তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয় গুলশান দুইয়ের কাছে দেখা হলো। জিজ্ঞেস করলামঃ
- এখানে কি করছ?
- শপিং। আর কি করার আছে আমার?
- পরীক্ষা তো এসে গেছে। পড়তে হবে না?
করুণ মুখে তাকালো।
- আমার দ্বারা পরীক্ষা পাশ হবে না।
তাই চিন্তা নেই। ও প্রসঙ্গটা বাদ দিলে হয় না?
- আচ্ছা ঠিক আছে, চলো ওপরে গিয়ে বুফে খাই।
- না, ওখানে খুব ভীড় হয়। তোমার সাথে আমাকে দেখলে পরিচিত কেউ ওই ভদ্র নম্র তোমার খুব পছন্দের লোকটাকে জানিয়ে দেবে, আর সে এক হপ্তা আমার সাথে কথা বলবে না।
আমি হাসলাম।
- আমার পছন্দের? কি করে বুঝলে?
- কারণ ও তোমারই মত। ভেতরে কি আছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বেশি চালাক। ওর কথা উঠলেই আমি দেখেছি তোমার চোখ খুব মোলায়েম হয়ে যায়। ফেসবুকে ওর ছবিতে তুমি লাইক দাও, আমারটায় না।
- তোমাদের বিয়ের রাতের যুগল ছবিতেও আমি লাইক দিয়েছি, কমেন্ট করেছি। অর্ধেক তোমার পাওনা।
- হুম, আর আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে একটা বেশ ফর্মাল উত্তর দিয়েছি।
- এবং তার নিচে একজন লিখেছিলঃ আহা কি চমৎকার অভিনয়।
- ও, পলাশ।
বেচারা।
- আমার মনে হয় পলাশ তোমাকে খুব পছন্দ করত। তোমার হঠাৎ বিয়ে ও ভালোভাবে নিতে পারে নি।
চুপ করে রইল কিছুক্ষণ । তারপরে বলল - মানুষের জীবনে কত কিছু ঘটে যায়।
পুরোনো দিনের কথা ভেবে লাভ কি। পলাশ তোমার মত না। মনের কথা খুলে বলার সাহস আছে। তবে ভীষণ বোকা ছেলে।
- যে পেশায় আছে সেখানে সাহস খুব দরকার।
এসো , অন্তত এখানে কফি খাই, লোকজন কম। কেউ দেখবে না।
ঢুকে এক কোণায় বসলাম।
- আসলে ও তোমাকে অনেক সম্মান করে। বড় ভাইয়ের মত।
ওর রাগ শুধু আমার ওপরে। আমি নাকি ছেলেদের নিয়ে খেলতে ভালোবাসি। আমি কি নিজের ইচ্ছেতে এই বিয়ে করেছি? আমাদের দেশের মেয়েরা এখনো কত অসহায় এটা কেউ বুঝতে চায় না।
- সবাই না। আমার এবং তোমার এক কমন ফেসবুক বন্ধু এক স্টেটাসে লিখেছিলঃ ‘আজ মাকে খুব ভড়কে দিলাম।
বিয়ের প্রস্তাবের কথা বলতে এসেছিল। বললাম, সারাজীবন বলে এসেছ কোন অপরিচিত পুরুষের সাথে কথা বলবে না, আর এখন আমাকে বলছ এক অপরিচিত লোকের সাথে শুতে হবে!’ সাহসী মেয়ে। দেখেছিলে?
- হ্যাঁ; তিশার তো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা নেই। ভালো ছাত্রী, লেখাপড়া করবে অনেক দিন। ততদিনে মনের মানুষ পেয়ে যাবে।
আমার বাবা বেহুদা অপেক্ষা করতে দেবে কেন আমায়? চারদিকে আবোল তাবোল ঘটনা ঘটছে; ভয় পেলেন, আমারও যদি কিছু হয়, মুখ দেখাতে পারবেন না।
- অসুবিধে নেই, বিয়ের পরেও স্বামীকে ভালোবাসা যায়। আমার তো মনে হয় তুমি ভালো ঘরনী হবে।
চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হঠাৎ।
- আমি অনেক রান্না শিখে ফেলেছি।
তোমাকে এক দিন খাওয়াবো। ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান, সব পারি। তোমার যা পছন্দ।
বেশ আমোদিত বোধ করলাম। ও প্রাণপণে স্বামীটিকে খুশী করতে চেষ্টা করছে।
তাই এসব অকল্পনীয় উদ্যোগ। নিশ্চয়ই এতদিনে একটু হলেও ভালোবেসে ফেলেছে।
- তোমার শাশুড়ির সাথে ভাব কেমন? বৌ আর শাশুড়িদের মধ্যে নাকি সম্পর্ক ভালো হয় না।
- কই না তো। আমাকে তো বেশ ভালোবাসেন মনে হয়।
ওনাদের তো আর কোন সন্তান নেই। আমিই মেয়ে। রান্না-বান্না উনিই আমাকে অনেক শিখিয়েছেন।
- গ্রেট! এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল। এদেশের মহিলারা ছেলেদের সম্বন্ধে খুব পসেসিভ হন।
এতদিনের বাধ্য ছেলে হঠাৎ অন্য ঘরের এক মেয়ের কথায় উঠ-বস করবে এই কল্পনাতেই অনেকে অস্থির হয়ে যান, অনেক সময় খুব বেশি ডমিনেন্স দেখাতে গিয়ে অনেক ঝামেলা সৃষ্টি করেন। আর শ্বশুর?
- খুব ভালো মানুষ। সারাক্ষণ আমাকে মা-মা বলে ডাকেন। আর নানা রকম কাজের অকাজের জিনিস উপহার দেন।
- হ্যাঁ, এটাও কমন।
ভালো ফ্যামিলিতে বউমাদের তাদের শ্বশুর সাহেবরা খুব আদর করেন। তোমার বাবা-মাও তো তোমার ভাবীকে খুব পছন্দ করেন তুমি বলছিলে।
ও এবার চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। এটা পুরোনো অভ্যাস। হঠাৎ কোন ব্যাপারে উৎসাহ এলে সোজা হয়ে যায়, বসে থাকলে বা দাঁড়ালেও।
তারপরে গলা একটু হালকা পরিষ্কার করে জোর গলায় বলে।
- আমরা চারজন কক্সবাজার, বান্দরবান, নীলগিরি গিয়েছিলাম। সবাই ভাবছিল চার ভাই-বোন।
মিষ্টি করে হাসল। গালে টোল পড়ল।
বড় চোখ আর এই টোল তার সব চেয়ে বড় আকর্ষণ। আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিলাম। কিন্তু স্মৃতি একবার জাগতে শুরু করলে সিরিয়াল প্যারাল্লেল দুই বাসেই আসতে থাকে।
- এসো আমরা আবার পুরোনো খেলাটা খেলি।
- কোনটা?
- এসোসিয়েশন।
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
- না।
- কেন, না?
- তুমি অনেক প্যাঁচানো শব্দ বল। অনেকগুলোর তো আমি মানেই জানি না। তবে আমি তোমাকে কিছু শব্দ বলি বরং, এক সেকেন্ডের মধ্যে রেস্পোন্ড করবে।
- আমার তো কোন পরিবর্তন হয় নি। আগের মতোই আছি। সুতরাং নতুন কিছু পাবে না।
- দেখা যাক। বৌ-
- বর।
- ধ্যাৎ, একেবারে ব্যাকরণ বই থেকে। ভালোবাসা -
- বেশি ভাড়া।
- ফাজলামি পেয়েছ? পরী-
আমি কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। এই নামে আমি ওকে ডাকতাম।
আমার দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে আমার বড় বোনের মত বেশ বড় বড় ভাব দেখিয়ে বললঃ
- সীন ক্রিয়েট করো না। এই নাও টিস্যু। নতুন পরী জোগাড় করো।
আমি রেস্টরুমে দু মিনিট থেকে ফিরে এলাম। স্বাভাবিক গলাতেই বললামঃ
- এবার আমার পালা।
গয়না-
- শাড়ি।
- জীবন-
- মরণ।
- সুরঞ্জনা -
- আমি আর আসব না।
- আগে তুমি “ছাদ” বলতে।
- দিন বদলে গেছে।
চল উঠি।
আমরা বেরুলাম। বললামঃ
- তা ঠিক। ফেসবুকে তুমি অবশেষে তোমার নামটাও বদলে ফেলেছ। পতির নামেই সতীর নাম বাঞ্ছনীয়, পুন্য না হলেও ।
তবে নতুন নামটা খারাপ না, চমৎকার রীদম আছে।
হঠাৎ রাস্তায় কি দেখে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি র্যাবের এক গাড়ি। গাড়িটা আমাদের সামনেই থামল। একজন দ্রুত নেমে আমাদের কাছে এসে ওকে স্যালিউট দিল।
- ম্যাডাম, স্যার আপনাকে অনেকক্ষণ মোবাইলে কল করেও না পেয়ে আমাদের পাঠালেন। বোধ হয় আপনার চার্জ ছিল না। আমরা আসে-পাশের অনেক জায়গাতে খোঁজাখুঁজি করেছি। আপনার শপিং শেষ হলে আমাদের সাথে ফিরতে পারেন, ম্যাডাম।
টের পেলাম আমার হাতটা ও আঁকড়ে ধরেছে।
কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই ছেড়ে দিল।
- যাই, খালাম্মা ,খালুকে আমাদের বাড়ি আসতে বলো।
“খালাম্মা, খালু” আবার কে। ও তো আমার বাবা-মাকে কখনোই দেখে নি।
তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে ওঠার সময় জামা একটু সরে গিয়েছিল।
পলকে দেখলাম, কোমড়ে গোল পোড়া দাগ।
রাস্তায় জ্যাম ছিল না, গাড়িটা বেশ দ্রুতই চলে গেল। আমার শ্বাস আটকে এল। আমি পকেট থেকে ইনহেলার বের করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।