Never lose hope...., Never Stop Expedition.... এই লিখাটা অনেকদিন আগে ব্লগে দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমি এই ব্লগের মডারেশন কমিটির (কমিটিই তো মনে হয়) নজরদারিতে (মানে watch এ) ছিলাম । ফলে আমার লিখাটা তখন প্রথম পাতায় যাবে না বিধায় আর দেইনি। আর এই লিখাটা এমনই যে এখন এর কালসংক্রান্ত কোন গুরুত্ব নাই। তবে ঐতিহাসিক এবং একই সাথে "আবর্তনসংকুল অথচ বিবর্তনহীন জীবনধারা" টাইপ এক গুরুত্ব এখনো বর্তমান।
কারণ সেই সময়ের সব চরিত্রই এখনো ঠিক সেই সময়ের মতোই রয়ে গিয়েছে। একটুও বদলায়নি।
১২ মার্চ সকালে হঠাৎ একটা হুজুগ চাপলো। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম জুরাইনে আমার যে বন্ধুটি থাকে ওর ওখানে হানা দেবো। খালা-মামাদের বাসায় মানুষ বেড়াতে যায়, আর বন্ধুর বাসায় হানা দেয়।
যথারীতি ল্যাপটপের ব্যাগটা হস্তগত করে খিলগাঁও বাগিচার বাসা থেকে রাস্তায় নামলাম। তখন বাজে সকাল পৌনে নয়টা। খিলগাঁও পুলিস ফাঁড়ীর কাছে যে ফ্লাইওভারের গোঁড়া ওখানে এসে দাঁড়ালাম। অনেকক্ষণের অপেক্ষা, চেষ্টাচরিত আর চালকদের আকাশচুম্বী ভাড়ার যুগপৎ মিথস্ক্রিয়ার পর ৯টার দিকে হাঁটা ধরলাম। কানে হেডসেট লাগিয়ে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে গাওয়া “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটার আধুনিক বাদ্যযন্ত্রময় সংস্করণ শুনতে শুনতে শুরু হল আমার হন্টনযাত্রা।
বিরোধী দলের “চলো চলো ঢাকা চলো” আর সরকারী দলের “চলো চলো হাজতে চলো” কর্মসূচির মধ্যে আমার নিরপেক্ষ সূচি “চলো চলো হেঁটে চলো”
হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা অত্যন্ত বিরক্তিকর। একটু পর পর হাত বদল করতে হয়। কাঁধে ব্যাগ হলে কোন চিন্তা ছিল না। আল্লাহ্ তায়ালার রহমতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আমি শত শত মাইল হেঁটে গেছি; কিচ্ছু হয়নি। কিন্তু হাতে ব্যাগ নিয়ে হাঁটলে নিজেরে চাকুরীজীবী আঙ্কেলদের মতো বেচারা বেচারা লাগে।
খিলগাঁও রেইলগেট, বাসাবো ও বৌদ্ধমন্দিরের তীরে তীরে কর্মপাগল মানুষদের করুণ মুখে গাড়ির ভিতর এক টুকরো সিটের জন্য অধীর অপেক্ষা দেখতে দেখতে পথ চলছি। কিন্তু কিছু সরকারী স্টাফ বাস ছাড়া অন্য কোন বাসের দেখা মিললো না। আর এ সুযোগে রিক্সা, ম্যাক্সি ও বন্ধু বাইকের বন্ধুরা তিন থেকে চারগুণ ভাড়া চাচ্ছে। অত্যন্ত যৌক্তিক নাগরিক অধিকার! যেখানে রাষ্ট্র তাদের এরকম সুযোগ করে দেয় সেখানে তারা তো এরকম ভাড়া দাবি করতেই পারে। অনিয়মের দেশে অনিয়মই যে নিয়ম।
আমি ঠিক করেছিলাম টানা হাঁটতে থাকবো। কোথাও থামবো না। পানি খাওয়ার জন্যও না। বৌদ্ধমন্দির পার হবার কিছুক্ষণ পরে বা’পায়ের স্যান্ডেলে একটা ইটের কণা ঢুকলো। আমি হাঁটতে হাঁটতেই কণাটা বের করার নানাবিধ কসরত চালিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু শালার বাচ্চা কিছুতেই বের হচ্ছে না। একটু পর ডান পায়ের স্যান্ডেলেও একটা ইটের কণা ঢুকলো। ভারি সমস্যায় পড়লাম দেখছি। এরা তো আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে আটঘাট বেধে নেমেছে। আমিও নাছোড়বান্দা।
দরকার নেই তোদের বের হবার। পায়ের নিচে যতক্ষণ খুশি এডামটিসিং কর্। আমি হাঁটা থামাচ্ছি না। আমার কথা বুঝতে পেরে হয়তো বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের একটু আগে মুগদা টিটিপাড়া এলাকায় তারা আমাকে জ্বালাতন করা বন্ধ করে বিদায় নিলো।
স্টেডিয়াম পার হয়ে সোজা মানিকনগর, সায়েদাবাদের দিকে হাঁটতে লাগলাম।
আমার সাথের অনেকেই মতিঝিলে যাবার জন্য ডানে চলে গেলেন। ফলে একরকম ফাঁকা রাস্তায় আমার পথচলা আরম্ভ হল। এই রাস্তায় অন্য সময় কমবেশি গাড়ি চললেও আজ একেবারেই ছিল না। এমনকি রাস্তাটাকে বাপ-দাদার নিজস্ব সম্পত্তি মনে করে যারা তাদের বাসগুলোকে রাস্তার কোনায় দাঁড় করিয়ে রেখে অহেতুক যানজট তৈরি করতো তাদের সেই গাড়িগুলোও আজ উধাও। ০৯:৩৫ মিনিটে যখন সায়েদাবাদ পৌঁছলাম, দেখে চেনার উপায় নাই এটা সেই চিরপরিচিত আমাদের প্রিয় ভোগান্তিদানকারী বাস টার্মিনাল।
কোন বাস নাই, এমনকি বাসের কাউন্টারগুলোও বন্ধ। রাস্তার পাশে পুলিস কাক্কুরা বসে বসে রঙ চা খাচ্ছেন আর পরমানন্দে গপসপ করছেন। বাস ও হোটেলের কর্মচারীরা ফাঁকা রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে নেমে গেছেন। এদেশের মানুষের সহনশীলতা আর ভালোবাসা বাংলা সিনেমার স্বামীভক্তির মতোই অনন্য। বাংলা সিনেমায় যেমন নায়িকা তার নায়ক স্বামীর হাজার অত্যাচারেও নির্লজ্জের মতো ভক্তি করতে থাকে, পারলে স্বামীর গোদা পায়ে চিনি-সিরাপ মেখে চাঁটতে থাকে; তেমনি এদেশবাসীও তাদের ভুলতে পারে না যারা এদেশের মানুষের কোথায় ভালো, কোথায় আনন্দ, কোথায় একটু স্বাচ্ছন্দ্য হবে তা বুঝেও না বোঝার ভান করে।
এই যেমন গতকাল বাংলাদেশ এশিয়া কাপে পাইক্কাদের ধরায় দিতে পারতো। কিন্তু কি করলো। খেয়াল-খুশিমতো খেলে নিজেরাই ধরা খেয়ে গেলো। ওরা হয়তো ভুলে বসে থাকবে। কিন্তু আমরা কি করবো! বিশেষ করে আমি ভারত আর পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের হার একদম সহ্য করতে পারি না।
তারপর আসি আমাদের আপা-ম্যাডামদের কথায়। এক আপার কর্মকাণ্ডে হাসি (সুখের হাসি, স্বস্তির হাসি) না আসলেও আমাদের মুখটা সর্বদা হাসি হাসি করে রাখতে হয়; সাথে বলতে হয়, “জ্বি আপা, আমরা আপনার ডিজিটাল যুগে বেশ ভালোই আছি। শান্তিতে আছি। ” তেমনিভাবে এক ম্যাডামের লেদা (ল্যাদা) খেয়েও বলতে বাধ্য হই, “আহ! কি অমৃত। ” আমাদের মতো সর্বংসহা জাতির কারণেই হয়তো আল্লাহ্ তায়ালা আজাব-গজব তেমন একটা দেন না।
আফটারঅল আল্লাহ্ তো ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন।
সায়েদাবাদ জনপথ পার হয়ে যাত্রাবাড়ী অভিমুখে হেঁটে চলেছি। অমিতাভের কণ্ঠে গাওয়া কবিগুরুর অমর সঙ্গীত তখনো শুনে যাচ্ছি। এতক্ষণ শোনার পরেও একটুও খারাপ লাগছিলো না। বসন্তের ধুলিমাখা বাতাসে মিথ্যামিথ্যি প্রাণটা জুড়িয়ে নিচ্ছিলাম।
জীবনে প্রথমবারের মতো যাত্রাবাড়ীর রাস্তাটাকে মেয়ে দেখার মতো করে দুচোখ ভরে দেখলাম। আর দেখে মনে হল- ঢাকা শহর একটা কুষ্ঠ রোগী আর তার ত্বক হল এই এবড়ো থেবড়ো পথটা। হঠাৎ গাড়ি সারাইয়ের দোকানের সামনে একটা ছেলেকে দেখলাম লোহার ছোট পাইপের ভিতরে বসে ওর (পাইপের) গায়েই হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ও পাইপে বাড়ি মারছিলো আর কানে হেডসেট লাগানোর পরও দূর থেকেই আমার বুক কেঁপে উঠছিলো। ছেলেটা সহ্য করছে কিভাবে! হয়তো আমরা সর্বংসহা বলেই সে পারছে।
পৌনে দশটার দিকে একটুখানি ছায়া পেলাম। যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আজ বন্ধ। আজ ছুটি। সরকারী দলের ডাকা অঘোষিত হরতালের অঘোষিত সরকারী ছুটি। খালেদা ম্যাডাম যদি একটু বুদ্ধি করে রবিবারে ওনার কর্মসূচিটা দিতেন তাহলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরপরই অধিকাংশ ঢাকাবাসী “চলো চলো বাড়ি চলো” কর্মসূচি হাতে নিতে পারতো।
যাই হোক আমি আমার “চলো চলো হেঁটে চলো” কর্মসূচি এক মুহূর্তের জন্যও থামালাম না। দিক বদলে এখন আমি ঢাকা-মাওয়া সড়কে। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে না গেলেও গলা শুকিয়ে সাহারা (আমাদের সাহারা আপা না কিন্তু, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি) হয়ে গিয়েছিলো। পথে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলো না বা দেখলাম না। বাকি পথ কেবল ধুলাবালি খেতে খেতে আর নাড়ি উল্টানো দুর্গন্ধ শুকতে শুকতে অতিক্রম করা।
১০:১০ মিনিটে বন্ধুর জুরাইনের বাসায় জংলী কায়দায় কষাঘাত করার মধ্য দিয়ে শেষ হল আমার একটানা হাঁটার স্বঘোষিত কর্মসূচি। ভালোই কাটলো সরকারী দলের আহূত আধাবেলা হরতালের সকাল বেলাটি।
লিখাটা মনের দুঃখে দিলাম। আমি আমার জন্মভূমিকে অনেক ভালোবাসি। এটা আমাদের একাত্তরের "সোনার বাংলা", যথেচ্ছভাবে ব্যবহৃত কোন রাজনৈতিক "সোনার বাংলা" না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।