আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান - ত্রিধারা

মরণ আমার ভালো লাগে বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, বিশেষ করে কাব্যগীতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবিন্যস্ত প্রভাবময় ছায়া ও কাজী নজরুল ইসলামের বিপুল বৈচিত্রময় মহিমান্বিত উপস্থিতি সত্তেও, বাংলার নবজাগরনের তিনজন কবি স্বকীয়তা বজায় রেখে সগৌরবে বিরাজমান ছিলেন। তাঁরা হলেন, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাঁদের গান ও কাব্যগীতি নিয়েই আজকের এই আয়োজন। অতুলপ্রসাদ সেন (২০শে অক্টোবর, ১৮৭১- ২৬শে আগস্ট, ১৯৩৪) ছিলেন বাংলা কাব্য সঙ্গীতের একজন প্রধান গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত বিশারদও ছিলেন।

তাঁর রচিত গানগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তাঁর জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তাঁর গানের ভাষায় বাঙময় মূর্তি ধারণ করেছিল; "বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন"। অতুলপ্রসাদ সেনের পারিবারিক ভিটা, বাংলাদেশের দক্ষিণ বিক্রমপুরের মাগর-ফরিদপুর গ্রামে। তিনি ঢাকায় তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। অতি অল্পবয়সেই অতুলপ্রসাদ পিতৃহারা হন।

এরপর তাঁর পিতামহ কালীনারায়ণ গুপ্ত তাঁকে প্রতিপালন করেন। তাঁর কাছেই সংগীত ও ভক্তিমূলক গানে তাঁর হাতেখড়ি। ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। পরে লন্ডনে গিয়ে আইন শিক্ষা করেন। আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯৪ সালে তিনি বাংলায় ফিরে আসেন এবং রংপুর ও কলকাতায় অনুশীলন শুরু করেন।

পরবর্তীকালে তিনি লক্ষ্মৌ চলে যান এবং একসময় সেখানে অযোধ্যা বার অ্যাসোসিয়েশন ও অযোধ্যা বার কাউন্সিলের সভাপতি হন। লক্ষ্মৌতে তিনি যেখানে বাস করতেন তার জীবনকালেই তার নামে ঐ রাস্তার নামকরণ করা হয়। তার উপার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ তিনি স্থানীয় জনসাধারণের সেবায় ব্যয় করেন। তার বাড়ী এবং গ্রন্থস্বত্বও তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করে গেছেন। অতুলপ্রসাদ বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক।

তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেন। তাঁর রচিত বাংলা গজলের সংখ্যা ৬-৭টি। গীতিগুঞ্জ (১৯৩১) গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গান সংকলিত হয়। এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে (১৯৫৭) অনেকগুলি অপ্রকাশিত গান প্রকাশিত হয়। অতুলপ্রসাদের গানের সংখ্যা ২০৮।

অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি বিখ্যাত গান হল "মিছে তুই ভাবিস মন", "সবারে বাস রে ভালো", "বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে", "একা মোর গানের তরী", "কে আবার বাজায় বাঁশি", "ক্রন্দসী পথচারিণী" ইত্যাদি। তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ "উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী", "বলো বলো বলো সবে", "হও ধরমেতে ধীর"। তাঁর "মোদের গরব, মোদের আশা" গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। অতুলপ্রসাদের গানগুলি "দেবতা", "প্রকৃতি", "স্বদেশ", "মানব" ও "বিবিধ" নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন।

১৯৩৪ সালের ২৬শে আগস্ট, লক্ষ্মৌ-এ অমর কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ, অতুলপ্রসাদ সেন পরলোকগমন করেন। রজনীকান্ত সেন (জন্মঃ ২৬ জুলাই, ১৮৬৫ - মৃত্যুঃ ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০) প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক এই গীতিকারের গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। ঈশ্বরের আরাধনামূলক ও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান ছিলেন রজনীকান্ত।

গুরুপ্রসাদ চারশত বৈষ্ণব ব্রজবুলী কবিতাসঙ্কলনকে একত্রিত করে 'পদচিন্তামণিমালা' নামক কীর্তন গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়াও 'অভয়াবিহার' গীতি-কাব্যের রচয়িতা ছিলেন তিনি। রজনীকান্তের জন্মের সময় তিনি কটোয়ায় কর্মরত ছিলেন। নানা জায়গায় চাকুরী করে, গুরুপ্রসাদ সেন ১৮৭৫ সালে বরিশালের সাব-জজ পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন । এরপর পরিবারে কয়েকটি মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে, আকস্মিকভাবেই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারটি চরম আর্থিক সঙ্কটে নিপতিত হয়।

রজনীকান্ত শৈশবে খুবই দুষ্টপ্রকৃতির ও খেলাধূলা অন্তপ্রান হলেও সেই আর্থিক অনটনের মাঝেও তাঁর পড়াশোনা অব্যাহত থাকে। এসময় রজনীকান্ত, বোয়ালীয়া জিলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) ভর্তি হন। ১৮৮৩ সালে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এরফলে তিনি প্রতিমাসে দশ রূপি বৃত্তি পেতেন। পরবর্তীতে ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এফ.এ পাশ করে সিটি কলেজে ভর্তি হন।

সেখান থেকে ১৮৮৯ সালে বি.এ পাশ করে করেন। অতঃপর একই কলেজ থেকে ১৮৯১ সালে পরিবারকে সহায়তা করার জন্য আইন বিষয়ে বি.এল ডিগ্রী অর্জন করেন রজনীকান্ত সেন। রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। মুলত মায়ের উৎসাহেই শৈশবকাল থেকেই রজনীকান্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বাবলীল ভঙ্গীমায় বাংলা ও সংস্কৃত - উভয় ভাষায়ই কবিতা লিখতেন। তিনি তাঁর রচিত কবিতাগুলোকে গান আকারে রূপ দিতে শুরু করেন।

পরবর্তীতে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান পরিবেশন করতেন। ১৫ বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তাঁর অপূর্ব কবিত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে, আইন পেশার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষতঃ সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটকে অভিনয় ইত্যাদিতে গভীরভাবে মনোঃসংযোগ ঘটান। এরই প্রেক্ষাপটে রাজশাহীতে অবস্থানকালে তাঁর বন্ধু ও বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় এবং স্ত্রীর কাছ থেকে বেশ সক্রিয় সমর্থন পান। তবে রজনীকান্ত ওকালতি পেশায় গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ও সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

এ সময় থেকে মৃত্যুর প্রায় এক বৎসর পূর্ব পর্যন্ত রজনীকান্তের জীবন এক অখণ্ড আনন্দের খনি ছিল। তাঁর সঙ্গীত-প্রতিভাই তাঁকে অমর করে রেখেছে। সঙ্গীত-রচনা করা তাঁর পক্ষে এমনই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি অবহেলায় উপেক্ষায় অতি উৎকৃষ্ট সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। সঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পরে স্বদেশী আন্দোলন থেকে, এমনকি স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর গান হয়ে দাঁড়ায় অসীম প্রেরণার উৎস। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউনহলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

এতে বিলাতী পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ। ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষতঃ আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরী বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতে তৈরী কাপড়ের তুলনায় তেমন মসৃণ ও ভাল ছিল না। এর ফলে কিছুসংখ্যক ভারতবাসী খুশী হতে পারেননি। এই কিছুসংখ্যক ভারতীয়দেরকে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক ও অবিস্মরণীয় গান - "মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই; দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই৷" এই একটি গান রচনার ফলে রাজশাহীর পল্লী-কবি রজনীকান্ত সমগ্র বঙ্গের "কান্তকবি" রজনীকান্ত হয়ে ওঠেন ও তাঁর গানগুলোকে কান্তগীতি নামে অভিহিত করা হতে থাকে।

রাজশাহীতে অবস্থানকালে রজনীকান্ত সেন তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি দ্বিজেন্দ্রলালের কণ্ঠে হাসির গান শুনে হাসির গান রচনা শুরু করেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গান রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তিনি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখনীর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ফলে তিনিও তাঁর মতো করে সমগোত্রীয় লেখা লিখতে শুরু করেন। তাঁর লেখা গানের সংখ্যাও হয়ে দাঁড়ায় বিপুল, যার মধ্যে ছিল, দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান ও হাস্যরসের গান।

১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর প্রদাহজনিত কারণে সমস্যা ভোগ করতে থাকেন। আর্থিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করা সত্ত্বেও একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁকে জোরপূর্বক কলকাতায় প্রেরণ করেন পরিবারের সদস্যরা। একজন ব্রিটিশ ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ও তাঁর ল্যারিঙ্কস্‌ ক্যানসার হয়েছে বলে সনাক্ত করেন। অতঃপর তিনি কলকাতার বিভিন্ন প্রথিতযশা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁর অবস্থার আর উত্তরণ হয়নি, বরঞ্চ উত্তরোত্তর অবনতি হতে থাকে।

রজনীকান্তের শেষ দিনগুলো ছিল দুঃখকষ্টে পরিপূর্ণ। তিনি ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে লোকান্তরিত হন। রেখে যান কান্তকবির কালজয়ী কাব্যগীতি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯ জুলাই, ১৮৬৩ - ১৭ মে, ১৯১৩) ছিলেন বাংলার নবজাগরনের প্রধান কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা। তিনি ডি. এল. রায় নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।

তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন। এই গানগুলো দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর বিখ্যাত গান "ধনধান্যে পুষ্পে ভরা", "বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ" ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। তাঁর পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান।

তাঁর বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হত। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ. এ. পাস করেন কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে।

পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ. পাস করেন। এরপর কিছুদিন ছাপরা'র রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারীতে শিক্ষকতা করার পর, সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind। এই বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে সরকারি কর্মে নিযুক্ত হন দ্বিজেন্দ্রলাল।

কিন্তু তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারী দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। পরে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারী চাকরী হতে অবসর নেন।

বাল্যকালে তিনি একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত হয়েছিলেন। পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, গায়ক ও লেখক। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় ও হরেন্দ্রলাল রায় - দু'জনেই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল। এরকম একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন।

তিনি পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন, যা দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্নিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি। দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। তবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মূল অবদান সঙ্গীতে। তাঁর রচিত প্রায় ৫০০ গানের মধ্যে প্রধানত দুটি ভিন্ন ধারা বিদ্যমান - একটি ধারা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুসারী, অপর ধারাটিতে তিনি ইউরোপীয় ধ্রুপদি সঙ্গীতের "মুভমেন্টস" ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদ ও খেয়াল শাখা দুটি তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল; কিন্তু ঠুংরি গানের রীতি তিনি গ্রহণ করেননি ; বাউল, ভাটিয়ালি ইত্যাদি লোকসঙ্গীতের ধারাতেও তিনি গান রচনা করেননি।

তবে তাঁর কয়েকটি কীর্তনাঙ্গ গান রয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় যত্ন সহকারে গান শিখেছিলেন ; তাঁর কণ্ঠ ছিল সুমধুর। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজে ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট টপ্পা ও খেয়াল গায়ক। এই কারণে ছেলেবেলা থেকেই এক সাঙ্গীতিক পরিবেশে প্রতিপালিত হন দ্বিজেন্দ্রলাল; যা তাঁর পরবর্তী সঙ্গীত জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর কাব্যসঙ্গীতগুলিকে বিভিন্ন রাগের আদর্শে সুরারোপিত করেন।

যেমন- "নীল আকাশের অসীম ছেয়ে" (দেশ), "প্রতিমা দিয়ে কি পূজিব তোমারে" (জয়জয়ন্তী), "তোমারেই ভালবেসেছি আমি" (দরবারি কানাড়া), "মলয় আসিয়া কয়ে গেছে কানে" (নটমল্লার) ইত্যাদি। আবার তাঁর জনপ্রিয় স্বদেশী গানগুলিকেও তিনি বিভিন্ন রাগের ঠাটে নিবদ্ধ করেছিলেন। যেমন- "ধনধান্যপুষ্পভরা" (কেদারা), "যেদিন সুনীল জলধি হইতে" (ভূপ-কল্যাণ), "মেবার পাহাড় মেবার পাহাড়" (ইমনকল্যাণ) ইত্যাদি। আবার হাসির গানগুলিতে তিনি ইংরেজি, স্কটিশ ইত্যাদি গানের সুর সংযোজিত করেন। রঙ্গব্যঙ্গ বা বিদ্রুপাত্মক হওয়ায় এই গানগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বাংলা সঙ্গীতের হাসির গানের সম্ভারে দ্বিজেন্দ্রলালের অবদানই সর্বাধিক।

দ্বিজেন্দ্রলাল নিজে ছিলেন সুগায়ক। প্রথম জীবন থেকেই বিভিন্ন সভাসমিতিতে তিনি স্বরচিত গান শোনাতেন। পিতামহ কার্তিকেয়চন্দ্র ও পিতা দ্বিজেন্দ্রলালের ন্যায় পুত্র দিলীপকুমার রায়ও ছিলেন সুগায়ক ও সঙ্গীতস্রষ্টা। দ্বিজেন্দ্রলালের গান সাধারণত ভাবগম্ভীর; হাসির গান ছাড়া অন্য গানে তিনি কখনই চটুলতাকে আশ্রয় করেননি। বাংলা সঙ্গীতে সমবেত কণ্ঠে গীত বা সম্মেলক গান (কোরাস) প্রবর্তন করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।

এই ধারাটিই তাঁকে পরবর্তীকালে প্রভূত জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। এছাড়া, স্বদেশী আন্দোলনের সময় দ্বিজেন্দ্রলালের গান সমাজ মানসে বিশেষ উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। কালজয়ী ও কর্মময় জীবনের শেষে ১৯১৩ সালের ১৭ই মে কলকাতায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবনাবসান ঘটে ও তাঁর অমরত্ব নিশ্চিত হয়। ত্রিধারা - সিডি ১ - অতুলপ্রসাদ সেনের গান ০১ একা মোর গানের তরী - হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ০২ প্রকৃতির ঘোমটাখানি খোল - উমা বসু, হাসি ০৩ কে আবার বাজায় বাঁশি - ধীরেন দাস ০৪ হরি হে তুমি আমার - যূথিকা রায় ০৫ ওহে জগতকরন - রেনুকা দাশগুপ্ত ০৬ বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে - গায়ত্রী বসু ০৭ বঁধু এমন বাদলে তুমি - গীতা সেন ০৮ তব অন্তর এতো মন্থর - সাহানা দেবী ০৯ জল বলে চল - হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১০ সে ডাকে আমারে - সুচিত্রা মিত্র ১১ যখন তুমি গাওয়াও গান - কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ তুমি গাও তুমি গাও - মঞ্জু গুপ্ত ১৩ ওগো আমার নবীন সখী - নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৪ মুরলী কাঁদে রাধে রাধে বলে - সর্বাণী সেন ১৫ যদি দুখের লাগিয়া গড়েছ - ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ আর কতকাল থাকবো বসে - প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৭ বঁধু ক্ষণিকের দেখা - সুশীল চট্টোপাধ্যায় ১৮ চাঁদিনী রাতে কে গো আসিলে - বনানী ঘোষ ১৯ বল গো সজনী - কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় ২০ কি আর চাহিব বল - সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ২১ কত গান তো হল গাওয়া - সন্তোষ সেনগুপ্ত ত্রিধারা - সিডি ২ - রজনীকান্ত সেনের গান ০১ আমি অকৃতী অধম - দিলীপ কুমার রায় (ছোট) ০২ স্নেহ-বিহ্বল করুনা - যূথিকা রায় ০৩ আমায় সকল রকমে কাঙাল করিয়ে - পান্নালাল ভট্টাচার্য ০৪ আমি তো তোমারে চাইনি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ০৫ তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে - সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ০৬ আমি স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি - মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ০৭ ওরা চাহিতে জানে না দয়াময় - যূথিকা রায় ০৮ কেন বঞ্চিত হব চরনে - দিলীপ কুমার রায় (ছোট) ০৯ আহা কত অপরাধ - ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ১০ পাপ রসনারে হরি বল - নিশীথ সাধু ১১ কেউ নয়ন মুদে দেখে আলো - গীতা মাইতি ১২ মধুর সে মুখখানি - মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ১৩ তোমারই দেয়া প্রানে - নীলা মজুমদার ১৪ জাগাও পথিকে বনানী ঘোষ ১৫ কুটিল কুপথ ধরিয়া - অর্ঘ্য সেন ১৬ এই তপ্ত মলিন চিত - গীতা মাইতি ১৭ কত ভাবে বিরাজিছে - অনুপ ঘোষাল ১৮ শুনাও তোমার অমৃত বানী - কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় ১৯ কবে তৃষিত এ মরু - পান্নালাল ভট্টাচার্য ২০ তব চরন নিম্নে উতসবময় - ক্যালকাটা কয়্যার ত্রিধারা - সিডি ৩ - দিজেন্দ্রলাল রায়ের গান ০১ ধনধান্যে পুস্পভরা - দিলীপ কুমার রায় ও এম এস শুভুলক্ষ্মী ০২ ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে - কৃষ্ণচন্দ্র দে ০৩ আমি তোমার কাছে ভাসিয়া যাই - উমা বসু, হাসি ০৪ মলয় আসিয়া বলে গেছে কানে - হরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ০৫ পতিতোদ্বারিনী গঙ্গে - এম এস শুভুলক্ষ্মী ০৬ কে গান গেয়ে গেয়ে চলে যায় - দিলীপ কুমার রায় ০৭ নিখিল জগত সুন্দর সব - মঞ্জু গুপ্ত ০৮ তোমারেই ভালবেসেছি আমি - রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় ০৯ আজি বিমল নিদাঘ প্রভাতে - কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় ১০ ঘনতমসাবৃত অম্বর ধরণী - মান্না দে ১১ নীল আকাশের অসীম ছেয়ে - সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ১২ এ কি মধুর ছন্দ মধুর গন্ধ - সর্বাণী সেন ১৩ এসো প্রাণসখা এসো প্রানে - বন্দনা সিংহ ১৪ ভারত আমার ভারত আমার - ইন্দিরা শিল্পীগোষ্ঠী ১৫ আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাব - রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ এ কি শ্যামল সুষমা - অনুপ ঘোষাল ১৭ ওরে আমার সাধের বীণা - নীলা মজুমদার ১৮ (তোর) চরন ধরে আছি - শিখা বসু ১৯ বেলা বয়ে যায় - নুপুরছন্দা ঘোষ ২০ আজিকে তোমার চরনে - ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার কোয়ালিটি : ১২৮ কেবিপিএস ভিবিআর এমপি৩ ফাইল সাইজ : ৬২ + ৫৯ + ৬৯ মেগাবাইটস ডাউনলোড : ত্রিধারা - সিডি ১ - অতুলপ্রসাদ সেনের গান ত্রিধারা - সিডি ২ - রজনীকান্ত সেনের গান ত্রিধারা - সিডি ৩ - দিজেন্দ্রলাল রায়ের গান পূর্বশর্ত : ডাউনলোড করতে হলে ফোরশেয়ারড -এ অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। অত্যন্ত সহজেই এই অ্যাকাউন্ট করা যায়।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৫০ বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।