অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে গতকাল ডেইলি স্টার’এ দেখলাম তিতাস গ্যাসের মজুদ বেড়েছে। শুনে ভাল লাগল। মনে পড়ল ছোটবেলায় আমার এক পিসি (= ফুফু) পালা পার্বনে সপরিবারে আমাদের গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসত। তাদের বাড়ি ছিল সদরে। পিসি এবং আমার পিসতুত ভাইবোনের মুখে শহরের গল্প শুনতাম আর অবাক হতাম।
তাদের মুখে শুনতাম গ্যাসের চুলার কথা। তিতাস গ্যাস। শুনতাম তারা কীভাবে ম্যাচের কাঠির অপচয় রোধ করত। তাদের এই মিতব্যয়িতা আমার শিশুমনকে মুগ্ধ করত। বড় হয়ে সেই মিতব্যয়ী পিসিকে আর দেখি নি।
দেখা হলে নিশ্চয়ই তাদেরকে একটু অপব্যয়ী হবার জন্য অনুরোধ করতাম। যাই হোক। ডেইলি স্টার’এর খবরে ভাল লাগলেও এই ভাললাগা খুব বেশিদিন স্থায়ী হবার সম্ভাবনা কম। কারণ দেশের মোট গ্যাস চাহিদা আর সরবরাহের অসামঞ্জস্য এক গভীর উদ্বেগের বিষয়। আমি অবাক হই আমাদের নাগরিক অসচেতনতার মাত্রা দেখে।
অবশ্য চারদিকে অবাক হওয়ার উপাদান এতই ক্রমবর্ধমান যে দিনে দিনে অবাক হবার বিষয়টি একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদটির অপচয় রোধ করার ন্যূনতম মানসিকতা আমি কারো মধ্যে দেখি নি। জনসচেতনতার বিষয়ে আমরা বরাবরই পিছিয়ে এবং নিঃসন্দেহে এতে গৌরবের কিছু নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে আরো সক্রিয় ভূমিকা আশা করা কি অন্যায়? (বর্তমান সরকার বা কোন নির্দিষ্ট সরকার বলে কথা নয়)
বাংলাদেশের মজুদ গ্যাস আয়তন নিয়ে মতভেদ রয়েছে। পেট্রোবাংলার ২০১০ সালের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী তখন পর্যন্ত ২৩টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।
প্রাথমিকভাবে (Gas Initially in Place - GIIP) এই গ্যাসের পরিমাণ ২৮.৮৫৬৭ tcf (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) ধরা হয় যা থেকে প্রমাণিত উত্তোলনযোগ্য পরিমাণ (P1) হিসেব করা হয় ১৫.০৩৭ টিসিএফ। জুন ২০১০ পর্যন্ত উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ ৮.৫৪৮ টিসিএফ; অর্থাৎ আমরা ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি গ্যাস খরচ করে ফেলেছি এবং আর মাত্র ৬.৪৮৯ টিসিএফ উত্তোলনযোগ্য গ্যাস অবশিষ্ট আছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে আমাদের ১৭টি গ্যাসক্ষেত্রের ১০০টি কূপের মধ্যে বর্তমানে (২০১০) ৭৯টি থেকে উৎপাদন হয়। এ অবস্থা অব্যহত থাকলে ২০-২৫ বছরের মধ্যে আমাদের আর কোন গ্যাস থাকবে না।
বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের একটি ছোট্ট খসড়া
যাত্রা শুরুর কথা
এই অঞ্চলে তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ উনিশ শতকের শেষদিকে শুরু হয়।
এই লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য শুধুমাত্র গ্যাসের কথাতেই আলোচনা সীমিত রাখছি। প্রথমে আসামের ডিগবয় নামক স্থানে তেল আবিষ্কারের ১৮ বছর পর ১৯০৮ সালে Indian Petroleum Prospecting Company সীতাকুণ্ডে তেল এবং গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য প্রথমবারের মত গুরুত্বের সাথে পদক্ষেপ নেয়। ১৯২৩ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে Burmah Oil Company পাথারিয়ায় দুইটি অগভীর কূপ খনন করে। তেল থাকার প্রমাণ সত্বেও কূপ দুইটি পরিত্যাক্ত হয়। মোট ৬টি অনুসন্ধানী কূপ খনন করা হয় যাদের মধ্যে গভীরতম কূপটি ছিল ১,০৪৭ মিটার গভীর।
কিন্তু এই অনুসন্ধান কোন তেল বা গ্যাসের সন্ধান দিতে পারেনি। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে অনুসন্ধানকাজ ব্যহত হয়।
মধ্যপর্বঃ ১৯৪৭-১৯৭১
১৯৪৮ সালে Pakistan Petroleum Act এর ঘোষণা এই অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করে। পঞ্চাশের দশকে মার্কিন কোম্পানি The Standard Vacuum Oil Company (STANVAC), Pakistan Petroleum Ltd (PPL), Burmah Oil Company এবং Pakistan Shell Oil Company (PSOC) এ অঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে এবং এই খোঁজ ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত চলে। STANVAC তিনটি কূপ খনন করেও সাফল্যের মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়।
PPL ছয়টি কূপ খনন করে এবং প্রথমবারের মত হরিপুরে ১৯৫৫ সালে গ্যাসের সন্ধান পায়। এরপর তারা ১৯৫৯ সালে ছাতকেও গ্যাস অনুসন্ধানে সফলতা পায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে PSOC পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র (তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা এবং বাখরাবাদ) আবিষ্কার করে সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখায়।
এ সময় ১৯৬১ সালে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে Oil Gas Development Corporation (OGDC) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি জালদি এবং সেমুতাং এ gravity, magnetic এবং seismic টাইপের geological এবং geophysical সমীক্ষা চালায় এবং সেমুতাং এ ১৯৭০ সালে গ্যাসের সন্ধান পায়।
১৯৭১-১৯৭৯
১৯৭৪ সালে Bangladesh Patroleum Act পাশ হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। উপকূলীয় অঞ্চল ছয়টি ব্লকে ভাগ করা হয়। এই ব্লকগুলো Ashland, ARCO, BODC (Japex), Union Oil, Candian Superior Oil এবং Ina Naftaplin কোম্পানিগুলোকে উৎপাদনের অংশীদারীত্বের চুক্তিতে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই কোম্পানিগুলো প্রায় ৩২,০০০ কিলোমিটারব্যাপী gravity, magnetic এবং seismic সমীক্ষা চালিয়ে সাতটি কূপ খনন করে। এদের মধ্যে শুধুমাত্র Union Oil ১৯৭৭ সালে কুতুবদিয়ায় গ্যাসের সন্ধান পায়।
১৯৮০ পরবর্তী চিত্র
আশির দশকে পেট্রোবাংলা ব্যাপকভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে ১২টি কূপ খনন করে এবং ৭টি গ্যাসক্ষেত্র (বেগমগঞ্জ, বেয়ানিবাজার, ফেনী, ফেঞ্চুগঞ্জ, কামতা, মরিচাকান্দি [মেঘনা], এবং বেলাব [নরসিংদি]) আবিষ্কার করে। ইতোমধ্যে এই পথযাত্রার একটি মাইলস্টোন অর্জিত হয় ১৯৮৬ সালে সিলেটে প্রথম বাণিজ্যিক তৈল ক্ষেত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। ১৯৮৯ সালে বাপেক্স প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে খনন কাজের একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বাপেক্স পেট্রোবাংলার হয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তিনটি কূপ খনন করে এবং শাহবাজপুর ও সালদানদীতে গ্যাসের সন্ধান পায়। ১৯৮১ সালের পর Shell Oil Company (Shell) পরপর কয়েকটি ব্যর্থ অভিযান চালায়।
আশির দশকের শেষের দিকে জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।
১৯৯৬ সালে National Energy Policy 1996 প্রণয়ন এবং Production Sharing Contract (PSC) এর অনুমোদন এর পর দেশের মোট ভৌগোলিক অঞ্চলকে নতুন করে ২৩টি ব্লকে ভাগ করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের নতুন অধ্যায় এর সূচনা ঘটে। প্রাথমিক পর্যারে পিএসসি’র আওতায় চারটি কোম্পানিকে আটটি ব্লক দেওয়া হয়। এই ব্লকগুলোতে ১১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এই ক্ষেত্রগুলো হল মৌলভীবাজার, সাঙ্গু এবং বিবিয়ানা।
এরপর থেকে এই অনুসন্ধান এক নতুন গতিতে চলে আসছে।
এই অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ এক শতাব্দী ধরে চললেও এই অনুসন্ধান দ্রুতি-ঘন নয়। এ পর্যন্ত (২০১০) খননকৃত মাত্র ৬৯টি অনুসন্ধান কূপের মধ্যে ২৫টি ক্ষেত্র পাওয়া গেছে যাদের গ্যাসের আকার ২৫ বিসিএফ থেকে ৪ টিসিএফ (GIIP) পর্যন্ত। এই পরিসংখ্যান যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নির্দেশ করে তা হল এই যে, এখানে অত্যন্ত কম অনুসন্ধান চালিয়ে অত্যন্ত বেশি মাত্রায় সফলতা পাওয়া গেছে। এই সফলতার হার প্রতি তিনটি কূপে একটি।
দেখা গেল আমাদের কূপ খননের তুলনায় গ্যাস প্রাপ্তি অসাধারণরূপে বেশি। সুতরাং আমরা আশান্বিত হতে পারি ভবিষ্যতে আরো ব্যাপক গ্যাস প্রাপ্তি বিষয়ে। বিশেষ করে সমুদ্র অঞ্চলে যদি শেষ পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে আরো বিস্তৃত সম্ভাবনা তৈরি হবে। কিন্তু এই আশা আমাদের স্বভাবসুলভ অমিতব্যয়ী মনোভাবকে যেন চাঙ্গা করে না তোলে।
চিন্তাগোষ্ঠীগণ বলে থাকেন
গ্যাস সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন চিন্তাগোষ্ঠী বিভিন্ন মত দিয়ে থাকে।
কিছু সংগৃহীত সুপারিশ প্যারাফ্রেজ করার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস খাতের দক্ষ পরিচালনার জন্য কিছু মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ও বাজার সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সাধারণভাবে এর মধ্যে রয়েছে অধিকতর হারে বেসরকারি মূলধন বিনিয়োগ ও বেসরকারি খাতের প্রাধান্য বৃদ্ধি। সমন্বয় অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং এর উদ্দেশ্য নির্ধারণে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নেটওয়ার্ককে সাধারণ পরিবহণের (common carriers) আওতাধীন করা যেতে পারে।
মাশুল ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদক এবং স্বতন্ত্র শক্তি উৎপাদকগণ সরাসরিভাবে গ্রাহকদের সাথে দর কষাকষি করতে পারে। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রান্তিক ব্যবহারকারীগণ যেমন সার উৎপাদন কারখানা, গৃহস্থালি রান্না, ঘনিভূত গ্যাস চালিত যানবাহন প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগের জন্য মূলধন ভর্তুকি না দেওয়া যেতে পারে।
আমার ছোট্ট চিন্তা
গ্যাস প্রসঙ্গ আসলেই আমার ছোটবেলার পিসি’র কথা মনে হয়। তাদের মিতব্যয়িতার কথা মনে হয়- ম্যাচের কাঠির অপচয় রোধে মিতব্যয়িতা। আমি জানিনা অন্যান্য দেশে গৃহস্থালিতে গ্যাস ডিসট্রিবিউশনে মিটারের ব্যবহার আছে কিনা।
আমার মনে হয় গৃহস্থালিতে গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিটারের বাধ্যতামূলক ব্যবহার শুরু করা উচিত। রেস্টুরেন্টে বা ফ্যাকটরিগুলোতে গ্যাসের মিটার দেখেছি কিন্তু গৃহস্থালিতে কখনো এই মিটার দেখিনি। এই বিষয় নিয়ে জানার ইচ্ছা থেকে বাংলাদেশ গ্যাস আইন ২০১০ এ একটু চোখ বুলালাম। এখানে মিটার ব্যবহারের বিষয়টা ঠিক স্পষ্ট মনে হল না। মিটারে হস্তক্ষেপ করা দণ্ডণীয় বলা হয়েছে, কিন্তু মিটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক কিনা তা চোখে পড়েনি।
এই আইন পড়ে আমার মনে হয়েছে গ্যাসের মিটার যদি বাধ্যতামূলক হয়ও, তা গৃহস্থালির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আমার মনে হয় গৃহস্থালিতে আমার পিসির মত মিতব্যয়ী লোকজনের আধিক্যের কারণে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি গ্যাস আমরা অপচয় করেছি এবং করে চলেছি। এখানে যেদিন থেকে গৃহস্থালিতে গ্যাসলাইন দেওয়া হয়েছে সেদিন থেকে যদি মিটার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হত এবং সেই অনুযায়ী মাসের বিল দিতে হত, তাহলে আমার তো মনে হয় গ্যাসের বর্তমান মজুদের দ্বিগুণেরও বেশি মজুদ থাকতে পারত। গৃহস্থালিতে বাধ্যতামূলক মিটার ব্যবস্থা চালু হোক। আর হ্যাঁ, এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চুলাটা জ্বালিয়ে রাখার দরকার নেই।
দোহাই
http://www.bgfcl.org.bd
http://www.petrobangla.org.bd
১৭ অক্টোবর, ২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।