জীবনানন্দ দাশ আমাদের রূপসী বাংলার কবি। তিনি সুখ কামনা করেছেন, সুখে থাকতে চেয়েছেন সারা জীবন । তাই তিনি নাটোরের বনলতা সেনের কাছে সুখ কামনা করেছেন। বনলতা সেন কবিকে সুখ দিতে পেরেছিল। কবি কবিতার ভেতর তা উল্লেখও করেছেন।
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন
আমারে দু’দন্ড শান্তি দিেেয়ছিল নাটোরের বনলতা সেন।
সুখ নিয়ে কৃষ্ণকলির একটি গান বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা হল-
যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভুলে না মোরে
সুখে থেকো ভাল থেকো
মনে রেখ এই আমারে।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র শরিফ উদ্দিনের স্ট্যাটাসে সুখী তালিকার কথা প্রথম পড়লাম। শরিফ অত্যন্ত মেধাবী, ন¤্র-ভদ্র এবং চটপটে ছেলে। চট্টগ্রাম থাকতে তাকে আমার অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
সে হল আমার দেখা অসাধারণ শ্রেষ্ঠ একজন ভাল ছেলে। সে ভাল কথা বলতে পারে, গল্প করতে পারে। তার গল্প বলার ধরণ অসাধারণ! বিস্ময়কারও বটে। আমি কত রাতে যে তার কাছে গিয়ে গল্প শুনেছি, তাকে পরীক্ষার আগের দিন রাতে গিয়ে ডিস্টার্ব দিয়েছি তার হিসাব নেই। আমিও কোন জানি অদৃশ্য এক দুর্বার আকর্ষণ নিয়ে তার কাছে ছুটে যেতাম বারবার।
সে কখনও বিরক্ত হত না; বরং আমাকে খুব ভালভাবেই গ্রহণ করত। আমি শরিফের নিকট আরও অনেক কারণে ঋণী। বয়সে আমারছোট হলেও সে ছিল আমার বন্ধুর মত।
বলছিলাম সুখী এক রাজ্যের কথা। পাঠককূল আপনারাই ভাবুন আমি কোন দেশের কথা বলতে পারি।
এখন আমি আপনাদেরকে এমন একটি সুখী রাজ্যের কাহিনী বলবো। গল্প শোনাবো, যা শোনে আপনারা থ হয়ে যাবেন। আমি বলবো আমাদের বাংলাদেশের কথা যা কিনা এখন বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় ১১ তম স্থান অর্জন করেছে। জানতে পেরে আপনারা নিশ্চয় খুশী হয়েছেন। টাসকিও খেলেও খেতে পারেন।
আমাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তালিকায় এসেছে আমি লেখক মানুষ তাই লিখছি আমার এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই।
গত ১০ অক্টোবর। শরতের ঝকমকে এক বিকাল। সকালে ঝুম বৃষ্টি হয়ে পীচঢাল কালো রাজপথ ধুয়ে দিয়েছে।
সবুজ গাছপালা সব কিছুই বৃষ্টিতে ভিজে সজীব আর প্রাণবন্ত হয়ে আছে। ভাত খেয়ে সবেমাত্র অফিসে এসে বসেছি। পড়ছি প্রথম আলো। পড়তে পড়তে একটা কলামের উপর গিয়ে আমার চোখ পড়ল। অনেককে দেখেছি পত্রিকা পড়ার সময় শুধু শিরোণাটা পড়ে বাকীটা পড়ে না।
আমি তার ব্যতিক্রম প্রথম আলো পড়লে আনিসুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ফারুক ওয়াসিফ এর কলাম খোঁজ করি পড়ার জন্য। নয়া দিগন্ত পড়লে বদরুদ্দীন উমর, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, এবনে গোলাম সামাদ, শফিক রেহমান, রেজোয়ান সিদ্দিকীর কলাম পড়ার চেষ্টা করি। সমকাল পড়লে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলাম পড়ি। সেদিন প্রথম আলোতে সে কলামটি পড়লাম, তার লেখক ছিলেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসাবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের ’সুখী মানুষের দেশ’ নামে। লেখাটি না পড়ে পারলাম না।
আমিও সারা জীবন সুখ খুঁজে আসছিলাম এখনো খুঁজছি কিন্তু সুখ পাখিটির নাগাল এখনো পেলাম না। তাই লেখাটি চোখে পড়া মাত্রই এক পলকে পড়ে ফেললাম। লেখাটি পড়ে যা জানতে পারলাম তার একটা সারকথা আমার এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণ প্রতিষ্ঠান। ’নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের সুখী দেশের তালিকা করে আসছে।
২০১২ সালের তালিকায় ১৬১টি দেশকে তারা স্থান দিয়েছে। বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে সে তালিকার ১১ নম্বরে। কোস্টারিকা প্রথম স্থান অর্জন করে। দ্বিতীয় স্থান লাভ করে ভিয়েতনাম। পাকিস্তান ১৬ নম্বরে।
ভারত ৩২ নম্বরে। আফগানিস্তান ১০৯ নম্বরে। গবেষণা কমিটি হয়েছে, তালিকা করা হয়েছে, এরপর প্রকাশিত হয়েছে সবই ঠিক আছে কিন্তু আমার কাছে সবকিছ ুকেন জানি দুরুহ ঠেকে। কিভাবে আমাদের দেশটি তাদের বিচারে এতশত দেশকে ডিঙিয়ে ১১তম স্থান দখল করল তা আমার বুঝে আসে না। আমাদের দেশের এত সমস্যা সত্ত্বেও কি করে আমরা জায়গা করে নিলাম সুখী দেশের কাতারে তা আল্লাহ মালুম।
কে কে কাজ করেছিল এই গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানটিতে তারা কি আমাদের দেশের নাগরিক ছিল নাকি বিদেশী ছিল। কিভাবে কিসের ভিত্তিতে তারা আমাদের দেশকে এই ভূষণে ভূষিত করল তা কে বলবে। আমাদের দেশের এখনো এত সমস্যা! বন্যা- খরায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে উদ্বাস্তু হয়ে শহরমুখী হচ্ছে। এখনো আমাদের দেশে ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে খুন হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে গুম হচ্ছে শত শত নেতাকর্মী। গ্রামের কৃষক যে সকালে বের হয়ে দুপুর পর্যন্ত মাঠে কাজ করে এখনো অনেক সময় রাতে তাকে কখনো কখনো উপোস থাকতে হয়। এখনো আমার কৃষক ভাইয়েরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায়নি। নারীরা এখনো আমাদের সমাজে তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। আমার সুন্দরী বোনের মুখ ঝলসে দেয় মনুষ্যরূপী কোন জানোয়ার।
এখনো আমাদের দেশের রাস্তাগুলোতে বের হলে চোখে পড়ে ছোটবড় অনেক হাওর আর লেক। বর্ষাকালে রাস্তার খনা-খন্দের মধ্যে মাছও পাওয়া যায়। যানজটের কারণে ঢাকা শহরের মানুষদের জীবন যাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। লোডশেডিংয়ে নাকাল নগরবাসী। বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে কোটি কোটি টাকার অপচয়।
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির মচ্ছব। দুর্নীতির মালা গলায় দিয়ে আবুল হোসেন আর প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মশিউরের পদত্যাগ। কেউবা আবার কালো বিড়াল ধরতে নিজেই কালো বিড়ালের হাতে কাবু হয়ে যান। শেয়ার বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা উধাও। সর্বস্ব খুইয়ে গলায় দড়ি দিয়ে তিনজনের আত্মহত্যা।
নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা। দ্রব্যমূল্যের নাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতা এডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যাকারী খুনীকে প্রেসিডেন্টের কলমের খোঁচায় মাপ করে দেয়া। গামা হত্যা মামলার ফাঁসীর আসামীদেরকে মাফ করে দেয়া। এখনো আমাদের দেশে বাস করে বন খেকো ওসমানের মত বনমানুষরা।
বন কেটে উজাড় করে দেয়া হচ্ছে সর্বত্র। গাজীপুরের শালবনের জমি বেদখল হয়ে যাওয়া। বালু দস্যুদের কবলে নদী এবং পাহাড় বিপন্ন হওয়া।
লেখাটি পড়ে আমি একাধারে আশ্চর্য এবং পুলকিত দুই হয়েছি। কি করে আমরা সুখী দেশের তালিকায় ১১তম স্থান অর্জন করলাম।
এটা রীতিমত আমার কাছে টাসকি খাওয়ার মত বিষয় বটে। পাকিস্তান এত রাজনৈতিক অসহিষ্ণু হওয় সত্ত্বেও কি করে ১৬ নম্বর স্থান অধিকার করল। আমরা দেখেছি এইতো কিছুদিন আগে মালামা নামের নারী অধিকার বিষয়ে সোচ্চার একজন মেয়েকে বোমা মেরে মেরে কিভাবে রক্তাক্ত করা হয়েছিল তার করুণ দৃশ্য। সে এখন রক্তাক্ত দেহ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। আফগানিস্তানকে রাখা হয়েছে ১০৯ নম্বরে।
এটা কি করে সম্ভব যে যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটিদেশ যেদেশে এখনও মাটির নিচে পুতে রাখা বোমা ফেটে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে স্কুল ফেরত ছেলে-মেয়েদের ফুলের মত তরতাজা কচি শরীর। ভারতকে রাখা হয়েছে ৩২ নম্বরে যে দেশে এখনও কিংদাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। নারীদেরকে এখনও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানদেরকে হত্যা করা হচ্ছে প্রতি বছর। আর আমাদেরদেশের মানুষদের তো মনুষ্যজ্ঞান আর নৈতিকতার মান শূণ্য ডিগ্রিরও নিচে নেমে গিয়েছে।
মানুষ শুধু নামেই মানুষ আছে কাছে নেই। মানুষ সব যেন কুকুর, শ্রিগাল, হায়েনাতে পরিণত হয়েছে। মানুষের পরিচয় আর মানুষের মাঝে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সর্বত্রই শুধু ফটকাবাজি, চাপাবাজি, চুরি-চামারি আর দুর্নীতিতে ভরা পুরো দেশ। এত নিচে আমরা নেমে গিয়েছি যে, এর থেকে উত্তরণ ঘটবে কখন তা সঠিকভাবে বলা মুস্কিল; সুদূর পরাহত চিন্তাও বটে।
তবেযে করেইহোক আমাদেরকে প্রকৃত মনুুষ্যত্ত্বের সারিতে সামিল হতে হবে। বাঁচতেই যদি হয় প্রকৃত মানুষ হিসেবেই বাঁচাই উত্তম। কুকুরের মত শিয়ালের মত বেঁচে কি লাভ। এতে মনুষ্যত্ত্বের অপমান ছাড়া আর কিছুই হয় না। আর মানুষ হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার পর আমরা বলবো আমরা সুখী।
তখন গলা ফাটিয়ে আমরা বলতে পারবো আমরা মানুষ হয়েছি। তাই আমরা সুখী। সুখী আমাদের দেশের মানুষ। যেদিন আমাদের দেশের একটি মানুষও অভুক্ত থাকবে না, নারীরা প্রকৃত অধিকার ফিরে পাবে, শিশুরা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারবে, সামাজিক ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠিত হবেকেবলসে-দিনই বলবো আমরা সুখী। তা ছাড়া এসব তালিকা শুধু কাগজেই থাকবে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
আজকের মত ‘এক সুখী রাজ্যের কাহিনী’ বলা এখানেই শেষ করছি। বাংলাদেশের সকল মানুষ সুখী হোক। জয় হোক মানবতার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।