ভেসে এলো। জাও মা’র ইন্দ্রিয় জুড়ে স্থাপিত হলো রসুন আর তাজা ঘাসের স্বাদ”।

গার্লিক ব্যালাডসে প্রকৃতির মধ্যে মুক্তির স্পন্দন খুঁজেছেন মো, “পাতাগুলি ধুলায় রূপা হয়ে গেছে। যেখানে পতঙ্গরা কিচমিচ শব্দ তুলে গান গাইছে আর নিচে কুয়াশায় সিক্ত হচ্ছে শুষ্ক পৃথিবী”। এ দৃশ্য যেনো প্যারাডাইজ প্রদেশের উদাসীন শাসক আর প্রকৃতির উদাসীনতারই এপিঠ-ওপিঠ। যা মানুষের বেঁচে থাকার পরিবেশের সঙ্গেও যুক্ত। মো ইয়ানের কাব্যময়তায় মুগ্ধ হতে হয় পাঠকদের।

এই উপন্যাসে তিনি লিখেছেন, “ঘন কুয়াশার ভেতর অগণিত গুঁটিপোকা ধাতব মাথা দিয়ে মালবেরি পাতায় সীমারেখা তুলে দিচ্ছে। তাদের কড়মড় করে চিবিয়ে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধে যাচ্ছে বুকের ভেতর। যা জাও মা’র হৃদয় দেখতে পাচ্ছে”। চীনের গ্রামীন জীবনের বাইরেই মো ইয়ানের কথাসাহিত্য এতোটাই মৌল মানবিক আর প্রাণবন্ত যে, তা পাঠককে কখনোই বিষাদগ্রস্ত করে না। বরং নিয়ে যায় অন্য এক মোহগ্রস্ত বাস্তবতায়।

যার অন্যতম নিদর্শন, দ্য গার্লিক ব্যালাডস। আর শেষ পর্যন্ত মো ইয়ানের উপন্যাসে কিন্তু চীনের দৃঢ় মেরুদন্ডের কথাও বলে। কিন্তু মো ইয়ান চিরায়ত মেহনতি আর দরিদ্র মানুষের। মো’র দরিদ্র মানুষেরা বলতে পারে, “এই পৃথিবী আমাদের মতো মানুষের জন্য তৈরি হয়নি। তাই আমাদের ভাগ্যকে অবশ্যই মেনে নেয়া উচিত”।

কী, আপনার আশেপাশে মো ইয়ানকে খুঁজে পাচ্ছেন? ১৭.১০.১২ সকাল দশটা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।