বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। ল্যাবডেকাসের পুত্র লেয়াস ছিলেন থিবীসের রাজা, লেয়াসের স্ত্রী রানী জোকাস্টা। বহুদিন ধরে সন্তান কামনা করছিলেন লেয়াস, সন্তান না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে একদিন গোপনে ডেলফির মন্দিরে গেলেন। দৈববাণী এলো, সন্তান না হওয়াকে অভিশাপ হিশেবে না দেখে আশীর্বাদ হিশেবে দেখা উচিৎ, কারণ সন্তান হলে একদিন সে লেয়াসকে খুন করে জোকাস্টাকে বিয়ে করবে। রাজা লেয়াস এই কথা গোপন রেখে জোকাস্টার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেন।
জোকাস্টা নানান চতুরালী করে একসময় লেয়াসকে প্রভাবিত করে গর্ভধারণ করলেন।
নয় মাস পর রানী জোকাস্টা পুত্র সন্তান জন্ম দিলেন, রাজা লেয়াস পুত্রকে জোকাস্টার কোল থেকে নিয়ে এক পর্বতের কোন পাদদেশে নির্জন স্থানে রেখে এলেন। শিশুটি য্যানো গড়াগড়ি দিয়ে সরে না যেতে পারে সেজন্য তার দুই পা লোহার বেড়ী দিয়ে আটকে দেয়া হলো। ভাগ্য শিশু পুত্রের সহায় ছিলো, পাশের রাজ্য করিন্থের এক মেষপালক শিশুকে দেখে বাসায় নিয়ে গেল। তার নাম রাখা হলো ঈডিপাস।
ঈডিপাস শব্দের অর্থ ফুলে যাওয়া পদযুগল। একসময় মেষপালক তাকে করিন্থে নিয়ে গেল। সেই সময় করিন্থের রাজা ছিলেন পলিবাস। রাজা পলিবাস ও রানী মেরোপীর কোন সন্তান ছিলো না, তাই তারা ঈডিপাসকে দত্তক নিয়ে নিজ সন্তানের মতো লালনপালন করতে লাগলেন।
একদিন করিন্থের এক যুবক ঈডিপাসকে উপহাস করে বললো সে দেখতে তার পিতা-মাতার মতো নয়, তাকে দত্তক নেয়া হয়েছিলো।
ঈডিপাস রাজা পলিবাস ও রানী মেরোপীকে জিজ্ঞেস করলে তারা সব অস্বীকার করে। ঈডিপাস রাগ করে ডেলফির মন্দিরে দিয়ে তার সন্দেহের কথা বললো। দৈববাণীর মাধ্যমে সরাসরি কোন উত্তর না পেলেও তাকে জানানো হলো সে তার পিতাকে হত্যা করে নিজ মাতাকে বিয়ে করবে। ঈডিপাস মনে মনে ভেবেছিলো সে বুঝি পলিবাসকেই হত্যা করে মেরোপীকে বিয়ে করবে। হতাশ হয়ে ব্যথিত ঈডিপাস সেদিন আর করিন্থে ফিরলো না।
সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো করিন্থ থেকে বহুদূর চলে যাওয়ার। ডেলফির মন্দির থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে লাগলো। একসময় সে মন্দির থেকে কিছুদূরে কোসিস নামক এক স্থানের এক রাস্তার তে-মাথার মোরে এলো। সেই পথ দিয়ে অপরিচিত এক বৃদ্ধ রাজা তার পরিচারকবর্গ নিয়ে রথে করে যাচ্ছিলেন। রাজা ঈডিপাসকে নির্দেশ দিলেন পথ থেকে সরে দাড়াতে।
ঈডিপাস পথ থেকে না সরে দাড়িয়েই রইলো। রাজা রথচারীকে নির্দেশ দিলেন ওর উপর দিয়েই রথ চালনা করতে। রথ ঈডিপাসের পা মাড়িয়ে চলে গেল। ক্রোধে দিশেহারা ঈডিপাস সেই অপরিচিত রাজা ও তার পরিচারকদের হত্যা করলো। সেই রাজা ছিলেন লেয়াস।
এক অনুচর কোন মতে বেঁচে থিবীসে পালিয়ে গেলো। থিবীসে গিয়ে রানীকে জানালো পথে এক দস্যুদল তাদের আক্রমণ করেছে, তাতে রাজার মৃত্যু হয়েছে। ঈডিপাস ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলো না যে ডেলফির দৈববাণীর প্রথমার্ধ সে ইতিমধ্যেই কার্যকর করে ফেলেছে। সে তার পিতাকে হত্যা করবে এটা সত্যি হলো।
সেইসময় স্ফিংস নামক এক দানবীর অত্যাচারে থিবীসবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পরেছিলো।
স্ফিংসের দেহের উপরের অংশ ছিলো নারী, নিচের অংশ সিংহের মতো। পথে একা কাউকে পেলে স্ফিংস একটা করে ধাঁধা জিজ্ঞেস করতো। ধাঁধার উত্তর না পারলে তাকে হত্যা করা হতো। রাজা লেয়াসকে হত্যা করে ঈডিপাস থিবীসের দিকে যাচ্ছিলো। পথে একা পেয়ে স্ফিংস তাকে আটক করে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করে।
ধাঁধাটি ছিলো এইরকম, কোন প্রাণী সকালে চার পায়ে হাটে, দুপুরে দুই পায়ে হাটে আর বিকেলে তিন পায়ে হাটে। ঈডিপাস জবাব দিলেন সেই প্রাণী হচ্ছে মানুষ। মানুষ শৈশবে হামাগুড়ি দিয়ে চলে, যৌবনে দুই পায়ে হাটে, আর বার্ধক্যে দুই পা আর এক লাঠির সাহায্যে হাটে, এই হলো তিন পা। স্ফিংস তার জবাব শুনে পাহাড় থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পরে, কারণ তার নিয়তি ছিলো কেউ ধাঁধার উত্তর পারলে সে পাহাড় থেকে লাফিয়ে মৃত্যুবরণ করবে।
স্ফিংসের গুহায় ঈডিপাস।
স্ফিংসের অত্যাচার থেকে বেঁচে যাওয়া থিবীসের জনগণ ঈডিপাসকে রাজা হিশেবে বরণ করে নিলো। রাজা হিশেবে অধিষ্ঠিত হয়ে ঈডিপাস নিয়ম অনুযায়ী বিধবা রানী জোকাস্টাকে বিয়ে করলো। ঈডিপাস কিংবা জোকাস্টা, কেউই জানতে পারলো না তারা মাতা-পুত্র। এমনকি ঈডিপাস জানতো না যে সে যেই অপরিচিত বৃদ্ধ রাজাকে হত্যা করেছে সেই রাজারই রাজ্যের রাজা হয়েছে সে। ঈডিপাসের শাসনে থিবীসের জনগণও খুশি, আর জোকাস্টাকে রানী হিশেবে পেয়ে ঈডিপাসও খুশি।
এভাবে পনেরটি বছর কেটে গেলো। এরই মাঝে ঈডিপাস ও জোকাস্টার চারটি সন্তানও জন্মগ্রহণ করেছে। তার মধ্যে দুই পুত্র ইটিওক্লিস ও পলিনিসেস। দুই বোনের একজন এন্টিগোনে, অন্যজন ইসমেনি। এতোদিন পরেও ঈডিপাস ঘুণাক্ষরেও জানতে পারলো না তার মাতা-ই শয্যাসঙ্গী স্ত্রী হিশেবে তার গর্ভে সন্তানধারণ করে চলেছে।
ডেলফির দৈববাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো।
এদিকে করিন্থের রাজা পলিবাস নিহত হলেন। সংবাদবাহকের থেকে এই সংবাদ পেয়েও ঈডিপাস তার পালকপিতাকে শেষবারের মতোণ দেখতে গেলো না, কারণ তার ধারণা ছিলো সে রানী মেরোপীকে বিয়ে করে ফেলবে। এরপর সংবাদবাহক জানালেন যে ঈডিপাসকে সত্যিই পলিবাস ও মেরোপী দত্তক নিয়েছিলেন। এই কথা শুনে জোকাস্টার মনে সন্দেহ হতে লাগলো ঈডিপাস তার নিজেরই সন্তান কিনা।
ঈডিপাস নিজের জন্মপরিচয়ের খোঁজে বের হতে গেলে ভীত জোকাস্টা তাকে বাঁধা দিয়ে বললেন তার জন্মপরিচয় না জানাটাই তার জন্য মঙ্গলজনক হবে। এদিকে থিবীসে তখন দুর্ভিক্ষ ও মহামারী চলছে। জনগণ তখনো ঈডিপাসের দিকে তাকিয়ে। ঈডিপাস তাদের বললেন সে নিজেও তাদের মতো বেদনার্ত, রাজ্যকে বিপদমুক্ত করতে হলে যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে সে রাজী আছে। ঈডিপাস তার শ্যালক ক্রেয়নকে পাঠালো ডেলফির মন্দিরে করণীয় সম্পর্কে জানতে।
দৈববাণী এলো রাজ্যে এক ভয়াবহ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। ভূতপূর্ব রাজা লেয়াসের হত্যাকারী এই রাজ্যে নির্বিঘ্নে কালাতিপাত করছে। হত্যাকারীকে শাস্তি না দিলে রাজ্যের দুর্ভিক্ষ ও মহামারী কাটবে না।
ঈডিপাস সবাইকে নির্দেশ দিলেন হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে। হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারলে তাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে।
সে রাজ্যের অন্ধ জ্যোতিষী টেরেসিয়াসকে ডেকে লেয়াসের হত্যাকারী সম্পর্কে জানতে চাইলে টেরেসিয়াস কিছুক্ষণ গাইগুই করে জানালেন ঈডিপাসই লেয়াসের হত্যাকারী। এই কথা শুনে ঈডিপাস টেরেসিয়াসিকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন, সাথে ক্রেয়নকে ষড়যন্ত্রকারী ভেবে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করলেন।
তবে একসময় ঈডিপাস সত্য জানতে পারলেন। হতাশা, বেদনায় জর্জরিত ঈডিপাস নিজের চোখ উপড়ে ফেললো। আর রানী জোকাস্টা লজ্জায় ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুবরণ করলেন।
এরপর ঈডিপাস তার দুই কন্যা এন্টিগোনে ও ইসমেনিকে নিয়ে থিবীস থেকে চলে গেলেন। কয়েকবছর পর তাকে এথেন্সের কলোনাসে মৃতাবস্থায় দেখা যায়। থিবীসের জনগণ চাচ্ছিলো ঈডিপাসকে থিবীসে নিয়ে যেতে, তারা বিশ্বাস করতো তার দেহ থিবীসের ভাগ্য বদলে দেবে। কিন্তু কলোনাসে মৃত্যু হওয়ায় তাকে এথেন্সেই সমাহিত করা হয়।
কলোনাসে ঈডিপাস, তার দুই কন্যা এন্টিগোনে ও ইসমেনির সাথে।
ঈডিপাসের মৃত্যুর পর তার দুই সন্তান ইটিওক্লিস ও পলিনিসেস রাজ্য পরিচালনার ভার নেয়। তারা দুইজন এক বছর করে রাজ্য পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইটিওক্লিসের এক বছরের শাসনামল শেষে সে রাজ্যভার পলিনিসেসকে দিতে অস্বীকার করে। পলিনিসেস তখন তার নিজস্ব সেনাবাহিনী নিয়ে রাজ্য আক্রমণ করে বসে। যুদ্ধে পলিনিসেস ও ইটিওক্লিস দুইজনেরই মৃত্যু হয়।
এরপর রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করে রাজা লেয়াসের শ্যালক ক্রেয়ন। বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে ক্রেয়ন পলিনিসেসকে সমাহিত না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইটিওক্লিস ও পলিনিসেসের বোন এন্টিগোনে তাকে সমাহিত করতে চাইলে ক্রেয়ন তাকে এক গুহায় বন্দী করে রাখে। সেখানেই গলায় ফাঁস দিয়ে এন্টিগোনে মৃত্যুবরণ করে। সমাপ্তি ঘটে গ্রীক সাহিত্যের এক করুণ অধ্যায়ের।
ইউরুপিডিস বর্নিত মিথ অনুযায়ী ঈডিপাস নিজের চোখ নিজে উপড়ে ফেলেনি। তার এক ভৃত্য তাকে অন্ধ করে দিয়েছিলো। আবার হোমারের মহাকাব্য অনুযায়ী ঈডিপাস জোকাস্টার মৃত্যুর আগপর্যন্ত থিবীস শাসন করেছিলেন। সফোক্লেসের ট্র্যাজেডি মতে এন্টিগোনের মৃত্যু হলেও ইউরিপিডিসের মতে এন্টিগোনে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
ঈডিপাসের এই ঘটনার উপর ভিত্তি করে মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তার বিখ্যাত ঈডিপাস কমপ্লেক্স মতবাদপ্রকাশ করেন।
সূত্রঃ
“কিং ঈডিপাস” - সফোক্লেস,
উইকিপিডিয়া ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।