ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটা এখন সুনসান। কে বলবে যে সারাটা দিন এই বাড়িটাকে কেন্দ্র করে কতশত মানুষ কিংবা রাজনীতিবিদের আনাগোনা লেগে থাকে? কে বলবে, এই বাড়িটাকে ঘিরেই দেশের সব আশা, ভরসা? ভবিষ্যতের সাফল্য ব্যর্থতার দোলাচল? কারণ এই বাড়িতেই তো থাকেন জাতির পিতা! গতবছর তার বজ্রকন্ঠে আকৃষ্ট হয়েই তো বাঙালি অস্ত্র ধরেছিল। লক্ষ প্রাণের বিনিময় অর্জিত বাংলাদেশের রূপকার তো তিনিই। তিনি শেখ মুজিব। তিনি এখন এই স্বাধীন বাংলার সর্বেসর্বা।
দেশের মানুষেরা যেন তিনি উঠতে বললে ওঠে, তিনি বসতে বললে বসে। কি নিদারুণ ক্ষমতার জৌলুস তার! কিন্তু তার কি সবই ঘরের বাইরে? বাড়ির ভেতরে, অন্দরমহলে তার জীবন সেই চিরাচরিত আটপৌরে সাধারণ বাঙ্গালির?
তা না তো কি!
নইলে চোরের মত ঘরে ঢুকছেন কেন শেখ মুজিব? তার মনে কি ভয় কাজ করছে না যে এই বুঝি জেগে গেল রেনু! সে এক নিদারুণ ভয়। সে ভয়ের উৎস তার বিবেক। আজ থেকে কত বছর আগে মাত্র তিন বছরের সদ্য বাপমরা মেয়েটাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তারই বা কত বয়স হবে তখন? এই বার মনে হয়।
নাকি আরেকটু কম? দশ এগার। আল্লাহই জানে! ছেলেমেয়েদের বয়স তো আর বাপ মা তখন মনে করে রেখে দিতেন না। প্রতি বছর যদি একটা করে নাজেল হয়, তাহলে কি আর মনে রাখার জো আছে! কে কোন ক্লাসে পড়ছে, তা থেকে অবশ্য একটা আন্দাজ করে নেয়া যেত। কিন্তু মুজিবের ক্ষেত্রে তো সে উপায়ও খাটবে না। চোখের সমস্যার কারণে তো ঠিকমত প্রতিবছর প্রমোশন পেয়ে পরের ক্লাসে উঠতেও পারেন নি তিনি।
আবার এমনিই বাবা কয়েক বছর লেখাপড়া মুলতবি রেখেছিলেন তার এই ছেলের।
সেই রেনু তো পরের কত বছরেও বুঝতে শেখে নি স্বামী-স্ত্রী মানে কি। খোকা নামের ছেলেটার সাথে কিই বা তার সম্পর্ক। শুধু জানত খোকা তার দুলাহ। হয়ত দুলাহ খুব আপন কেউ হয়।
তাই তো দুলাহর বাড়িতে থাকত সে। শুধু তাই না। দুলাহর বাবাকেই বাবা ডাকত, মাকে মা। দুলাহর সাথেও কেমন যেন ছিল ভাইবোনের মত সম্পর্ক। সেই দুলাহর কাছেই তো পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়েছিল মিষ্টি এই মেয়েটির।
তারপর আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল সে। বুঝেও গেল একসময় যে খোকা নামের সেই ছেলেটা, যাকে সে দুলাহ ডাকে, সেই দুলাহর সাথে তার সম্পর্কের কি মাহাত্ম্য। ক্রমে একসময় তাদের মিলনও হয়। একসময় বাচ্চা থেকে কিশোরীতে পরিণত হওয়া মেয়েটির গর্ভে জন্ম নেয় হাসু। এভাবেই বিধাতার কি নির্মম পরিহাস! স্বামীকে কাছে পাওয়ার দিনগুলো কাটতে না কাটতেই মাতৃত্বের স্বাদ পায় মেয়েটি।
তখন মুজিবেরই বা কত বয়স? তার ওপর বেরিবেরি রোগে কয়েক বছর হারানোর পর মুজিব সবে কলেজ পড়ুয়া।
কিশোরী মেয়েটার তাই কন্যাসন্তানকে নিয়ে গ্রামেই পড়ে থাকতে হয়। মনে আশা, কখন দুলাহ ফিরবে! কিন্তু দুলাহকে সে সেই যে শহরে কলেজে পড়তে ছেড়েছিল, সেই কি প্রকৃত মায়ার বন্ধন মুক্ত করে ছেড়ে দেওয়া নয়? তারপরও তো তার দুলাহ কতবার গ্রামে এল ছুটিতে, মিলন হল দুজনকার। তারই পরিপ্রেক্ষিতেই জন্ম নিল তাদের আরও চার সন্তান। কিন্তু যতদিন না সে এসে গ্রামে থেকেছে, তারচেয়ে বেশি তো তার রাজনীতির ফাঁদে পড়ে জেলের চার দেয়ালে কাটাতে হয়েছে।
তারপরে কালের পরিক্রমায় আরও কত কিছুই তো হল। আওয়ামী লিগের কত বড় নেতা হল তার দুলাহ। কিন্তু তার সেই দুলাহর তো তখন সারাবেলা কাটত রাজনীতিকে নিয়ে। আর মাঝে মাঝে জেলে ঢুঁ মেরে এসে! পরে অবশ্য তার দুলাহ তাকে নিয়ে এসেছে ঢাকা শহরে। কিন্তু তখনো বা সে কিই বা পেয়েছে দুলাহর কাছে? বরং কাছে কাছে থাকার সুবাদে দুলাহর রাজনৈতিক উৎকণ্ঠা প্রত্যক্ষভাবে অনুধাবন করেছে, এই-ই যা।
তারপর গত বছরই তো তাকে হানাদাররা আটকে রেখেছিল যুদ্ধের গোটা সময়টা। ছেড়েছে এবছর। কিন্তু তাতে তো তার দুলাহর ব্যস্ততা কাতে নি। বরঞ্চ নতুন এবং সুবিশাল দায়িত্ব এসে পড়েছে ঘাড়ে। গোটা দেশ কেন্দ্রীয় ভাবে নেতৃত্বের দায়িত্ব।
এরকম করে করে আর কবে রেনু কাছে পেল তার দুলাহকে? বলা ভার!
রেনু হয়ত তাকে নিঃস্বার্থে ক্ষমা করে দিয়েছে। ক্ষমা করে দিয়েছে এই অপরাধ থেকে যে তার দুলাহ তাকে, তার সন্তানদের কখনো সময় দিতে পারল না। সেই সময়টা, যেটা স্বামী-স্ত্রীর কেবল নিজেদের, নীরব-নিভৃতের, ভালবাসার, কাছে আসার। সেই সময়টা যেটা এক পিতার তার সন্তানদের প্রগাঢ় স্নেহ দেবার। কিন্তু মুজিব নিজেকে কি নিজে ক্ষমা করতে পারছেন? মধ্য বয়স ছেড়ে যখন আজ সে বার্ধক্যের দোরগোঁড়ায়, তখন কি তার বিবেক তাকে বলছে না যে তুমি একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করেছো? সন্তানদের পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করছও।
অবশ্যই বলছে। তার আরও খারাপ লাগছে এই কারনে যে রেনু আজও হয়ত তার দুলাহর জন্যে ভাত সাজিয়ে নিয়ে বসে ছিল। আর সে কিনা সেই প্রতীক্ষাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে বাড়ি ফিরল এই রাত সাড়ে বারটায়।
^^^^^^^^^^^^^^^^^ ^^^^^^^^^^^^^^^^^
মুজিব ঘরে ঢুকেই চমকে গেলেন। হায় হায়! রেনু তো এখনো ঘুমোয় নি।
তারজন্যেই বসে আছে। বিছানার ঠিক মাঝখানটায়। মুজিব মনে মনে ভাবলেন, 'নাহ! এত লুকোচুরি করে এসেও লাভ হল না। কাল সকালে উঠে যে রেণুকে বলতাম যে তুমি ঘুমানোর কিছু বাদেই ফিরে এসেছি, তাও হল না!'
রেনু তার পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকে দেখলেন। দেখে প্রথম কথাটি বললেন, 'খেয়ে এসেছ নাকি?'
মুজিব তখন আরেকবার মনে মনে হায় হায় করতে লাগলেন, 'কি সর্বনাশ! রেনু যে আমার জন্যে না খেয়ে এখন অব্দি বসে আছে!' কিন্তু মুখে তিনি আমতা আমতা করে বললেন, 'আসলে আজ একটা পার্টির থেকে খানাদানার ব্যবস্থা ছিল।
'
রেনু ঝাঁঝাল স্বরে অভিমানের সাথে বললেন, 'তা তো তোমার রোজই কোন না কোন প্রোগ্রাম থাকে!'
মুজিব কেমন যেন রেনুর গলার স্বরে ভৎসর্নার অভিব্যক্তি টের পেলেন। তাই তাড়াতাড়ি বললেন, 'না না! আজকের ব্যাপারটা সম্পুর্ন আলাদা। আজ যে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়ে আসলাম!'
'কি এমন ঘটনা, শুনি?'
'বলছি বলছি দাঁড়াও। তার আগে বল হাসুরা সব কোথায়?'
'ওরা কি এতরাতে তোমার অপেক্ষায় জেগে বসে আছে নাকি! তুমি বল কি বলছিলে। '
'হু বলছি।
...কিন্তু তোমার কি মনে ছিল না যে আজ নভেম্বরের ৪ তারিখ? এতদিন ধরে যে পত্র-পত্রিকায় বেরোচ্ছে যে আজকে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান চূড়ান্তভাবে গৃহীত ও প্রণীত হবে?'
'বেরিয়েছিল নাকি পত্রিকায়? কই, আমার তো চোখে পড়ে নি!'
'সে তোমার পড়েনি তা তো অন্য কারনে। ম্যাগাজিনে নাচা-গানার খবর ছাড়া আর কিছু তুমি পড় নাকি!'
'হয়েছে হয়েছে! এখন বল দেখি আমায়, সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা?'
'হয়েছে মানে! আলবৎ হয়েছে। তা তুমি কি সন্ধ্যার দিকে কোন মিছিলের আওয়াজ পাও নি?'
'হ্যাঁ হ্যাঁ। সন্ধ্যার দিকে একবার জয়বাংলার আওয়াজ শুনেছিলাম বটে। তবে তা তো গত একবছর ধরে প্রায়ই হচ্ছে।
তোমরা নতুন কি না কি করছ আর তাতেই দেশের লোকে লাফাচ্ছে। '
'না না না! আজকের সাথে অন্যদিনের তুলনা কর না। আজকের এই সংবিধান মেনেই তো ভবিষ্যতে স্বাধীন বাংলাদেশের সমস্ত রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে! এই সংবিধান মেনেই তো সোনার বাংলা গড়ে তুলব আমরা!'
'আহ! এমন ভাষণ তো রোজই দাও। তারপর কি হল বল। কে কে ছিল এতে?'
'উম! মনে করে নি দাঁড়াও... হু মনে পড়েছে।
সংবিধান লেখার সময় খসড়া পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহবায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মযহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম আমরা। '
'আলি আহসান? কোন আলি আহসান বল তো? ঐ সে নাকি যে আগে পশ্চিম বাংলার কম্যুনিস্ট ছিল আর সেখান থেকে রাতারাতি ডিগবাজি খেয়ে নকশালদের সাথে নাম লেখাল?'
'না না সে অন্য আলি আহসান। সে তো সৈয়দের ব্যাটা না! কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে তুমি সেই আহসানের ওপর বেজায় রাগ! তার নাম উচ্চারণ করার সময় নাক-মুখ পুরো কুঁচকে ফেললে!'
'ও মা! এতে দোষের কি হল? আর রাজনীতিতে যে এরকম কদর্য ডিগবাজি দিতে পারে, সে কি ভাল মানুষ নাকি?'
'তুমি দেখছি ব্যাপারটাকে একদম রাজনৈতিক চোখে দেখছ!'
'নেতার বউ হলাম কি আর সাধে!'
'না না। আসলে এরকম ভাবে তো তখনকার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল তাকে নিয়ে। বোঝা যাচ্ছে সেগুলো তোমার চোখেও পড়েছে।
নাহ! তুমি প্রমাণ করেই দিলে যে তুমিও মাঝেসাঝে পত্রিকার পাতা উলটাও!'
'পত্রিকায় ওরকম লিখেছে মানে কি? তোমার কি তার সম্পর্কে অন্য অভিমত?'
'আসলে আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে যে সব মানুষেরই তো মাঝেসাঝে ভীমরতি হতে পারে। আহসানেরও অনেকটা তাই হওয়ায় নকশালে ভিড়েছিল। কেন, তোমার কি কখনো কোন পুরুষকে দেখে মনে হয় নি যে না, এ তোমার দুলাহর চেয়ে ভাল হতে পারত স্বামী হিসেবে!'
'নাহ হয় নি। কিন্তু কেন তোমার এমন হয়েছে নাকি? রাজনীতির নামে কি সেই কারণে রোজ রাতে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়!'
মুজিব এ পর্যায় কৌতুক করে হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, 'না আসলে তা না! তবে জেলে থাকতে লাস্ট বছর যখন অন্যের মুখে 'মুজিব-ইন্দিরা জিন্দাবাদ' শুনতাম, তখন যে বুকের ভেতর কেমন একটা করত না, তা বললে ভুলই হবে!'
কিন্তু রেনু এ কথায় আচমকা চিৎকার করে উঠে বললেন, 'কি! আমি কালই গ্রামের বাড়ি চিঠি দিয়ে জানাব যে তাদের ছেলেকে এই বুড়ো বয়সে শাঁকচুন্নিতে পেয়েছে!'
মুজিব তখনই রেণুর হাত ধরে টান দিয়ে তাকে বুকে নিয়ে এলেন। তারপর ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করে বললেন, 'আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে কি নিজের বউয়ের সাথে একটু তামাশাও করতে পারব না!' এই বলে তিনি রেনুর কপালে একটা চুমু খেলেন।
অনেকদিন পর আজ নিজেকে অনেক চাঙ্গা লাগছে মুজিবের। ভিন্ন রকমের শিহরণ হচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখনই তারা শুনতে পেলেন মিষ্টি একটা আওয়াজ, 'কিসের ঐতিহাসিক ঘটনা আব্বা?'
তারা চোখ ফিরিয়ে দেখেন তাদের ছোট্ট ছেলে রাসেল দাঁড়িয়ে। সাথে সাথে রেনু ছিটকে দূরে সরে গেলেন। দুষ্টু রাসেলটা কি সব দেখে ফেলল! কিন্তু রাসেলের কিন্তু আগ্রহ সেদিকে না।
গত একবছর ধরে 'ঐতিহাসিক' শব্দটার বহুল ব্যবহার শব্দটাকে তার প্রিয় করে তুলেছে। এমন আর দুটো তার পছন্দের শব্দ হল 'বিজয়' আর 'স্বাধীনতা'। তো সে আবার জিজ্ঞেস করলও, 'আব্বা তুমি মাকে আদর করছ কর না! কিন্তু তার আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। '
রেনু অম্নি খাট থেকে উঠে তার কান মলে দিয়ে বলল, 'এইটুক ছেলে তার দ্যাখ কি পাকা পাকা কথা! কি পাজিটাই না হয়েছে। আর এই রাতদুপুরে তোমার বাজখাই গলা শুনে উঠে এসেছে।
একটু আস্তে কথা বলতে পার না!'
মুজিব তখন হাসতে হাসতে বললেন, 'একটু আগে তো তুমিই আচমকা জোরে চিক মারলে! এখন দোষ আমার! রাসেল ব্যাটা! এদিক আমার বুকে আয় তো!' রাসেল সাথে সাথে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমন কাছ থেকে বাবাকে পাওয়ার সুযোগ তো ইতিপূর্বে খুব বেশিবার সে পায় নি। তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে মুজিব বললেন, 'বল তো ব্যাটা! কার গলার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গেছে তোর?'
দুষ্টু রাসেল তখন মুচকি হেসে বলল, 'মার। ' একথা শুনে মুজিব অম্নি হাসতে আরম্ভ করল বিকট শব্দে। বাবার হাসি দেখে রাসেলও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগলো।
পিতা-পুত্রের হাসি দেখে রেনুও নিজেকে সামলাতে পারলেন না। তিনিও হাসিতে যোগ দিলেন। তারপর খাটে উঠে এসে হাসতে হাসতেই রাসেলের কান মলে দিয়ে বললেন, 'কি পাজি হয়েছে রে বাবা!' রাসেল কিন্তু বুঝল, এটা আসলে মার নয়, মায়ের আদর। তাই জীবনে প্রথমবারের মত একসাথে বাবা-মায়ের গলা একসাথে জাপটে ধরল সে দুইহাতে। মুজিবের চোখে আনন্দাশ্রু চলে এলো।
এ মুহুর্ত কি তার জীবনের অন্যতম পরম আকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত নয়? রাজনৈতিকদের কি ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতি থাকতে পারে না? তিনি এবার ছোট্ট রাসেলকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় তার ক্ষুদ্র দেহটাকে ভরিয়ে দিলেন।
রাসেল আবার জিজ্ঞেস করল, 'বল না বাবা কি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা বলছিলে?'
মুজিব মনে মনে ভাবলেন, এটুক শিশু কি আর বুঝবে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার মাহাত্ম্য? তাই তিনি রাসেলের চুলে হাত বুলাতে বললেন, 'ওরে ব্যাটা, আজ যে ব্যবস্থা করে আসলাম যাতে এ দেশটাকে একদিন সোনার বাংলাদেশ করে গড়ে তুলতে পারিস!'
রাসেল অতকিছু জানে না। শুধু এটুক সে শুনেছে যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি! তাদের পাঠ্যবইসমূহে নতুন নতুন তথ্য সংযোজন করা হচ্ছে আর তা আত্মস্থ করতে শরীরের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে সব ছেলেমেয়েদের। তাই এখন যদি নতুন কোন 'ঐতিহাসিক' ঘটনা ঘটেই থাকে, তবে সে সম্বন্ধেও তো বইতে উঠবে আর একগাদা নতুন তথ্য মুখস্ত করার দায় চাপবে ছাত্রছাত্রীদের কাঁধে। আর এসবে বড্ড ভয় রাসেলের।
পড়ালেখায় যে একদমই মন নেই তার! তাই সে ভয়ে ভয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলও, 'তাহলে কি বাবা সামনের বছর থেকে পড়ার বইতে আজকের দিনের কথা, আজকের কথা থাকবে?'
মুজিব হেসে বললেন। 'না রে ব্যাটা! আজকের কথা থাকবে না। আজকের ঘটনাটা যেদিন পূর্ণতা পাবে সেদিনের কথা থাকবে। '
'সেটা কবে হবে বাবা?'
'এই তো যতটা শীঘ্রি সম্ভব। '
রাসেল শুনে আঁতকে উঠল, 'না না বাবা।
তাড়াতাড়ি সেটা কর না। এমন কোনদিন কর যেদিনটা মনে রাখতে সুবিধা হবে। '
'কেন রে ব্যাটা! তাতে তোর এত মাথাব্যথা কিসে রে?'
'বা রে! এটা নর্মাল কোন তারিখে হলে যে সেদিনের তারিখও কষ্ট করে মনে রাখতে হবে। '
মুজিব ছেলের কথা শুনে হয় হয় করে হেসে উঠে বললেন, 'ও! এই ব্যাপার। তুই তো সত্যিই ভারি পাজি হয়েছিস! তাহলে বল শুনি কবে সেটা করব?'
রাসেল মাথা চুলকে বলল, 'কেন! ১৬ই ডিসেম্বর কর! ঐ দিনটার কথা আমি এতবার শুনেছি যে আর কোনদিন ভুলব না!'
মুজিব ভেবে রেনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তাহলে ছেলের আবদার শুনিই।
কি বল? তাছাড়া এমনিতেই সংবিধানের খসড়াটা রিভিশন দিতে আরও কটাদিন লাগবে। তাহলে এই ১৬ই ডিসেম্বর থেকেই বরং সেটা কার্যকর করি। '
'তার আমি কি জানি! তোমার রাজনীতির কোন ক্ষতি না হলে তা-ই কর বরং। কোনদিন তো ছেলের কোন আবদার তো শুনলে না। এই একটা আবদার শোন।
'
রাসেল এতক্ষণ বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে তাদের কথা গিলছিল। মুজিব এবার ছেলের দিকে ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা যা। তোর কথাই থাকল রে ব্যাটা! ১৬ই ডিসেম্বরেই কার্যকর হবে ঐতিহাসিক ঘটনাটা। '
রাসেল বাবার মুখে এ কথা শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলল, 'থ্যাংক ইউ আব্বা! ইউ আর দি বেস্ট আব্বা!' এই বলেই সে মুজিবকে জোরসে জড়িয়ে ধরল। মুজিবও দুহাত দিয়ে ছেলের পিঠ আঁকড়ে ধরে পিতা-পুত্রের এই মধুর আলিঙ্গনকে পূর্ণতা দিলেন।
মুজিব ঐ অবস্থায়ই রেনুর দিকে তাকালেন। সেই তাকানোই বলে দিচ্ছিল অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। সত্যিই তো। কখন যে তার এই সর্বকনিষ্ঠ সন্তানটি এত বড় হয়ে গেল, কে জানে। কোন সন্তানের দিকেই তিনি বিশেষ নজর দিতে পারেন নি বটে, তবু এ ছেলের জন্মের পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এতটাই উন্মাতাল হয়ে গেল যে এই ছেলেটাকে সে ভাল করে কখনো আদর করবারও সুযোগ পায়নি।
সে ছেলেই কিনা তার বাবা তার সামান্য আবদার রেখেছে বলে তাকে বলছে বেস্ট বাবা! এ কি একজন অসমর্থ বাবা হয়েও তার আকস্মিক জয়লাভ নয়? সারা জীবন আন্দোলন করে তিনি এই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। তবু মেঘ না চাইতে জলের মতই তিনি আজ যে অপার ভালবাসা লাভ করলেন নিজের ঔরসজাত পুত্রের থেকে, সে অর্জনও কি কোন অংশে কম?
মুজিব এবার ছেলের মাথা হাত দিয়ে তুলে ধরে দেখলেন তার দুরন্ত এই ছেলেটা বাবার বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে তাকে নিয়ে বিছানায় ভাল করে শুইয়ে দিয়ে রেণুকে বললেন, 'ও আজ আমাদের মাঝেই শুক, কেমন?'
পিতা পুত্রের মিলন দেখে রেনুর চোখও জলে ভোরে গেছে। সে সেই জল আড়াল করে অস্ফুট স্বরে বললেন, 'আচ্ছা!'
এই বলেই রেনু হু হু করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এ কান্না বিজয়ের, গৌরবের।
যে স্বপ্ন তিনি এতদিন দেখে এসেছেন, যে কোমল হৃদয়ের পিতা মুজিবের স্বপ্ন এতদিন সে আলিঙ্গন করেছেন, যে শুধুই পিতা মুজিব, নন কোন নেতা, নন কোন বিপ্লবী বিদ্রোহী ---- সে স্বপ্ন যে আজ তার চোখের সামনে বাস্তবে রূপ নিল। রেণুকে কাঁদতে দেখে মুজিবও রেণুকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
তাদের এই কান্না হয়তবা খোদার দরবারকেও কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ মুজিবকে বর দিয়েছিলেন এমনকিছু যার বদৌলতে মুজিব লাভ করলেন প্রায় সপরিবারে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের এক সুবর্ণ সুযোগ।
# রেনু হল ফজিলাতুন্নেছার ডাক নাম।
খোকা শেখ মুজিবের ডাক নাম। তাদের বিয়ে প্রকৃতই রেনুর ৩ ও মুজিবের ১০ বছরে হয়েছিল। অনেক স্থানে আপনারা দেখবেন যেখানে মুজিবের বিবাহের বয়সকাল দেওয়া ১৮ বছর। মূলত সেটি তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ের সময়কার কথা। তখন রেনুর বয়স ছিল ১১।
# আমি এই লেখার একস্থানে শেখ মুজিবের উদ্ধৃতিতে বলেছি যে আলি আহসানের নকশালে নাম লেখানো ছিল তার ভীমরতি। তবে পাঠক আবার এই বুঝবেন না যে আমি বুঝাতে চেয়েছি শেখ মুজিব নিজেও কম্যুনিস্টদের সমর্থক ছিলেন। আসলে তিনি আলি আহসানের রাজনৈতিক ডিগবাজিকে ভীমরতি বলেছেন। আবার এ থেকেও আপনারা ধরে নেবেন না যে তিনি রাজনৈতিক মতান্তরের বিরোধী ছিলেন। মূলত তিনি আহসানের এক খারাপ পথ থেকে অন্য অপেক্ষাকৃত আরও খারাপ পথে যাওয়াকে ভীমরতি বলেছেন।
আহসান যদি এসব বিতর্কিত পথ ছেড়ে রাজনীতির মূল স্রোতে ফিরতেন, তবে মুজিব অবশ্যই তাকে সাধুবাদ জানাতেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।