আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অন্য রকম অ্যাডভেঞ্চার

আমরা বসে আছি বাঙ্গালী নদীর উপর নতুন হওয়া ব্রিজ টির রেলিং এ। বগুড়া জেলার সোনাতলা থানা থেকে গাবতলী থানা হয়ে যে রাস্তা বগুড়া শহরে চলে গেছে তার মাঝামাঝিতে চড়পারা নামের ছোট্ট হাট থেকে মেইন রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে দুই কি। মি। পরেই বাঙ্গালী নদীর উপর প্রায় ১কি। মি।

লম্বা এ ব্রিজ। ব্রিজ টি উত্তর দক্ষিন বরাবর নদীর উপর। আর নদী টি পশ্চিম দিক থেকে এসে ব্রিজ এর নিচ দিয়ে পুব দিকে চার কি,মি, র মত গিয়ে দক্ষিনে বাক নিয়েছে। এটি যমুনার শাখা নদী হলেও স্বতন্ত্র ভাবে এটি বেশ কয়েকটি এলাকা কে সমৃদ্ধ করেছে। ব্রিজ এর দুই পাশের গ্রাম গুলো বেশ দূরে।

আমরা যখন বসে আছি তখন সূর্য হেলে আছে পশ্চিম আকাশে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মদ্ধেই টুক করে নদীর পারের গ্রামটির ওপাশে ডুবে যাবে। শীতের বিকেল খুবি তারাতারি শেষ হয়। আমাদের বেরোনোর কথা ছিল দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে। কিন্তু আমাদের মত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেকার ছেলেদের শুধু নিজের বাড়ি নয় আশেপাশের বাড়িরও কিছু বেগার খাটতে হয়।

মুখের উপর নাও বলা যায় না, এ বয়সে এমনিতেই অনেক দোষ থাকে। কিছু না করলেও দু চারটি দোষের খবর অনেকেই দায়িত্ব নিয়ে বাড়িতে দিয়ে যায়। যা হোক সেসব কাজ শেষ করে সবাই আসতে আসতে আছর এর আজান দিয়ে দিছে। আমাদের যাওয়ার কথা সারিয়াকান্দি। মোটামুটি আমরা সবাই ঢাকাতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখা পড়া করি।

আগে বাড়িতে আসলে মাঠেই সময় কাটত কিন্তু এখন কেন জানি খেলাধুলো উঠেই গেছে। তাই সবাই বেশ বোর হয়ে গেছলাম। এমনিতেই দূরে কোথাও যেতে চাইলেও পারছি না তাই একটা দিন কিছুক্ষনের জন্য সবাই একটু মুক্তির স্বাদ খুজছিলামা। বাহন বলতে সাথে আমাদের তিনটি মোটর সাইকেল। ঢাকায় আমাদের বয়সী অনেক ছেলেরই শখের হাল ফ্যাশনের না না বাইক আছে।

আমাদের শখ থাকলেও সেগুলো মনেই রাখতে হয়। শখের দাম লাখ টাকা দেয়ার মত আর্থিক অবস্থা আমাদের কারুরই নেই। আমার মোটর সাইকেল টি আমার বাবা র । হোন্ডা H100, লাল রঙ এর গাড়ি। এক সময় এর খুব কদর ছিল।

এখনও হয়ত আছে, কিন্তু আমাদের মত বয়সীরা একে খুব কমই পছন্দ করবে। তবে আমার এটাকে খুব ভালো লাগে। এটি লাইসেন্স করা মানিকগঞ্জ থেকে। বাবা আদর করে ডাকতেন “ মানিকগঞ্জের বড় মিয়া”। বাবা মারা যাওয়ার পর পৈত্রিক সূত্রে এখন এটা আমি পেয়েছি।

আগে বাবা কে অনেক কৈফিয়ত দিয়ে মোটর সাইকেল নিতে হত আর এখনো মা র কাছ থেকে নিতে হয়। আমার পিছনে বসেছে আমার বন্ধু মুন। আর একটি হল শুভ্রর। এটিও ওর বাবা র। কিছুদিন আগে ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়াতে উনি আর মোটর সাইকেল চালান না।

শুভ্রই মাঝে মাঝে অনেক বলেকয়ে বের করে। এটি bajaj discovery 125. বুঝতেই পারছেন বুরোটাইপ জিনিস। ওর পিছনে বসেছে শোভন। আর একটি হল রাব্বির। ওর বাবা বাহিরে থাকে, উনি হয়ত বুঝেছিলেন ছেলের একটা মোটর সাইকেল দরকার।

ওকে একটা পালসার ১৫০ কিনে দিয়েছেন। প্রথমে কেনার পর কয়েকবার জমের বাড়ির দরজা থেকে ঘুরে আসার পর এটির চাবিও এখন ওর চাচা র কাছে থাকে। চাইলেও সবসময় পায় না। ওর পিছনে বসেছে রিকো আর সোহাগ। আমরা এই সাত জন এই ব্রিজে বসে চিন্তা করছি, এই প্রায় হয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় সারিয়াকান্দি যমুনা নদীর বড় বাধ যেটা “প্রেম যমুনার” ঘাট নামে পরিচিত সেখানে যাওয়া ঠিক হবে কি না? নদীর পাশের এখানে ওখানে কুয়াশা গুলো সন্ধ্যাকে ত্বরান্বিত করছে।

এর মাঝেই আমার ফোন বেজে ওঠে। আমাদের বন্ধুর মত এক ছোট ভাই অলক ফোন করেছে। আমি ফোন ধরে বললাম, কি খবর ? ও আমাদের এখানে থাকার কথা শুনে জানালো ওআসছে। ও আজ অনেক কায়দা করে বাড়ি থেকে মোটর সাইকেল নিতে পেরেছে। আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে, আমরা হয়ত যাব না তুমি এস না।

কিন্তু তার আগেই ও ফোন কেটে দিয়েছে। সবাই কেমন যেন বিষন্য হয়ে যাচ্ছে, প্রায় হতে যাওয়া ভ্রমন না হলে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। তক্ষুনি মাথা থেকে সব বুড়ো চিন্তা ভাবনা ছেড়ে দিয়ে বললাম, ওকে আমরা যাব। রাব্বি সাথে সাথেই বলল ব্রিজ পেরিয়ে কিছুদুর গেলে বাধ পরবে। সেই বাধ ধরে খুব বেশি হলে এক ঘন্টা লাগবে পৌছতে।

আমরা আর কিছু না ভেবেই ওই রাস্তা টি বেছে নিলাম। এর মাঝে অলক এসে পৌঁছেছে। রাব্বির পিছন থেকে সোহাগ কে নামিয়ে অলক এর পিছনে দিলাম। এর পর শুরু হল আমাদের যাত্রা। গ্রামের মাঝ দিয়ে একেবেকে বাধের গোঁড়ার কাছে যেতেই মাগরিবের আজান দিল।

রাস্তা থেকে বাধ প্রায় ১৫ফুট উঁচু। তাও আবার খারার মত। রাব্বি রাস্তা চেনে তাই ওকে সামনে রাখা হয়েছে আর তার পর আমরা প্রায় একটু আগপিছ করে সাথে সাথেই চালাচ্ছি। রাব্বি সহজেই ঊঠে গেল বাধে আমি উঠব কি উঠব না করতে করতে গিয়ার কমিয়ে এক্সলেটর টেনে ধরলাম। কট কট আওয়াজ আরো বাড়িয়ে আমার বড় মিয়া উঠতে থাকে।

বাধের উপর উঠে এক দোকানের পাশে গিয়ে দাড়াই। সবাই আবার এক হয়ে আবার যাত্রা শুরু। কিছুদূর পর্যন্ত কাচা রাস্তা হলেও বেশ শক্ত মাটি। মোটর সাইকেল চালাতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। একটু পরেই শুরু হল বালি।

একে বারে বালির সাগর বলা যায়। নদী থেকে বালি তুলে বড় বড় ট্রাক্টরে করে বালি নিয়ে যেতে যেতে বাধের উপরের শক্ত মাটি উঠে গিয়ে বালি বেরিয়েছে। আর এই বালির মাঝে মাঝে কোথাও শক্ত মাটি দ্বিপের মত বেরিয়ে আছে। এগুলো খুবি বিপদজনক। আর বালির ভিতর মোটর সাইকেল চালানো যে কি কঠিন কাজ তা যারা চালিয়েছে তারাই জানে।

মাঝে মাঝেই চাকা স্লিপ করে । তাও এক চাকা করলে কথা ছিল, এক সাথে দুই চাকাই কখন কখন স্লিপ করে, আর এটা আগে বোঝা যায় না যে কখন স্লিপ টা করবে। সামনের চাকা ডানে সরে যায় ত পিছনের টা বামে। তার মাঝে ভটভটি নামক স্যালো মেশিনের ভ্যান গুলো হুরমুর করে যায়। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে সামনে যাওয়া আর এক মসিবতের কাজ।

পাশে বিশাল খাদ, ঠিক ভটভটির পাশের রাস্তা টি সবসময় পাশ কাটানোর জন্য খালি পাওয়া যায় না। আবার পাশকাটাতে গেলে নিজের চাকা স্লিপ এর ভয়ত আছেই, তার উপর ভটভটি যদি সামান্য সরে আসে ত আর দেখতে হবে না, একেবারে বাধের নিচে বাড়ি গুলোর চালের উপর গিয়ে পরতে হবে। কিন্তু এত চিন্তা আমাদের নেই। ঝুকি নিতেই যেন বেশি ভালো লাগছে। এভাবে চালাতে চালাতে হঠাৎ করে সামনে মনে হল ধুলায় অন্ধকার হয়ে আছে।

কুয়াশা না ধুলা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সন্ধ্যার আবছা আলোয়। একটু সামনে গিয়ে আমাদের হেডলাইট গুলো জ্বালাতেই দেখতে পেলাম। দুটি বড় ট্রাক্টর। এমনিতেই ধুলায় আমাদের জামাকাপড় চুল সব ধূসর হয়ে গেছে তার উপর এই যন্ত্রণা পেরব কিভাবে বুঝতে পারছিলাম না। বাঁধের কিনারা গুলো অনেক খানেই ভাঙ্গা।

আর এই দানোব গুলোকে পেরতে হলে কিনারা দিয়েই পেরোতে হবে। যে গতিতে ওরা যাচ্ছে তাতে ওদের পিছনে থাকা যায় না। অন্য রাস্তা ধরব তার ও কোন উপায় নেই। আর ধুলার কথা নাইবা বললাম। একটু কাছে গিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলাম।

কখন পেরতে গিয়ে দেখি সামনের রাস্তার কিনারা ভাঙ্গা, কখন বা অপর দিক থেকে কিছু আসছে। বারবার হর্ন দিয়েও ট্রক্টরের ড্রাইভারকে দৃষ্টি আকর্ষন এর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছিল না। আমরা চার টি মটর সাইকেল পাশাপাশি চালাচ্ছিলাম দানবটার পিছনে। একে অপেরের দিকে তাকাচ্ছি।

সবাই চেষ্টা করল লাভ হল না। পাগলা রাব্বি বলল দাড়া দেখি আর একবার চেষ্টা করে। ও ডান পাশের কিনারা ধরে চালিয়ে দিল। সামনেই একটা ভাঙ্গা পরেছিল কিন্তু ও শেষ পর্যন্ত পেছনের চাকা স্লিপ করতে করতে বেরিয়ে গেল। সামনে কিছুদূর গিয়ে ট্রাকটি দাঁড়ালো।

প্রথমে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। ওটাকে পাশকাটিয়ে দেখি রাব্বি ওটার সামনে মোটর সাইকেল দাড় করিয়ে ড্রাইভারকে বেশ ধমকাধমকি করছে। ওর যা কালো চেহারা আর ধুমস স্বাস্থ তাতে ওর ধামকিতে গোফ ওয়ালা কুতকুতে চেহারার ড্রাইভারও ভয় পাইছে। আমরাও পাশে গিয়ে রাব্বি কে বলছি থাক বস ছাইরা দেন। এত গুলো ছেলেকে দেখে আশপাশেও লোক জমে যাচ্ছিল।

তাই রাব্বি কে টেনে মোটর সাইকেলে তুলে রওয়ানা হলাম। একই ভাবে সামনের ট্রাক্টরটিকেও পাশকাটালাম। বাধের ধার ঘেঁষে কোথাও নদী ভাঙ্গা মানুষদের ঝুপড়ির মত ঘর, কোথাও বাধের নিচে টিনের চালের ঘর, বোঝা যায় এগুলো নতুন, আগে ছিল না। আর বা পাশে নিচে নেমে গেছে নদী। প্রমত্তা যমুনা।

শীতে পানি কম। তার পরও এখানে ওখানে চড়ের মত পরে আছে। জেলে নৌকা মেশিনের নৌকা এখানে ওখানে খুটিতে পুতে বেধে রাখা। কোথাও বা কোন কোন পলো দেয়া নোকা আধ ডোবা হয়ে আছে। আর এতক্ষন যেটা খেয়াল করিনি সেটা নদীর উপর বিশাল একখানা চাঁদ।

মনে হচ্ছে যেন যেখানে থাকার কথা সেখান থেকে কিছুটা নেমে এসেছে। কি অপুর্ব মন ভালো করে দেয়া সে দৃশ্য। চাদের হিসাব ত আমরা রাখি না কিন্তু হঠাৎ এসে চাঁদ সহ প্রকৃতির এ রূপ দেখব সেটা কেউ আশা করিনি। রুপোলী আলোয় আদিগন্ত যমুনার বক্ষ আর সমস্ত চরাচর যেন ভেসে যাচ্ছে। একটা বাক ঘুরে শক্ত মাটির রাস্তায় এসে পরলাম।

আশপাশে বাড়িঘর নেই। বাধের উপর তারাতারি বেড়ে ওঠা দু একটা ইউকিলিপ্টাস গাছ নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের চারটি মোটর সাইকেল প্রায় পাশাপাশি। এতক্ষন আমার পিছনে মুন কথা বলছিল। বা মাঝেমাঝে আমরা এক মোটর সাইকেল থেকে আর এ মোটর সাইকেলে কথা বলছিলাম।

কিন্তু হঠাৎ করে যেন সবাই চুপ হয়ে গেছে। এ সৌন্দর্যের শক্তি এতটাই প্রবল যে কথা হারিয়ে যায়। অপার্থীব এক আলো যেন সমস্ত চেতনা কে ঘিরে রাখে। আমি হঠাৎ করে বললাম হেডলাইট নিভিয়ে দে সবাই। সাথে সাথে হেড লাইট নিভে গেলো চারটি মোটর সাইকেলের।

আমরা যেন এক স্বপ্ন লোকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। কোন শব্দই আমাদের কানে আসছে না। শুধু মন জুরিয়ে যাচ্ছে। সামনে গিয়ে একটু যায়গা বাধানোর মত। সেটা নদীর উপর টাওয়ার এর মত মনে হয়।

অলক হঠাৎ করে আগে গিয়ে ওখানে দাড়াল। আমরাও দাড়ালাম। ও আমাদের সবার ছোট, মাঝে মাঝেই পাগলামো করে। ও বলল এখানেই আমরা কিছুক্ষন থাকব। যেখানে যাওয়ার কথা সে যায়গা নিশ্চই এর চেয়ে সুন্দর হবে না? সবাই কোন কথা না বলেই মেনে নিল।

আশপাশে কোন লোকালয় নেই। শীতের শান্ত নদী। নদীর ওপার আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে। আকাশে বিশাল চাঁদ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কালো কয়েকটি মুর্তি আমরা দাঁড়িয়ে আছি।

ঠান্ডা বাতাস, বা সেই ধুলোর সাগর পেরিয়ে আসা কষ্ট কোন কিছুই আমাদের মনে আসছে না। সবাই চুপচাপ শুধু চেয়ে আছি চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ঝলমল করা নদীর দিকে। সমস্ত জাগতিক চিন্তা সরে গেছে। সবাই যেন শুদ্ধ প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ বাঁশির এক করুন সুর ভেসে আসল খুব কাছথেকে।

সবাই অবাক হয়ে ঘুরে দেখে লম্বা চুলের শোভন বাশি বাজাচ্ছে। সে সুর আমরা চিনি না। তার পরও যেন কত চেনা। বাঁশির লম্বা টান গুলো করুন মনে হলেও মনে যেন খারাপ লাগা বলে কোন কিছুই আসছে না। বাঁশির সুর সামনে নদী বেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও।

সাথে আমরা সবাই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।