আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এল বর্ষার দূত

মৎস্য ভবন মোড় পার হতেই ঝিরঝিরে হাওয়ার সঙ্গে মিষ্টি সৌরভ এসে ঝাপটা দিল নাকে। চেনা ঘ্রাণ। কদম ফুটেছে আশপাশে কোথাও।
বেশ খানিকটা রাত। পাড়াগাঁ হলে ঘুমে নিঝুম হয়ে পড়ত।

রাজধানীতে দিনের ব্যস্ততার রেশ রয়েই গেছে খানিকটা। পথে যানবাহনের ভিড় কমছে। তাই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা একটু ঢিলেঢালা। প্রধান সড়কগুলোতেও রিকশা চলছে। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে রিকশায় ফিরছিলাম সিদ্ধেশ্বরীর দিকে।


চকিতে মনে পড়ল—তাই তো, এই সড়কের দুই পাশে—শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় চিত্রশালার কাছে রমনায় বেশ কয়েকটি কদমগাছ মাথা তুলে আছে। মেঘলা আকাশ। সড়কের সোডিয়াম বাতির ফ্যাকাশে হলুদ আলোর বিপরীতে দীর্ঘদেহী কদমগাছগুলোর মাথায় নিবিড় পাতায় জড়িয়ে অন্ধকার যেন আরও ঘন হয়ে আছে। তার ভেতরে ফুলগুলো সহসা চোখে পড়ে না। শুধু তার সৌরভ চারপাশ মদির করে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে ‘কদমগাছের ডালে/ পূর্ণিমা চাঁদ আটকে পড়ে/ যখন সন্ধ্যা কালে...’।
পূর্ণিমা যে নয় তা নিশ্চিত, তবে শুক্ল না কৃষ্ণপক্ষ তা-ও জানি না। আকাশ ছেয়ে আছে ধূসর মেঘে। এবারের গ্রীষ্ম কেন যেন শুরু থেকেই দহনবিমুখ। ভালোই হয়েছে।

গরমে-গুমটে হাঁসফাঁস করা পরিস্থিতি থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া গেছে। বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝে। সে কারণে হয়তো কদমও ফুটেছে একটু আগেই। ভেজা হাওয়া মাখামাখি হয়ে আছে তার আকুল করা সৌরভে।
কদম ফুল বাংলায় বর্ষার দূত।

তাকে নিয়ে কাব্যে, সংগীতে, নাটকে কতই না বন্দনা। এক রবীন্দ্রনাথের লেখাতেই তো বিস্তর। কদম বললেই মনে পড়ে তাঁর গান ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’। আরও আছে ‘কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ়মেঘের’, ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে’। কদমের একটি নাম যে নীপ, তা অনেকেই জানেন।

এ ছাড়া বৃত্তপুষ্প, মেঘাগমপ্রিয়, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, প্রাবৃষ্য, ললনাপ্রিয়, সুরভি, সিন্ধুপুষ্প—এসবই কদমের নাম।
বাংলায় কদম সংস্কৃত কদম্ব শব্দের অপভ্রংশ। কদম্ব মানে যা বিরহীকে দুঃখিত করে। ‘নির্জন যমুনার কূলে, বসিয়া কদম্ব ডালে/ বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যামরায়’। সেই বাঁশির সুরে ব্যাকুল রাধার মন।

মধ্যযুগের পুরো বৈষ্ণব সাহিত্য রাধা-কৃষ্ণের বিরহ বেদনা মোহিত হয়ে আছে কদমের সুরভিতে। এখনো লোকসংগীতে, গাথায় অত্যন্ত জনপ্রিয় এই আখ্যান।
কদম আমাদের নিজস্ব গাছ। ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, চীন, মালয় এর আদি নিবাস। বৈজ্ঞানিক নাম Anthocephalus indicus।

দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ বইতে কদমকে বলেছেন, ‘বর্ণে গন্ধে সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর প্রথমদের অন্যতম। ’ লম্বাটে ধাঁচের বড় বড় পাতায় ভরা লম্বা গাছ। কদমগাছ চেনেন না এমন লোক কম। তাই বিশদ বর্ণনা অনাবশ্যক। ফুলের সৌন্দর্য অতুলনীয়।

টেনিস বলের মতো আকারের যেটিকে সচরাচর একটি ফুল বলে ধরা হয়, সেটি আসলে অসংখ্য ফুলের সমারোহ। ভেতরের মাংসল পুষ্পাধারে হলুদ রঙের নলাকৃতির ফুলগুলো আটকে থাকে। তার ভেতর থেকে খানিকটা বেরিয়ে আসে সাদা রঙের পরাগকেশ। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে সাদা-হলুদ কদমের মনোরম শোভা।
ফুলের বাহার যতই থাক, কদমের দারুমূল্য তেমন নেই।

দ্রুত বেড়ে উঠলেও এর কাঠ নরম। ও দিয়ে মূল্যবান আসবাব হয় না। সে কারণে হালের বাণিজ্যিক বনায়নের যুগে কদম উপেক্ষিত। কমে আসছে কদমের উপস্থিতি। অর্থই যখন সবকিছুর মানদণ্ডে পরিণত, তখন দিনে দিনে আরও কত কিছুই যে অপ্রয়োজনীয় বোধ হবে কে জানে!।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।