ঃ “ম্যাডাম, আপনি একা যেতে পারবেন তো?” লাবনী ম্যাডাম এগিয়ে এলেন। “ থাকেন না ম্যাডাম, আর অল্প একটু সময়ের ব্যাপারই তো! তারপর না হয় সবাই একসাথেই ফিরব?”
লাবনী, রিয়া আর প্রিয়ন্তী তিনজনে শপিং-এ এসেছিল। টুকটাক জিনিস কিনবে বলে। অথচ এখন পর্যন্ত কারো ফেরার নাম নাই। রিয়ার একটা গুরুত্বপুর্ণ কাজের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সে ফিরে যেতে চাইছে।
ঃ “না, না আমি পারব” জানাল রিয়া। বলেই হাতের ব্যাগ দুটি গুছিয়ে নিয়ে বাইরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।
হঠাতই কারেন্ট চলে যায়। কিছু দোকানে সোলার চালিত লাইট জ্বলছে। কোন কোন দোকানে টিম টিম করে জ্বালানো চার্জারের জন্যে দোকানময় আলো আঁধারি রহস্যময়ী ঘূর্ণিপাক খেলে যাচ্ছে সারি সারি দাঁড়ানো পুতুলগুলির আগে পিছে।
নয়টাও বাজেনাই এখনই মার্কেটটা প্রায় ফাঁকা। লোকজন নাই বললেই চলে। দু একজন কাস্টমার এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। কোন কোন দোকানী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে। কসমেটিক্সের দোকানের পাশ দিয়ে মোড় ঘুরতেই কারো সাথে ধাক্কা খেল রিয়া।
নিজেকে সামলে নিয়ে পিছন ফিরে কাউকেই দেখতে পেলনা সে। হয়ত পাশের মোড়টায় ঢুকে গেছে। এদিকে কোন দোকান না থাকায় আঁধারটা আরো গাঢ় হয়ে এসেছে। পা টিপে টিপে এগুচ্ছে রিয়া। এই এলাকায় কারেন্ট চলে গেলে দুই তিন ঘন্টার আগে কখনই তা আসেনা।
রিয়ার কাছে সবকিছুই বিশ্রী লাগছে। গা ঘিন ঘিন করছে। রুমে ফিরেই গা ধুয়ে ফেলতে হবে আজ। বদ্ধ জায়গার গুমোটভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে দ্রুত পা চালালো সে। এদের সাথে কেন যে ঘুরতে এল! নিজের উপরে নিজেরই চরমও বিরক্ত লাগছে এখন তার।
।
মাত্র পনেরদিন হল গফরগাঁও সরকারি কলেজে জয়েন করেছে সে। মফস্বল এলাকা গফরগাঁও। কলেজ তার খুব পছন্দ হয়েছে। ঢাকার শহরের মত গাড়িঘোড়ার যানজট নাই, নাই মানুষের হুড়োহুড়ি, ব্যস্ততা।
স্টেশন থেকে মাত্র মিনিট দশেক পথের দূরত্বে কলেজটা দাঁড়িয়ে আছে। ব্রহ্মপুত্রের কোলঘেঁষে একটা রাস্তা গিয়ে মিলেছে কলেজের প্রান্তে। তারপরও যে শোনে সেই আঁতকে ওঠে।
বলে ওঠে, ওরে বাবা গফরগাঁওয়ে যাও? ওটাতো ডাকাতের দেশ। দিনদুপুরে মানুষ জিম্মি করে ওখানে ডাকাতি চলে।
শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। তারপর যতদূর পেরেছে সে খোঁজ নিয়েছে। নাহ, এসব সব পুরোনো ইতিহাস। সেরকম কোন ঘটনা এখন আর ঘটেনা।
একসময় দূর্ধর্ষ সব ডাকাতদের আস্তানা ছিল এখানে।
তাদের ভয়ে কম্পিত থাকত গফরগাঁওয়ের মানুষ। মুহুর্তে মুহুর্তে খুনে রক্তে রঞ্জিত হত এ তল্লাটের ভূমি। তারপর ব্রিটিশরা চলে যাবার আগে সবকটা ডাকাতকে ধরে একযোগে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। লাশগুলো সব ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তবে একটা সমস্যা রয়েই গেছে।
আজও নাকি সেই ডাকাতদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়নাই গফরগাঁওয়ের বাতাস। কখনো কখনো ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে দাঁড়ালে ্ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো ডাকাতদের করুণ চিৎকার শোনা যায়। তা শোনা যাকগে। কোন মৃত মানুষের সাথে রিয়ার কোন বিরোধ নাই। তারমতে দোপায়া জাতির চেয়ে মৃত আত্মারা অনেক ভালো।
তারা অন্তত সামনে বন্ধুর মত ভদ্রতার মুখোশ পড়ে পিছন থেকে আক্রমণ করেনা। ।
মার্কেটের বিশাল চত্বরটা পেরিয়ে এসেও মহা বিপত্তিতে পড়ল সে। একটা রিক্সাও নাই। কি করবে সে এখন? হেঁটেই কি চলে যাবে? নাকি কলিগদের কাছে ফিরে যাবে? আসার সময়তো তিনজনে হাঁটতে হাঁটতেই চলে এসেছিল।
নাহ! বেশ ভাল অন্ধকার। তাছাড়া মফস্বলের এই নিরিবিলি রাস্তায় একা একা হাঁটাটাও ঠিক হবেনা। দাঁড়িয়ে রইল রিয়া। যদি একটা রিক্সা পাওয়া যায়!
জায়গাটা হঠাত করেই এমন থমথমে লাগছে কেন? ব্রহ্মপুত্র থেকে উঠে আসা বাতাস মার্কেট চত্বরে বাঁধা পড়েছে যেন। শাঁ শাঁ শব্দে বাড়ি খাচ্ছে এ দেয়ালে ও দেয়ালে।
পাশের টম দোকানটায় কেরোসিনের কুপিটা যেন কোন অশনি সঙ্কেত শুনতে পাচ্ছে। একটু পর পর সে তির তির করে কেঁপে উঠছে। তার সামনের ঝুলন্ত গ্যাস লাইটারটার কম্পমান প্রতিচ্ছবি মার্কেটের দেয়ালে কাটা মুন্ডের মত দুলছে। দুজন খদ্দের সারাদিনের ক্লান্তি শেষে দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে ঝিম মেরে বসে আছে। চারিদিকে জুড়ে কেবল শুনশান নীরবতা।
দোকানির হাতের চায়ের কাপ আর চামচের টুংটাং শব্দটাই কেবল থেকে থেকে মন্দিরের ঘন্টির মত আওয়াজ তুলে নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ।
এরকম চুপচাপ কেন এলাকাটা? নাকি সাধারণত এরকমই হয় মফস্বলের রাতের চিত্র। অবশ্য এখানে আসার পর আজই প্রথম রাতের বেলায় বের হয়েছে সে। তাও কলিগদের পীড়াপিড়িতে।
হঠাত অস্বস্তিতে গা শিউরে ওঠে। তার কি ভয় লাগছে?
নাহ!
তাহলে?
আজ সারাদিন কলজে প্র্যাকটিক্যালের কাজে অনেক খাটুনি গেছে। অবসাদগ্রস্ততার জন্যেই হয়ত এমন লাগছে। নিজেই নিজেই একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে সে। মনে মনে কোন একটা মজার গান খুঁজতে লাগল গাইবার জন্যে।
মাথা তুলে আকাশের চাঁদটার খোঁজ করল। আজ আকাশে কোন চাঁদ নেই সংগী হবার জন্যে। একটা রিক্সা এগিয়ে এসে থামল তার সামনে।
ঃযাবেন ভাই সরকারি কলেজ হোস্টেল?
-ঘাড় নেড়ে সায় দিল রিক্সাওয়ালা।
মাথায় ক্যাপ পড়া অল্পবয়সি একটা ছেলে।
রাতের বেলায় মাথায় ক্যাপ দেখে মনে মনে হেসে ফেলে রিয়া। রিক্সায় উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। জ্যামহীন রাস্তা হওয়ায় রিক্সা উড়ে চলছে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মত।
আজ সারাদিন মাকে একটা ফোন দেওয়া হয়নাই। ফোনটা বের করে মায়ের সাথে গল্প জুড়ে দেয় রিয়া।
“আফা রাত বিরাতে একলা একলা আর বাইর হইয়েন না। জায়গাডা বড় ভালা না। ”
কথা বলায় বাঁধা পেয়ে বিরক্ত হয়ে ছেলেটির দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে রিয়া। প্রচন্ড আতঙ্কে তার হৃদপিন্ডটা বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে পড়ে। মোবাইলের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পায়, ওপাশের গাঢ় অন্ধকারের মাঝে একটা কাটা মুন্ডু পেন্ডুলামের মত দুলছে।
চলবে……………। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।