আমি আমাকে নিয়েই তো এখনও বেচে আছি । একদিনআমাকে নিয়েই চলে যাব । সেদিন খুঁজলেও আর পাবি না..........আমার ভার্চুয়াল ফ্যাক্টরিতে স্বাগতম । আমার মন খারাপের সময়টা এখানে আর ফেসবুকে কাটে । মাঝে মাঝে দু একটা লেখা তৈরি করতে ইচ্ছা হলে চলে আসি এখানে ।
https://www.facebo (১)
শেষ বিকেলের আলো জানালার ফাঁক গলে এসে পড়ছে নীল কাপড়ে ঢাকা শোফাগুলোর উপরে । কাপড়েল আঁশ চকচক করছে সে আলোয় । রুমটা বেশ বড় । ভাল করে খেয়াল করলে বোঝা যায় যে রুমটা এককালে দুটো রুম ছিল , খুব সম্প্রতি একটা রুমে রূপান্তর করা হয়েছে । ধূলো আর ভ্যাপসা একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে রুমের ভিতর সর্বত্র ।
অনেকদিন কেউ না ঢোকার ফল । ভিতরে একসেট শোফা আর একটা পুরোনো আমলের খাট ছাড়া তেমন কিছুই নেই । এটাই আলম পরিবারের মেহমান আপ্যায়নের ঘর । খাটটা আলমদের তিন ভাইয়ের বাবা বানিয়েছিলেন আরো ৪০ বছর আগে । বর্তমান অবস্থা বিশেষ ভাল না , তবুও বাবার স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন তারা ।
খাটের উপর পা তুলে বসে আছেন রাশেদ আলম । আলম পরিবারের বড় ছেলে তিনি , তার ঠিক পাশেই বসে আছেন তার বৃদ্ধা মা মাজেদা বেগম । সামনে পেতে রাখা শোফা সেটের একটিতে চুপচাপ বসে আছেন রাজীব আলম , রাকিব আলম । মাথার উপর খট খট শব্দ করে ঘুড়ছে একটা পুরোনো আমলের সিলিং ফ্যান । নিরবতার মাঝে অস্বাভাবিক লাগছে শব্দটা ।
রাশেদ সাহেব গলা খাকারি দিলেন । মাজেদা বেগমের মুখের ভাবের কোন পরিবর্তন হলো না । চোখ বন্ধ করে একমনে তসবি গুনছেন তিনি । রাশেদ সাহেবের ছোট দুই ভাই শোফার উপরই অস্বস্থিতে নড়ে চড়ে বসলেন । "কি বলতে চাইছিলি ? এখন বল ।
"গম গম করে উঠলো রাশেদ সাহেবের ভরাট কন্ঠস্বর । অনেক্ষন নিরবতা । কোন শব্দ নেই ফ্যানের বিশ্রি শব্দটা ছাড়া । কথা বলে উঠতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলেন রাজীব আলম । পেশায় তিনি একজন ডাক্তার ।
আর তার ছোট ভাই রাকিব আলম বাংলাদেশের সুনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ।
"কি ব্যাপার ? কথা বলছিস না কেনো ?" আবার জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ সাহেব । "না মানে ভাই , বাড়িটা অনেকদিন রং করা হয় না । "বললেন রাজীব আলম । "হ্যা তো ? এখন হাতে টাকা নাই ।
ভাল করেই জানিস । তাছাড়া আর মাত্র দুইদিন পরই তো ঈদ । খরচ তো প্রচুর"-"না মানে ভাই , বাড়িটা কেমন পুরানা লাগে" বললেন রাকিব আলম । "তোদের ইচ্ছা থাকলে রং করিয়ে ফেল । বাড়ি তো সবারই" বললেন রাশেদ সাহেব ।
"হাতে তো অত টাকা নাই । আমরা , মানে আমি আর রাকিব ভাবতেছিলাম , ঈদের পর বাড়িটা ডেভলাপারদের দিয়ে দিলে ভাল হয় । ধরেন , ৯ তলার ফাউন্ডেশন দিলে ১৮ টা ফ্ল্যাট হয়ে যাবে । আমরা সব ভাই বোন আর মায়ের জন্য একটা ফ্ল্যাট হবে তাহলে । " হড়বড় করে কথাগুলো বলে ফেললেন রাজীব আলম ।
অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন রাশেদ সাহেব । স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন তিনি । ধীরে ধীরে বললেন "রাজীব , রাকিব তোরা খুব ভাল করেই জানিস , বাড়িটার ভাড়ায় আমার সংসার চলে । আমার এখন আগের মতো শক্তি নাই । শেয়ার বাজারের অবস্থা তোরা জানিস ।
"-"ভাই জানি বলেই তো । আমাদের টাকাও তো মাইর গেছে । তাছাড়া বাড়ি তো আর আপনার না , এইটা আব্বা বানায়ে দিয়ে গেছেন । আপনি এটার সব ভাড়ার টাকা একা নেন । এটা কেমনে হইলো ?"বললেন রাকিব আলম ।
বিস্মিত দৃষ্টিতে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাশেদ সাহেব । বর্তমান পরিস্থিতি তার স্বপ্নকেও হার মানায় । হটাত্ করেই যেন রাশেদ সাহেবের বুকে কেউ কয়েক হাজার টন পাথর চেপে ধরেছে । তার কন্ঠ কেঁপে উঠলো কথা বলার সময় "কি বললি তোরা ??" দুই ভাইয়ের কেউ উত্তর দিলো না । কাঁপা কাঁপা কন্ঠেই রাশেদ সাহেব তার মাকে জিজ্ঞেস করলেন "মা , কি বলে এসব ?" মাজেদা বেগম চোখ খুললেন ।
তারপর বললেন "বাপের সম্পত্তি তো ভাগ হইবই । ইয়া নতুন কি ?" প্রচন্ড নাড়া খেলেন রাশেদ সাহেব । পায়ের নিচে মাটি সড়ে গেলো যেন তার । চোখ ঝাপসা হয়ে এলো । তারপর কাঁপা কন্ঠেই বলেন "আব্বা মারা যাওয়ার পর তোদেরকে এতো বড় করছি , নিজের ছেলে মেয়ের মত ।
কখনো কিছু চাই নাই । তোরা আজকে এইটা কি বললি ! আমার তিনটা ছোট্ট বাচ্চা আছে । আমি........" আর বলতে পারলেন না তিনি । হু হু করে কেঁদে ফেললেন । ছোট দুই ভাই , মাজেদা বেগমের এবার স্তব্ধ হওয়ার পালা ।
কারন রাশেদ সাহেব শেষ কবে এভাবে কেঁদেছিলেন মনে পরে না তাদের । "না মানে ভাই । এমনিতেই বললাম । এক সময় তো করাই লাগবে । আপাতত থাক ।
আরো কয়েক পর পর হলেও চলে"বলে উঠলেন রাজীব আলম । মাথা ঝাকিয়ে বড় ভাইয়ের কথায় সায় দিল রাকিব আলম । রাশেদ সাহেব দ্রুত সামলে নিলেন নিজেকে । তারপর একটাও কথা না বলে উঠে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে ।
আলমদের বাড়িটা দোতলা ।
নিচতলা ভাড়া আর উপর তলার এক অংশে রাশেদ সাহেব থাকেন তার পরিবার নিয়ে । অন্য অংশটা খালিই থাকে । ঈদ অথবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে রাজীব , রাকিব আলমরা আসেন । রাশেদ সাহেব যখন রুম থেকে বের হয়ে যান তখন সন্ধ্যা নেমেছে । বাড়ির এ অংশটায় যদিও কেউ থাকে না , তবুও প্রতি রাতে এখানের প্রত্যেকটা রুমের লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয় ।
কারন লাইট জ্বললে রাশেদ সাহেবের মনে হয় তার ভাইয়েরা তার সাথেই আছে । সে জন্য প্রতিরাতে বাড়ির ঐ অংশটাতে কেউ না থাকা স্বত্তেও লাইট জ্বালিয়ে রাখেন তিনি । নিজে না পারলে ছেলেকে বলে যান । কতোদিন যে তিনি ছেলেকে বকাঝকা করেছেন লাইট না জ্বালার কারনে ! আজকে বাড়ির এ অংশটায় রাজীব আলম , রাকিব আলমদের পুরো পরিবার , মাজেদা বেগম সবাই আছেন । কিন্তু তবুও এ অংশে লাইট জ্বলছে না ।
সবাই চুপচাপ বসে আছেন অন্ধকারে । হটাত্ রুমের লাইট জ্বলে উঠলো । সবাই সব ভুলে গেলেও রাশেদ সাহেবের ছেলে তার কর্তব্য , দায়িত্ববোধ ভুলে যায়নি ।
(২)
সন্ধ্যা থেকেই স্বামীর মন খারাপ দেখছেন রাহেলা বানু । কারনটা ঠিক খোলাসা হয় না তার কাছে ।
মানুষটার সাথে তার কোথায় যেন অত্মীক একটা সর্ম্পক আছে । মানুষটা মাঝে মাঝে তাকে খুব কষ্ট দেয় । কিন্তু তবুও কেন যেন মানুষটাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন , ভালবাসেন তিনি । সাধারনত দশটা নাগাদ শুয়ে যান রাশেদ সাহেব । কিন্তু আজকে হটাত্ করেই এশার নামায পড়ে এসেই শুয়ে পড়লেন ।
রাহেলা বানু একবার প্রশ্ন করেছিলেন যে কি হয়েছে তার ? কিন্তু জবাব না পাওয়ায় আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না । গৃহস্থালী কাজ শেষ করে এসে শুয়ে পড়লেন স্বামীর পাশে । একটু পর টের পেলেন যে রাশেদ সাহেব জেগে আছেন । "কি হইছে তোমার ?" ব্যাগ্র কন্ঠে জানতে চাইলেন তিনি । জবাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাশেদ সাহেব ।
স্ত্রীর কাছে আর লুকিয়ে লাভ কি ? তাছাড়া এতোগুলো বছর যখন একসাথে থেকেছেন , এতো বড় সংসারের সব বোঝা একসাথে কাধে নিয়েছেন তারা , তখন স্ত্রীর হক আছে কথাগুলো জানার । সুতরাং রাশেদ সাহেব স্ত্রীকে সব খুলে বললেন । তারপর বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললেন । রাহেলা বেগম অস্থির হয়ে উঠলেন । এতোগুলো বছর একসাথে কাটিয়েছেন ।
কিন্তু মানুষটাকে কাঁদতে দেখেননি । রাশেদ সাহেব স্ত্রীর হাত চেপে ধরে থাকলেন শক্ত করে । কান্না জড়ানো কন্ঠেই বললেন "জীবনে শখ আহলাদ সব বিসর্জন দিলাম এদের জন্য অথচ.... তোমাকে একটা শাড়ী কিনে দিলাম না .... অথচ আজকে আমার এসব কি শুনতে হলো !" রাহেলা বানুও নিঃশব্দে কাঁদছেন । নিজের কথা ভাবলেন তিনি । ঠিক বিশ বছর আগে এই সংসারে এসেছিলেন তিনি ।
কখনো অভাব জিনিসটা বুঝতে পারেননি তার বাবার সংসারে । স্বামীর সংসারে এসে নিত্য অভাব অনটনের মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন । দৈন্যদশা ছিল তখন আলম পরিবারের । কতোদিন অনাহারে অর্ধহারে থেকেছেন ! কতো কটুক্তি ,কষ্ট বুকে চেপে এতদূর পর্যন্ত টেনে এনেছেন সংসারটাকে । বউ হয়ে যখন এবাড়িতে এসেছিলেন তখন তার দেবররা একজন ক্লাস সিক্স , আরেকজন ক্লাস ফোরে পড়তো ।
ছেলের মতো করে মানুষ করেছেন তাদেরকে । অথচ আজকে সেই ছেলেতুল্য দেবররাই তাদেরকে তাড়িয়ে দিতে চায় । রাহেলা বেগমের মনে হয় পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর ।
শেষ কবে একটি শাড়ি কিনেছেন , তাও ভুলে গেছেন রাহেলা বানু । বহুবার ভেবেছিলেন এ সংসারের ঘানি টানতে পারবেন না আর ।
অভাব অনটনের মাঝে উপরি হিসেবে পাওনা ছিল শাশুড়ির নির্যাতন আর ননদদের ভত্সনা । দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে এসেছেন । এখনো কি কষ্ট কম করছেন ? মেজো বউ ডাক্তার , ছোট বউ উচ্চশিক্ষিতা , নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা আহামরি না । তাই কাজের লোকদের মতো এখনো খাটিয়ে যাচ্ছেন তার শাশুড়ি । স্বামীর কাছে মাঝে মাঝে অভিযোগ করেন ।
কিন্তু তার স্বামীর মাতৃভক্তি অতিমাত্রায় বেশি । মাতৃভক্তির নমুনা দেখে স্বামীকে শ্রদ্ধা করেছেন তিনি । সব সহ্য করেছেন স্বামী আর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে । আল্লাহর উপর ভরষা রেখে এতোদূরের পথ পাড়ি দিয়েছেন , আজো যাচ্ছেন । দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার বুক চিড়ে ।
মধ্যরাতের অন্ধকারে নিরবে কেঁদে চলেছে দুজন মধ্যবয়স্ক মানুষ । হাজার কষ্টের স্রোত সে অশ্রুকণার মাঝে মিশে আছে । হয়তো তাদের কষ্ট দেখেই রাতের প্রথম প্রহর থেকেই বৃষ্টি ঝড়ছিল । বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল হটাত্ ।
(৩)
অন্ধকার ছাদের কোনে চুপচাপ বসে আছে ধ্রুব ।
অন্ধকার তার খুব আপন কেউ হয়তো । ছেলেটা তাই আধাঁরের মাঝেই বসে থাকতে পছন্দ করে । বাবা মায়ের দুঃখ কষ্টগুলোর জ্বলন্ত সাক্ষী ধ্রুব । ছোট একটা বাচ্চার সামনে যখন তার মাকে নির্যাতন করা হতো আর বাচ্চাটা ঘরের কোনে দাড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদতো , তখন বাচ্চাটার কেমন অনুভব হয় তা জানে ধ্রুব । ধ্রুব জানে প্রতিদিন প্রতিরাত মায়ের চোখের জলে সিক্ত হতে কেমন লাগে ।
ধ্রুব জানে কিভাবে দিনের পর দিন , রাতের পর রাত শত শত দুঃখবোধ বুকের মধ্যে চেপে রাখার কষ্ট । কতই বা বয়স হয়েছে ওর ? সতেরো ? এই সতেরো বছরের জীবনটাতেই সে বুঝে নিয়েছে জীবন যুদ্ধ কি জিনিস । মাঝে মাঝে ধ্রুবর নিজেকে খুব নিচু শ্রেণীর কীট মনে হয় । একজন রিকশাওয়ালাও সারা দিন পরিশ্রম করে রাতে বাসায় ফিরে শান্তিতে ঘুমাতে পারে । কিন্তু ধ্রুবর এতো সৌভাগ্য হয় না ।
তার অতীত স্মৃতি তাকে খুচিয়ে মার প্রতিনিয়ত । রাতে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে সে । জীবধকে অর্থহীন মনে হয় । তার জীবনটা গণিতের অমূলদ সংখ্যার সেটের মতো । যা দেখতেও সুন্দর না , আর যার কোন বাস্তব মান নেই ।
ধ্রুব কেমন যেন অসামাজিক । সবার সাথে মিশতে পারে না , কথা বলতে পারে না । ব্যাক্তিত্বহীনতায় ভোগে , দেখা যায় অপরিচিত কারো সাথে দেখা করার সময় অস্বস্থি বোধটা প্রবল মাত্রায় কাজ করে । সারাক্ষন খিটখিটে হয়ে থাকে মেজাজ । খুব কম পরিমানে হাসে ।
সবাই বুঝতে পারে , ছেলেটা স্বাভাবিক না । তাই সবাই তাকে এড়িয়ে চলে । খুব কম মানুষই তার অস্বাভাবিকতার উত্স খোঁজ করে । আজকে বিকালে চাচাদের সাথে তার বাবার কথোপোকখনের সবই ধ্রুব শুনেছে । না আড়ি পেতে নয় ।
পাশের রুম দিয়ে যাওয়ার সময় ধ্রুব তার বাবার কান্নার আয়োয়াজ শুনতে পায় । বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো যে তার বাবাই কাঁদছিলেন । একটু পর বাবা দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন । ধ্রুব চুপচাপ দাড়িয়ে ছিল । বাবার আদেশ ভুলে যায়নি সে , বাড়ির এ অংশের লাইটগুলো জ্বেলে দিয়েছিল ।
ধ্রুব ভাল করেই জানে যে তার বাবা ঠিক আগামীকালই চাচাদের সাথে ঠিকভাবে কথা বলবেন , যেন কিছুই হয়নি । চাচারা হয়তো আবারও মানুষটাকে কষ্ট দিবে ।
মাঝে মাঝে বিবেকের কাঠগড়ায় ধ্রুব তার বাবাকে দাড় করাতে চায় কিন্তু মায়ের কারনে পারে না । রাহেলা বানু ছেলেকে বলেন "দেখ বাবা । একজন মানুষ একবারই বাপের দায়িত্ব পালন করতে পারে ।
তোর বাপ সে দায়িত্ব পালন করে ফেলছে । মানুষটাকে আর কষ্ট দিস না । " ধ্রুব কথাটার সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পায় । হটাত্ ডুকরে কেঁদে উঠে সে । মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে নিঃসঙ্গ বাতাস শুধু তার সঙ্গি হয় ।
একটু পর ধ্রুব টের পায় হালকা পায়ের শব্দ । ভাল করে তাকাতেই নিশাত , নাফিসার অবয়ব চিনতে পারে । তার ছোট বোধ দুটো চলে এসেছে তার কাছে । উঠে দাড়িয়ে বোনদের কাছে এগিয়ে যায় সে । নাফিসাকে কোলে তুলে নেয় , ছোট্ট নাফিসা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে ।
নিশাতও ভাইকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে । নিঃশব্দে চোখের পানি পরে তার , সে পানি শুনে নিয়ে সিক্ত হতে থাকে ধ্রুব সুতি চেক শার্ট । ধ্রুবর হটাত্ ভয়াবহ কষ্ট হয় । আধাঁরের মাঝে দুই বোনের চেহারা দেখতে চেষ্টা করে ধ্রুব । কিন্তু পারে না ।
কষ্টের স্রোতেকে মাঝে ব্যাপারটা যেন আরকটু উস্কে দিল । বোনদেরকে শক্ত করে ধরে রাখে সে । বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো ধ্রুবর । যে কোন ছোট বাচ্চাদের হাসতে দেখলে এখন বুকে চিনচিনে একটা ব্যাথা হয় ধ্রুবর । তার বোনগুলো তো এভাবে কখনো হাসেনি ? কেন হাসেনি ? এই প্রশ্নের জবাব কেউ দেয় না তাকে ।
বাবা মায়ের কষ্টের স্রোত স্পর্শ করে তিনটি অপরিনত মনকে । ঠিক আজকে রাতের মতই যাদের ভবিষ্যত্ আধাঁরে ঢাকা ।
(৪)
গতকাল ঈদের দিন ছিল । সকালে ফজরের নামায পড়ে ভাইদের ডাকতে গিয়েছিলেন রাশেদ সাহেব । রাজীব আলম , রাকিব আলম নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবে ।
ধ্রুবর ধারনাই সত্য । রাশেদ সাহেব সব ভুলে আবার ভাইদের আপন করে নিয়েছেন । ইদানিং রাশেদ সাহেবের চোখে একটু সমস্যা । ভেবেছিলেন রাজীব আলম চলে যাওয়ার আগেই দেখিয়ে নিবেন একবার । ছোট ভাইয়ের রুমের কাছাকাছি এগিয়ে গেলেন তিনি ।
কিন্তু দরজার কাছাকাছি যেতেই থমকে যেতে হলো তাকে । রুমের ভিতর থেকে ছোট ভাই আর তার স্ত্রীর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছে । এবং সেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের বিষয়বস্তু রাশেদ সাহেব নিজে এবং এই বাড়ি । রাশেদ সাহেব চুপচাপ শুনলেন । কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তার ।
ঘুরে দারিয়ে হাটতে থাকলেন তিনি ব্যক্তিগত স্টাডি রুমের দিকে । সেখানে পৌছে একটা ছোট আলমারি খুলে ভিতর থেকে বাড়ির দলিলগুলো বের করে আনলেন । দলিলগুলো নিয়ে তিনি হলরুমে ঢুকে চড়া গলায় সবাইকে ডাকলেন । কয়েক মিনিট পরই হলরুমে রাজীব আলম , রাকিব আলম ও তাদের স্ত্রী এবং মাজেদা বেগমকে দেখা গেল । বাড়ির দলিলগুলো শান্তমুখে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি ।
রাজীব আলম কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু স্ত্রীর ইশারায় থেমে গেলেন । রাশেদ সাহেব ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেও কিছুই না বলে বের হয়ে গেলেন রুম থেকে । রাহেলা বানু দাড়িয়ে ছিলেন বাহিরেই । রাশেদ সাহেব ইশারা করতেই স্বামীর পিছন পিছন হেটে নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে গেলেন । ঠিক পনেরো মিনিট পর বাসা থেকে ফের হয়ে এলেন রাশেদ সাহেব ।
সাথে তার পরিবার । নিজের মায়ের কাছে এগিয়ে গেলেন , অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন "মা , চলে যাচ্ছি বাড়িতে । ফ্ল্যাটটা হয়ে গেলে খবর দিয়েন । " বলেই কাওকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে হাটতে লাগলেন । কেউ এগিয়ে এলো না তাকে আটকাতে ।
ঝাপসা চোখে ঠিক খেয়াল করতে পারছিলেন না চারপাশ । হটাত্ খেয়াল করলেন যে তিনি বাড়ির বাহিরে বের হয়ে এসেছেন । সামনেই আকাশী নীল রং করা দু তলা বাড়িটা দাড়িয়ে আছে । অতীত স্মৃতি মনে পড়ে গেলো রাশেদ সাহেবের । বাড়ি তৈরির সময় বেশি টাকা ছিল না তার কাছে ।
একজন রাজমিস্ত্রি কাজে লাগিয়েছিলেন আর নিজে জোগালির কাজ করেছেন । নিজ হাতে ইটের পর ইট গেঁথে তৈরি করেছেন এই বাড়ি । হাত কেঁটে , থেতলে বহুবার রক্ত ঝড়েছে , ঘাম ঝড়েছে । সেই রক্ত , ঘাম মিশে আছে এই বাড়ির প্রতিটি বালুকণার মাঝে । রাশেদ সাহেবের চোখ থেকে টপ করে একফোটা পানি পড়লো ।
আপন বাড়িতেই আজ অনাহূত হয়ে যেতে হলো তাদের । নাফিসা হটাত্ বাবার পা জড়িয়ে ধরলো । রাশেদ সাহেব মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন । নিশাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে । রাশেদ সাহেবের চোখ দিয়ে তখনও পানি গড়িয়ে পড়ছে ।
নাফিসা ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো । কচি হাতের ছোয়ায় মুছে দিলো বাবার চোখের পানি । রাহেলা বানু অশ্রুসিক্ত চোখে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । হটাত্ তিনি রাশেদ সাহেবের ডান হাত চেপে ধরলেন শক্ত করে । নিশাত ততক্ষনে বাবার বাম হাত চেপে ধরেছে ।
ধ্রুব নিশাতের বাম হাত ধরলো ।
রাশেদ সাহেব ছেলের দিকে তাকালেন । কতোদিন ছেলেটার সাথে ঠিকমত কথা বলেননি তিনি ! ধ্রুবর চোখ ছলছল করছিলো । হটাত্ মৃদু হাসলো ধ্রুব তার বাবার দিকে তাকিয়ে । রাশেদ সাহেবের কাছে মনে হলো , ধ্রুব যেন হটাত্ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে ।
তার দুই মেয়ে আর স্ত্রীর চোখে মুখেও পরম নির্ভরতার ছাপ দেখতে পেলেন তিনি । শত কষ্টের মাঝেও অদ্ভুত একটা স্বস্থি অনুভর করলেন রাশেদ সাহেব । হায় পৃথিবী ! সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মানুষকে মায়ার বাধঁনে আটকে থাকতে হয় । সব আশা ভেঙ্গে যাওয়ার পর , আবারও সুপ্ত আশাগুলো জেগে উঠে । ভালবাসার প্রতিটি কণা নতুন করে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে এখানে ।
কারন পৃথিবীর সব মায়া মিশে আছে সংসারে । আপন পরিবারকে সাথে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ান রাশেদ সাহেব । হ্যা তার গন্তব্য হয়তো লক্ষ্যহীন , তবে পদক্ষেপ দৃঢ় । তখন সবে ভোর হয়েছে , সূর্যের সোনালি আলো এসে পড়ছে পাঁচজন মানুষের গায়ে , মানুষগুলোর সংক্ষিপ্ত ছায়া পরে রাজপথে , সে ছায়া দীর্ঘ হয় না...
কিছু কথা ও উত্সর্গঃ
আমি এক হতভাগা মানুষ । আমি কখনো ভাল ছেলে হতে পারিনি , হতে পারিনি ভাল ভাই , হতে পারিনি ভাল বন্ধু ।
আমি আমার আপন মানুষগুলোকেই দূরে সড়িয়ে দিই । আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই এই বিশাল পৃথিবীতে দু একটা আহনাফ সানভী মুছে গেলে কেউ খোঁজও নিবে না । তবুও সবারই মতো আমার মাঝেও বোধহয় ভালবাসার অনুভূতি কাজ করে । আর অনুভূতি কাজ করে আমার সংসারকে ঘিড়ে । তাই গল্পটা আমার পরিবারকেই উত্সর্গ করলাম ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।