আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার, মোগল সম্রাট ও প্রধানমন্ত্রী

সম্প্রতি এক সেমিনারে ড. আকবর আলি খান যথার্থই বলেছেন, ‘রাশিয়ার জার ও ভারতের মোগল সম্রাটের চেয়েও বেশি ক্ষমতা ভোগ করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। ’ বলা বাহুল্য, তা প্রধানমন্ত্রী ভোগ করেন সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতাবলেই। জোর করে নয়। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদকে এতই ক্ষমতা দিয়েছেন! পরবর্তীকালে সাংসদেরা তা সংশোধন করার প্রয়োজন মনে করেননি।
ড. আকবর আলি খান একটা কথা বলেননি, তা হলো জার ও মোগল সম্রাটেরা ‘নির্বাচিত’ ছিলেন না।

আমাদের ‘প্রধানমন্ত্রী’ নির্বাচিত। সাংসদেরা তাঁকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে নির্বাচিত করেন। আমরা এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছি, যাতে সংসদ সদস্যপদে নির্বাচিত হলে তিনি প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান। অন্য কোনো পদে ‘নির্বাচিত ব্যক্তিরা’ তাঁদের ধারেকাছে যেতে পারেন না। এমনকি জাতীয় সংসদে পরোক্ষভাবে ‘নির্বাচিত’ (তিন শত সাংসদের ভোটে) নারী সাংসদেরাও কম যান না।

তাঁদেরই একজন, যিনি কোনো প্রত্যক্ষ নির্বাচন করেননি, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের স্পিকার পদে বসিয়ে দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও পার্লামেন্টের স্পিকার পদে (যিনি পার্লামেন্টের সব দলের সদস্যের অভিভাবকও বটে) সাধারণত একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, একাধিকবার নির্বাচিত সাংসদ বা প্রবীণ রাজনীতিককে দেওয়া হয়। আমরা সেই ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারিনি। আওয়ামী লীগের সাংসদদের মধ্যে অন্তত চার-পাঁচজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, যাঁরা স্পিকার হওয়ার দক্ষতা ও যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে তাঁদের কোনো মূল্যায়ন হলো না।


প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা যে মোগল সম্রাটের চেয়েও বেশি, তা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সহকর্মী, মন্ত্রী জি এম কাদের সম্প্রতি এক প্রবন্ধে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমিও আমার প্রতিক্রিয়া লিখেছি, যা প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এত ক্ষমতা, যার প্রতিটিই সংবিধানসম্মত। আবার একই ব্যক্তি দলেরও প্রধান এবং গঠনতন্ত্র তাঁকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছে। ক্ষমতার এই চরিত্রটা একনায়কের।

এখন আমাদের বড় দলগুলোর নেতা, সদস্য এবং দলের সাংসদেরা যদি একনায়ক নেতৃত্ব পছন্দ করেন, সংসদে ও দলের মধ্যে যদি অনুগত থাকতে পছন্দ করেন, তাহলে কার কী বলার থাকতে পারে। কিন্তু এতে সার্বিকভাবে দেশের ক্ষতি হচ্ছে, রাজনীতির ক্ষতি হচ্ছে, গণতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে। তবে লাভ হচ্ছে কিছু রাজনীতিকের। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, কিছু রাজনীতিকের লাভ বা স্বার্থ বজায় রাখার জন্য আমরা সবাই মিলে দেশের ও গণতন্ত্রের ক্ষতি করছি।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, আমরা এ কথা বলে শেখ হাসিনার সমালোচনা করছি।

না, তা ঠিক নয়। রাজনীতিতে শেখ হাসিনা অস্থায়ী চরিত্র। আগে যাঁরা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাঁরাও অনুরূপ ক্ষমতা ভোগ করতেন; অন্তত সংসদীয় আমলে। ব্যক্তি এখানে মুখ্য নন, আজ আছেন, কাল না-ও থাকতে পারেন। কিন্তু সংবিধান স্থায়ী।

যদি সংবিধানের ক্ষতিকর ধারাগুলোর পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে যুগের পর যুগ নির্বাচিত ‘প্রধানমন্ত্রীরা’ মোগল সম্রাটের চেয়েও বেশি ক্ষমতা ‘বৈধভাবে’ ভোগ করবেন। বড় দল দুটি গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালনা করতে চাইলে দলের গঠনতন্ত্রেরও নানা ধারা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু কে করবে? দলের নেতা, কর্মী ও সদস্যরা যদি ‘চির অনুগত’ হয়ে থাকতে চান, তাহলে তাঁদের অনুপ্রাণিত করবে কে? দুঃখ একটাই, তাঁরা সবাই মিলে দেশের রাজনীতির ও গণতন্ত্রের ক্ষতি করছেন। কিন্তু নাগরিক সমাজও এর বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিতে পারছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা কথা আজকাল প্রায়ই বলেন, ‘অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে সরকার বহাল রেখে নির্বাচন হয়, আমাদের দেশেও সে রকমভাবে নির্বাচন হবে।

’ প্রধানমন্ত্রী একটুও ভুল বলেন না। আমরাও মনে করি, আমাদের দেশেও সে রকম পদ্ধতিতেই নির্বাচন হওয়া উচিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেন না, তা হলো আমরা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নই। আমাদের সংসদীয় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নয়। সেখানেই যত গোলমাল।

প্রধানমন্ত্রী যদি এই বাস্তবতা স্বীকার করতে পারতেন, তাহলে সরকার বহাল রেখে নির্বাচনের দাবি করতেন না। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে আমাদের অমিলগুলো কী কী? আমাদের প্রধান বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে না, তারা পুরো সময়ে রাজপথে নানা দাবি নিয়ে আন্দোলন করে, বিরোধী দলের ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ নেই, বিরোধী দল সচরাচর কোনো বিকল্প নীতি উপস্থাপন করে না; শুধু সমালোচনা করে।
অন্যদিকে সরকার বিরোধী দলকে কোনো গুরুত্ব দেয় না, তাদের সরকারের অংশ মনে করে না, সরকারের কোনো কাজে কখনো বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে না, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মধ্যে আলোচনা দূরে থাক, সৌজন্য বাক্যালাপ বা কুশলবিনিময় পর্যন্ত হয় না। সরকার বিচার বিভাগ ও সরকারি প্রশাসনের বড় অংশকে দলীয়করণ করেছে, নিজ দলের সমর্থক নয়—এমন তিন শ সরকারি কর্মকর্তাকে ওএসডি ও কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে, বহু সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য দলীয় লোকদের নিয়োগ দিয়েছে, বিরোধী দল বা নিরপেক্ষ নির্দলীয় ব্যক্তিরা কোথাও সরকারি আনুকূল্য পান না (ব্যতিক্রম খুব কম)। অনেক ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তি নানাভাবে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, বেশ কয়েকটি বড় মাপের দুর্নীতিতে সরকারি ব্যক্তিরা অভিযুক্ত হয়েছেন।

ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন কমিটিকে উপেক্ষা করে তাঁদের অনুগত কয়েকজন নেতার মাধ্যমে দল পরিচালনা করেন, দলের ত্যাগী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মূল্যায়ন করেন না, পারিবারিক ও অনুগত নেতাদের ওপর নির্ভর করেন, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মন্ত্রীকেও দপ্তরহীন মন্ত্রী করে রাখা হয়, সংসদ ও সরকার পরিচালনায় সংসদীয় পদ্ধতির কোনো বৈশিষ্ট্য মানা হয় না। ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়’ নামে একটি দপ্তর সৃষ্টি করে কার্যত মন্ত্রীদের অধিকার ও ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ‘উপদেষ্টা’ পদ সৃষ্টি করে (সংবিধানে যা নেই) মন্ত্রীদের ঠুঁটো জগন্নাথ করা হয়েছে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ রকম আরও বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। সরকার ও আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এই বৈশিষ্ট্যগুলো অস্বীকার করতে পারবেন? অন্য কোনো সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে এ রকম ব্যবস্থা, সংবিধান, সংসদ, মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (যেখানে সব মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তমূলক ফাইল বাধ্যতামূলকভাবে পাঠাতে হবে) বিরোধী দলের ভূমিকা, সরকারি প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দলীয়করণ রয়েছে? আওয়ামী নেতা বা দলের সমর্থক কলামিস্ট কি দেখাতে পারবেন, আমাদের দেশের মতো অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে রয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো চলমান সরকার বহাল রেখে নির্বাচনের কথা বলেন, তখন অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের রাজনীতি চলছে কি না, তা বলেন না। এখানেই তাঁর ফাঁকিটা ধরা পড়ে।

এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া ও বিএনপির দায়ও কম নয়।
আগে আমাদের দেশের সরকার, সংসদ, বিরোধী দল, সরকারি দল, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, প্রধান রাজনৈতিক দল—প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের আলোকে পরিচালিত হোক, তারপর চলমান সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে কারও আপত্তি হবে না বলেই মনে হয়। সেটাই তো ঐতিহ্য। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের জন্য অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ডেকে আনার কোনো প্রয়োজন দেখি না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি জনসমক্ষে প্রতিজ্ঞা করে, আগামী নির্বাচিত সরকারের আমল থেকে তারা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের সব বৈশিষ্ট্য ও শর্ত মেনে সরকার, সংসদ, প্রশাসন ও বিরোধী দল পরিচালনা করবে, তাহলে ২০১৪ সালের পরের সংসদ নির্বাচন চলমান সরকারের (অন্তর্বর্তী সরকার) পরিচালনায় করতে কেউ আপত্তি করবে বলে মনে হয় না।

তবে যদি আগামী নির্বাচিত সরকার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই আচরণ করে, তাহলে নির্বাচনের আগে আবার ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবিতে আমরা সোচ্চার হব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি নিজেদের পরিবর্তন করতে সম্মত হয় ও তা বাস্তবে রূপ দেয়, তাহলে এর পরেরবার থেকে আমরা ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে পারব।
অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নির্বাচিত চলমান সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে হলে আমাদেরও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রশাসনিক সংস্কৃতি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে। তার আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা না বলাই শ্রেয়। কারণ, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত হয় না।


অনেকেই মনে করেন, সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তাদের সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। এটা বড় রকম সুবিধাবাদিতা। বর্তমান সংসদের মেয়াদ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। বিএনপি এই সংসদে বিরোধী দলের কোনো ভূমিকা পালন করেনি। প্রায় পুরো সময়টায় তারা সংসদ বর্জন করেছে।

সংসদীয় রাজনীতিতে তারা অতীতের আওয়ামী লীগের মতোই একটি নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন আর আবেদন-নিবেদন নয়, টানা ১৫ বা ৩০ দিন সংসদ বর্জন করলে বড় মাপের দণ্ড বা সংসদ সদস্যপদ খারিজের মতো শক্ত আইন করা দরকার। বিএনপি তাদের ভোটারদের (বিজয়ী আসন) অপমান করেছে। তাদের কথা সংসদে বলেনি। সংসদ বর্জনের এই অপসংস্কৃতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

বিএনপি যত খোঁড়া অজুহাতই দেখাক, এ কথা তাদের মানতেই হবে, তাদের সাংসদেরা দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্য বিএনপির সাংসদদের ভোটারদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়ন ও মিডিয়াকর্মী। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।