আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

.......¤¤ পরীর গাঁ ¤ ¤.......

আমি মানুষের শারীরিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী নয় ,তবে চারিত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী । পড়ন্ত বিকেল । সন্ধ্যাটা যেন তাড়াতাড়িই ঘনিয়ে আসছে । চারিদিক অন্ধকারে ছেঁয়ে যাচ্ছে । অবশেষে দিনের শেষ ট্রেনটি এসে থামল পরীর গাঁ স্টেশনে ।

চারপাশ একবার চোখ বুলিয়ে ট্রেন থেকে নামল সাগর । ঠান্ডা হাওয়ায় ঝাপটা সামলিয়ে গায়ের চাদরটিকে আরো ভালভাবে জঁড়াল । গাছগাছালির মিষ্টি সুবাসে বাতাস খানিকটা ভারি । যাত্রী কক্ষ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে । যাত্রীকক্ষের সামনের বেঞ্চটিতে শরীর এলিয়ে দিল সাগর ।

তার পাশেই পুরনো জং ধরা একটি সাইনবোর্ড । তাতে লিখা "পরীর গাঁ স্টেশন" । পরীর গাঁ এর স্টেশন এটি । পরীর গাঁ নামটির পিছনে ছোট্ট কাহিণী রয়েছে । এই কাল্পনিক কাহিণীটি গ্রামের মানুষের মুখে মুখে আজো অক্ষত আছে ।

. . . . "অনেক বছর আগে পাশের গ্রামের এক রাখাল রোজ তার মনিবের গরু নিয়ে এই গ্রামে আসত । এই গ্রামটি ছিল তখন জনমানবহীন এক অরণ্য । রাখাল এখানে ছোট কুটির তৈরি করেছিল । এই কুটিরটিতে সে বিশ্রাম নিত । মাঝে মাঝে রাতও কাঁটিয়ে দিত ।

তেমনি এক রাতে সে এক গাছের গুঁড়ির উপর বসে বাঁজাচ্ছিল । সে বাঁশির করুণ সুর নিস্তব্দ রাতের বাতাস চিরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল । দূরের আকাশ থেকে তখন মাটিতে ঘুরতে নেমেছিল কিছু পরী । বাঁশির করুণ সুর শুনে এক পরী দল থেকে বেরিয়ে আসল । হঠাত্‍ রাখালের সামনে এসে দাঁড়াল সে পরী ।

চোখে আলোর ঝলকা লাগতেই চোখ মেলে তাকিয়ে বিষম খেল রাখাল । অসম্ভব রূপবতী ডানাওয়ালী যে মানুষ নয় তার বুঝতে দেরি হল না । সে অজ্ঞান হয়ে গেল । যখন জ্ঞান ফিরল ,দেখল পরীটি হাত ধরে পাশে বসে আছে । অবাক লাগল তার ,এখন বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছেনা তার ! সে থেকেই বন্ধুত্ব ।

এমন নির্জন রাতে তাদের প্রায়ই দেখা হত । রাখালের বাঁশির মধুর সুর শুনত । একদিন কাউকে কিছু না বলে রাখাল পালিয়ে আসে এই অরণ্যে । এখানে তারা ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করে । সে থেকেই গ্রামের নাম পরীর গাঁ ।

গ্রামের মানুষের ধারণা এই কারণেই এই গ্রামের মেয়েরা সুন্দরী হয় !! . . -"বাবা এসেছ ?" বৃদ্ধের কন্ঠে ঘোর ভাঙল সাগরের । - আসসালামুআলাকুম চাচা ,কেমন আছেন ? - ওয়ালাইকুম আসসালাম ,কত বড় হয়ে গেছ ! আমাকে চিনতে পেরছ তো ? - কেন চিনব না চাচা !বৃদ্ধ হাসলেন । এই সেই করিম চাচা ,যাকে নিয়ে ছোটবেলায় বন বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াত সাগর । বৃদ্ধ হয়ে গেছেন । মুখে অসংখ্য ভাঁজ পরে গেছে ।

খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন । - চল বাবা ,গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । - চলুন । স্টেশন থেকে বেরিয়ে গরুর গাড়িতে উঠে বসল সাগর । গরুর গাড়ি ভাঙা রাস্তার উপর দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে যাচ্ছে ।

পনের বছরে কত কিছুই না পাল্টে গেছে । চারপাশে তাকিয়ে বুঝল খানিক আগেই বৃষ্টি এসে সবকিছু ধুঁয়ে গেছে । মাটি ,গাছগাছালি ও বর্ষার ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে লাগছে । বর্ষায় গ্রামের প্রকৃতিটাই অদ্ভুত লাগে । বৃষ্টি যেন প্রকৃতিকে এক নেশার জালে মাতিয়ে গেছে ।

এই ভর সন্ধ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা সেই লাইনটি মনে পড়ে গেল - "বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা । " __________________________ রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ডায়েরি নিয়ে বসল সাগর । . ... "এখন রাত ৯টা । গ্রাম্য পরিবেশে এখন অনেক রাত । চারিদিকে নিকষ আঁধার ।

জানালা দিয়ে আসা রাতের ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা সারাদিনের ক্লান্তিকে যেন ভুলিয়ে দিচ্ছে । পনের বছরে বহু কিছু পাল্টে গেছে । তবুও কেন জানি মনে হয় ,পরীর গাঁর রূপ এখনো পরীর মতোই আছে । বর্ষা যেন সমস্ত গ্রামকে নতুন রূপ দিয়েছে । গ্রীষ্মের সকল ক্লান্তিকে যেন ধুঁয়ে দিয়ে দান করেছে স্নিগ্ধতা ।

আহ !প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি নামল আবার । বৃষ্টির ঝাপটা আসছে জানালা দিয়ে । সাথে ঠান্ডা হাওয়া । রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি অবচেতন মনে বাঁজছে. . . তুমি যদি দেখা না দাও কর এমন হেলা , কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা । " এতটুকু লিখে ডায়েরি বন্ধ করল সাগর ।

-"বাবা ,জানালা বন্ধ করে দিই ?" করিম চাচা পাশে এসে দাঁড়ালেন -জ্বি চাচা ,দিন্ । জানালা বন্ধ করতে মনে হয় খানিকটা কসরত করতে হয়েছে তাকে প্রচন্ড বেগে বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে । -আমি তোমার বিছানা গুছিয়ে দিয়েছি ,শুঁয়ে পর । আমি নিচে শুব । কোনো অসুবিধা হলে ডেকো ।

-ঠিক আছে । চাদর মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুঁয়ে পরল সাগর । হঠাত্‍ ঘুম ভেঙে গেল । কান্নার ক্ষীণ শব্দ আসছে বাইরে থেকে । মেয়েলী কান্নার শব্দ ।

কে কাঁদছে এত রাতে ! -চাচা ! চাচা ! ঘুমিয়েছেন ? -"জ্বি ,জ্বি বল বাবা !" হতচকিয়ে উঠে বসলেন । -কে কাঁদছে এত রাতে ? -কই ! -ঐ যে মেয়েলী কান্নার আওয়াজ ! -"ও ,পরী পাগলী কাঁদে । " খানিকটা দম নিলেন করিম চাচা । -পরী ? -"তোমার মনে নেই ? ছোটবেলায় একবায় যাকে গাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছিলে । " চাচা হাসলেন ।

মাথায় যেন বাজ পরল । পরী ! যাকে নিয়ে সারাদিন দুরন্তপনায় মেতে উঠত । মাঠে মাঠে ছুঁটে বেড়াত । বয়সে কয়েক বছর ছোট ছিল বলে মাঝে মাঝে চড় থাপ্পর দিয়ে শাসন করত । যখন মেয়টা কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরত খুব মজা পেত ।

কিন্তু আবাক লাগত কখনো নালিশ করেনি !শেষবার যখন গ্রামে এসেছিল পশ্চিমে বাগানে ছোট এক কামরাঙা গাছে উঠেছিল দু'জন । একটা পাকা কামরাঙা কে আগে নিতে পারে এমন এক ছেলেমানুষি খেলায় তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় । বেচারির এক হাত ভেঙে যায় । সেবার তাকে পিতার কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল । এরপর আর গ্রামে আসা হয়নি ।

স্কুল জীবন শেষ হল ,কলেজ জীবন এরপর মেডিকেল । ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করল অবশেষে । মাঝখানে ভুলেই গিয়েছিল শৈশবের এই স্মৃতিগুলো । উঠে বসল সাগর । -ও তো পাগল ছিলনা ।

এমন হলো কিভাবে ? -সে অনেক কথা ! -বলুন চাচা । আমি শুনব । করিম চাচা গলা খাকঁরি দিয়ে বলা শুরু করলেন । .......... -মেয়েটার জন্য পাশের গ্রাম থেকে একটা ভাল প্রস্তাব এসেছিল দেখে অল্প বয়েসেই ওর বিয়ে হয়ে যায় । কিছুদিন সুখেই ছিল ।

এক বছর পর ওর কোলে একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান ও আসে । হঠাত্‍ ওর স্বামী ব্যবসায় মার খায় । তখন সে পরীকে বাপের বাড়ি থেকে লাখ খানেক টাকা আনার জন্য জোর করতে লাগল । পরী জানে তার বাবার আর্থিক অবস্থা কেমন ! একটুকরো জমি যাতে চাষবাস করে খার ,আর একটুকরোতে মাথা গুঁজে থাকে । যখন পরী রাজি হত না ,খুব মারধোর করত ।

একদিন ঘর থেকে বের করে দেয় । আর তার কয়েক মাসের বাচ্চাকে ওরা রেখে দেয় । -তারপর ? -তারপর আর কি ? ও চলে আসে । কিছুদিন কথা বলেনি বোবার মত হয়েছিল । কিছুই বলেনি কি হয়েছিল ।

এরপর পুত্র শোকে পাগল হয়ে যায় । অনেক ঝাঁড়-ফুঁক করেছিল । কোনো লাভ হয়নি । -শহরে নিয়ে কোনো ডাক্তার দেখায়নি ? -কিভাবে ?নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ওদের । ওর বাবা জমিল মিয়া পরের বাড়িতে কামলা খাঁটে ।

-ওহ ! আচ্ছা চাচা আপনি ঘুমিয়ে পড়েন । আবার শুঁয়ে পরল সাগর । তন্দ্রাভাবটুকু আর নেই । খুব খারাপ লাগছে তার । পরীর জন্যে! ................................................................................................... খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেল সাগরের ।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব । উঠে বিছানায় বসল । ঘরে এসে ঢুকলেন করিম চাচা ,মুখে মৃদু হাসি । -উঠেছ বাবা ? -জ্বি চাচা । -যাও হাত মুখ ধুঁয়ে আস ।

টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছে । -আচ্ছা । নাশতা করে বেরিয়ে পড়ল সাগর । বাড়ির উঠোন পেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল । পাশের বাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় ছোটখাট জটলা দেখে দাঁড়াল ।

খানিকটা কাছে গিয়ে দেখল একটা মেয়েকে ঘিরেই এই জটলা । মেয়েটি অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে । লম্বা উস্কখুষ্ক চুল । পরনের শাড়িটা নানা জায়গায় ছিঁড়ে গেছে । বুঝতে বাকি রইল না যে এই সে পরী ! ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল ।

পরীর ঠিক সামনে গিয়ে অবাক হল সাগর । পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে । কে বলবে এ পাগল !ফরসা মুখ খানিকটা মলিন হয়ে গেছে । গালের উপর অশ্রুর গাঁঢ় দাগ পরেছে । তবুও যেন মায়ার এতটুকু কমতি নেই ।

চোখগুলো বড়ই শান্ত ,নিচে কালি পরে গেছে । কালো মণিটির দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই নেশা ধরে যায় । এ তো পরীই ! পরী ছোট একটা পুটলিপে কোলে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করছিল । কথাগুলো অস্পষ্ট তাই বুঝা গেল না । সাগরকে দেখে জটলার মধ্যে খানিকটা গুন্ঞ্জন উঠেছে ।

এক বৃদ্ধ এগিয়ে আসল । -কে তুমি বাবা ? -আমি সাগর । পাশের ওই বাড়িটা আমাদের । ঢাকা থাকি ,বেঁড়াতে এসেছি । -"ও তুমি বড় সাহেবের ছেলে ।

সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম । কত বড় হয়ে গেছ !" বৃদ্ধের মুখে স্মিত হাসি । -এস বাবা ,ঘরে এস । ঘরে যাওয়ায় ইচ্ছে ছিলনা । তবু অজানা কারণে সাড়া দিল ।

-"বস বাবা । " চেয়ার এগিয়ে দিল সাগরকে । বৃদ্ধ আরেকটি চেয়ার টেনে বসলেন । -তুমি এখন কি কর বাবা ? -এবার ডাক্তারি পাশ করলাম । -ভাল ! ভাল ! -চাচা যদি কিছু মনে না কর একটা প্রশ্ন করি ? -হ্যা অবশ্যই ।

-পরীর ব্যাপারে আমি গতকাল করিমচাচার থেকে শুনেছি । ওকে ডাক্তার দেখিয়েছেন কোনো ? বৃদ্ধের চেহারার পরিবর্তন সাগরের চোখ এড়াল না । হাসির রেখা মুহূর্তেয় যেন মিলিয়ে গেল । কম্পিত গলায় বলল ,"না বাবা,সে সামর্থ্য যে আমার নেই । -আর ওর ছেলেটি ? বৃদ্ধ এবার যেন খানিকটা রেগে গেলেন ।

মুখ কুঁচকে জবাব দিলন , -অমানুষটা দুধের বাচ্চাটাকে মা হারা করে রেখেছে । বলে কিনা ওর প্রতি আমাদের কোন দাবী নেই । -ওহ !আপনাকে কিছু কথা বলি চাচা । -"হ্যা ,বল বাবা । " বৃদ্ধ খানিকটা মুষড়ে পরেছেন ।

সাগর বলতে লাগল ,পরী আসলে ঠিক পাগল না । বৃদ্ধ বিস্ময়ের সাথে বললেন ,"মানে ?" -হ্যা ,ও পাগল না । যতটুকু বুঝলাম ও মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছে । ও সন্তান হারানোকে মেনে নিতে পারে নি । এখন ও ভাবে ওর সন্তান আজো ওর কাছেই আছে ।

তাই ও আপনমনেই বিড়বিড় করে । ওর সন্তানের সাথে কথা বলে । যখন ও বুঝতে পারে যে ওর সন্তান ওর কাছে নেই ও কাঁদে । আপনারা সবাই ভাবছেন ও পাগল । ওর সাথে ও এমনটাই আচরণ করছেন ।

ও তাতে ও আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে । -"তুমি সত্যি বলছ বাবা ?" বৃদ্ধের চোখে বিস্ময় । আবেগে নরম হয়ে এসেছে । মুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠেছে আর গাল বেঁয়ে কয়েকট ফোঁটা অশ্রু গঁড়াল । সাগরের হাত ধরে বলল ,"বাবা ,তুমি দেখ !আমার মাকে সারিয়ে তুলতে পার কিনা !!!!! সাগর আস্বস্তের স্বরে বলল ,"আপনি শান্ত হোন চাচা ।

আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব । আর হ্যা ,আমি ওকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাই । যাতে মানসিক চাপটা খানিক কমে । আমি বিকালে ওকে নিয়ে বেরোব । -আচ্ছা ।

-এখন আসি চাচা । ... -সে কি ,খালি মুখে !-না চাচা ,আজ না আরেকদিন । ........................................................................................................................................... পড়ন্ত বিকাল । আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে । পুকুরপাড়ে এসে বসল সাগর ,পাশে পরী ।

হাতে সেই ছোট পুটলি । তখনো সে আপনমনে বিড়বিড় করছিল পুটলিটার সাথে । সাগর এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল । কতই বা বয়স হয়েছে ওর !পরীর মত সুন্দর মুখটিতে হাসির রেখা ফুটার আগেই মিলিয়...ে গেল ! যে করেই হোক ,এই হাসি ফিরিয়ে দিবে । আপনমনেই প্রতিজ্ঞা করল সাগর !পরী হঠাত্‍ সাগরের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল ।

নারীর সহজাত লজ্জা । আবার আকাশ ভেঙে আচমকা বৃষ্টি নামল । পরী দৌড়ে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল । -"কি হল পরী ?চল বৃষ্টিতে ভিজি । " কাছে গিয়ে দাঁড়াল সাগর ।

-"না ,বাবুর ঠান্ডা লেগে যাবে । " চোখে আতঙ্ক । সাগর অবাক হল । মুখে শুধু বলল ,ঠিক আছে । সেদিন সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরল ওরা ।

রাতের বেলা সবে খাওয়া দাওয়া করে ডায়েরীটা খুলল সাগর । হঠাত্‍ কান্নার শব্দে সজাগ হল । পরী আবার কাঁদছে । তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েই পরীদের ঘরের দিকে ছুটল । হারিকেন জ্বলছে ছোট্ট ঘরটাতে ।

চারপাশে বাঁশের বেড়া আর উপরে ছন দিয়ে তৈরি চালা । ভাঙা একটা পাটিতে বসে কাঁদছে পরী । সাগর পাশে গিয়ে বসল । সাগরকে দেখে ও খানিকটা গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে । কান্না থামাল ।

-"পরী !" সাগর ডাকল । পরী খানিকটা নড়েচড়ে বসল । আবার ঢুঁকরে কেঁদে উঠল ,আর বলতে লাগল " ওরা আমার বাবুকে দিলনা । ওদের পায়ে পরেছি । লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে ।

তবু আমার দুধের বাচ্চাটাকে ওরা আমার কোল থেকে কেঁড়ে নিয়েছে । "... রাত বাঁড়ছে । পরীর কান্না রাতের বুক চিরে নীরব পরিবেশে আলোড়ন তুলে যেন বহুদূরে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে । প্রকৃতিও যেন তার শোকে কাঁদছে । আবার ঝমঝময়ি বৃষ্টি নামল ! ! এক মাস পর. . . . . পরী প্রকৃতিস্হ হয়েছে অনেকখানি ।

সাগরের প্রতিদিনের সান্নিধ্যতা ,প্রতি মুর্হূতের সহানুভূতি তাকে সুস্হ করে তুলেছে । তবু আজো সে কাঁদে তার সন্তানের জন্যে । সাগর চেষ্টা করে তাকে তার অতীত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে যা তাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে । এই একমাসের সান্নিধ্যতায় সাগরের মনে ও পরিবর্তন এসেছে । সে পরীকে অনুভব করছে প্রতি মুর্হুতে ।

পরীর কষ্ট ও তাকে স্পর্শ করছে । এ কি প্রেম !এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল সাগরের মনে । পরীদের বাড়ি থেকে খানিকটা পশ্চিমে গেলেই বাগান । নানারকম বৃক্ষরাজিতে ভরা । এর মধ্যে হরেক রকমের ফলের গাছ ।

এমনি একটি গাছের নিচে বসে আছে পরী । পাশে সাগর । পরীর শূন্য দৃষ্টি আকাশের দিকে । সাগর কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করল । তারপর পরীকে একটা গাছ দেখিয়ে বলল ,-ঐ গাছটির কথা তোমার মনে আছে ?পরী তাকলো ।

-কেন ? -ছোটবেলায় তোমাকে যেটা থেকে ধাক্কা দিয়েছিলাম !পরী হাসল । -"হ্যা মনে আছে । পাকা কামরাঙার জন্যে । দু'জনে হাসল । আবার আনমনা হয়ে গেল পরী ।

সাগর তা লক্ষ্য করে বলল ,-তোমার হাসিটা অনেক দামী । পরী অবাক হয়ে বলল ,কেন ? -কারণ ,দুর্লভ সব কিছুই মূল্যবান হয় । আর তোমার হাসিটাও দুর্লভ !পরী মুচকি হেসে আবার চুপ হয়ে গেল । -কি ভাবছ পরী ? -না কিছুনা । -তোমার বাবুর কথা ? এবার পরীর গাল বেঁয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ।

-"কাঁদবেনা একদম !" সাগরের কন্ঠে শাসন । -ওরা এমন করতে পারল ! -ভুলে যাও ওসব কালো স্মৃতি । কেন কষ্টকে লালন করছ ? -ভুলে যাব ?যাকে আমার রক্তে মাংসে রাতের পর রাত , দিনের পর দিন আমার মাঝে তিল তিল করে গড়েছি তাকে ভুলে যাব !" সাগর এ কথার জবাব দিল না । এর উত্তর ও তার কাছে নেই । -এখন দুঃখকে সঙ্গী করেই কি জীবন কাঁটিয়ে দিবে ? পরী অশ্রুমাখা চোখে সাগরের দিকে তাকাল ।

-কষ্ট কপালে নিয়েই যে জন্মেছি । এ আমার ভাগ্য । -কেন ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছ । হয়ত তোমার ছেলে একদিন ফিরে আসবে । যেদিন সে তার মাকে বুঝতে পারবে সেদিন তাকে আটকিয়ে রাখতে পারবে না ।

সাগর পরীর একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল । আর আশ্বাসের সুরে বলল , -"ভয় নেই । তোমার জীবনে সঙ্গী হয়ে থাকব সবসময় ,ছাঁয়ার মত । -"আমার সাথে জড়িয়ে কেন নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে চাও !" পরী কেঁপে উঠল । -না ,এতে আমার জীবনটাই শুধু সুন্দর হবে না ,আরেকটা জীবনেরও শুরু হবে নতুন করে ।

আকাশের এতক্ষণ জমে থাকা মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে নামল অঝরধাঁরায় । প্রকৃতির কষ্ট প্রকাশ পায় এই বৃষ্টিতে । প্রকৃতির সকল কষ্ট যেন আকাশে কালো মেঘ হয়ে জমা হয় । এরপর প্রকূতির কান্না হয়ে বৃষ্টি নামে । প্রকৃতি হালকা হয় ।

সতেশ হয়ে উঠে চারপাশ । আনন্দ হিল্লোল বয়ে যায় গাছ-গাছালিতে ,পাতায় পাতায় । সাগর উঠে খানিকটা সামনে গেল । আবার পিছন ফিরে পরীকে উদ্দেশ্য করে গাইতে লাগল , "এসো কর স্নান নবধারা জলে, এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে। " পরী স্মিত হেসে এগিয়ে আসল আর চোখ বন্ধ করে বরণ করে নিল বৃষ্টিকে ।

বর্ষার এই বৃষ্টির সাথে যেন তার কষ্টগুলো ধুঁয়ে যায় ! সকালটা র্নিমেঘ ছিল । গাছের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় মিষ্টি রোদ । ভেজা ঘাসে আর পাতায় তার আলো ঝিলমিল করছে । পরী আজ নতুন শাড়ি পরেছে । লম্বা চুলগুলোতে বেণি করেছে ।

কপালের কালো টিপটি তার সৌন্দর্যকে যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে । কাজলের হালকা ছাঁয়া পড়েছে মায়াবী চোখগুলোতে । ওরা দু'জন রেল লাইল ধরে হাঁটতে লাগল । সব কিছু পেছনে ফেলে ,সামনের দিকে । হয়ত ওরা খুঁজে নিবে তাদের নতুন স্টেশন ,যেখান থেকে ওরা শুরু করবে ওদের নতুন জীবনের যাত্রা ।

. . . . ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।