আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক টুকরো জমি ও তার অন্তরালের গল্প

আমার জীবনের একটি সত্য ঘটনা এটি। ঘটনার সূত্রপাত হয় প্রায় ৩৮ বছর আগে, ১৯৭৪ সালে। বলে রাখা ভাল, শতাব্দীকাল ধরে আমাদের বংশের প্রধান পেশা মৎস্য-ব্যবসা আর ঘের করা। আমার দাদাও সে বৃত্ত থেকে বের হন নি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি তার ব্যবসার সব কিছুই হারান।

তাই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের ব্যবসা পুনরায় গোছাতে আরম্ভ করেন এবং তারই সূত্র ধরে প্রতি ৩-৪ মাস অন্তরই নতুন নতুন ঘের কিনে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে উদ্যোগী হন। এমন একটা সময় (১৯৭৪ সালে), এক লোক এসে প্রায় জোর করেই খুব কম দামে তার কাছে ৩ শতক জমি বিক্রি করেন। যদিও এ ঘটনা দাদা নিজে থেকে কাউকে জানাননি, জানানোর সুযোগই পান নি। কারণ ঐ বিক্রেতার সাথে প্রাথমিক কথাবার্তার সপ্তাখানেক পরই দাদা দলিল-দস্তাবেজের মাধ্যমে জায়গাটা কিনে নেন এবং সে রাত্রেই ঘুমের মধ্যে তিনি হার্ট এটাক করে মারা যান। যাইহোক, দাদার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবার ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ে কেননা নতুন জায়গা কেনার জন্য আমার দাদা বিভিন্ন স্থান থেকে টাকা ধার করেছিলেন।

এমন পরিস্থিতিতে আমার বাবাকে তার পড়ালেখা জলাঞ্জলি দিয়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় এবং তিনি তার বাবার ব্যবসা এবং ঘের দেখাশোনা করতে থাকেন। তিনি দায়িত্ব নেবার পরদিনই সেই ব্যক্তি, যার জায়গা দাদা সর্বশেষ কিনেছিলেন, তিনি এসে বাবাকে বিক্রিত জায়গা বুঝিয়ে দিতে চান। ঐ ব্যক্তির আগমনে বাবা অনেকটা অবাকই হন কারণ ঐ জমি কেনার কথা তো তিনি আগে শোনেনই নি। যাইহোক, বাবা অনেকটা আগ্রহের বশেই ঐ লোকের কাছে জানতে চান, ‘যা দিনকাল পড়েছে, সবাই অন্যকে ঠকানোর ধান্দায় রয়েছে আপনি এমন সময়ে আমাদের সম্পূর্ণ অজানা একটা জমি আমাকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন? আপনি তো এই জমি বিক্রির কথা চেপেও যেতে পারতেন!’ তখন সেই ব্যক্তি বলেন যে, ‘তোমার অবস্থা আমি বুঝেছি বলেই তো এমনটা করছি। তুমি তো শুধু তোমার বাবাকে হারালে, আর আমিতো আমার বউ-ছেলে দুজনকেই হারালাম।

’ তখন বাবা জানতে পারেন যে, দাদার কাছে জমি বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে যাবার মাত্র দুই রাত আগেই তার স্ত্রী-পুত্র মারা গেছেন। এবং আরও জানান যে, মৃত্যুর আগে ঐ জমিতেই তার স্ত্রী-পুত্র তার সাথে থাকতেন। জমি বুঝিয়ে আর সব কথা খুলে বলে সেই যে ঐ লোক সেদিন চলে গেলেন, এরপর আমার বাবা বা পরিবারের আর কারো সাথে তার আর দেখা হয় নি। আমার বাবা পরবর্তীতে ঐ জমিতে যে পুকুর আছে, তা সামান্য বড় করে মাছ চাষ করার চেষ্টা করেন কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ঐ জমিতে তিনি জীবিত মাছের চাষ করতে পারেন নি। মোট ৩ বার তিনি পানিতে পোনা ছাড়েন এবং কোন অজ্ঞাত কারণে প্রতিবারই দেখা গেছে যে পুরো পুকুর শুদ্ধ সব মাছ মারা গেছে।

এরপর কেটে যায় ৩৪ বছর। দীর্ঘদিন সফলতার সাথে মাছ ব্যবসা করলেও ২০০৮ সালের দিকে বাবা অর্থ সঙ্কটে পড়েন। অনেকটা বাধ্য হয়েই পুনরায় তিনি উক্ত জমিতে মাছ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মাছ ছাড়ার দিন রাতেই বাবার ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয় এবং ৩ দিন হাসপাতালে থাকার পর বাবা মারা যান। এরপর পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে আমারও মৎস্য ব্যবসায় আসার কথা থাকলেও আমি তা করি নি।

আমি ঐ সময় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলাম এবং বুয়েট থেকে আমি ২০১০তে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হই। যাইহোক, গত নভেম্বর মাসে আমি আমার বাড়ি (বাগেরহাট) আসি। তারপর স্থানীয় বন্ধুদের সাথে পিকনিক করার সিদ্ধান্ত নেই এবং আলাপ আলোচনা করে উক্ত ঘেরটিকে বেছে নেই কারণ জায়গাটা গ্রামে আর সম্পূর্ণ কোলাহলমুক্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা, ঐ জায়গার আশেপাশেও বর্তমানে ঘের। ঘেরের পাশে আমাদের অংশের যে জমিটুকু, তা দেখতে ছোটখাটো একটা দ্বীপের মত কারণ চারিদিকেই পানি।

এককথায় পিকনিকের জন্য অসাধারণ। তো, আমরা পিকনিকে গেলাম। আমার সাথে আরও তিন জন। সেটাই ছিল আমার ঐ স্থানে প্রথম যাত্রা। গিয়ে অবাক হলাম এই দেখে যে আশপাশের সব মাটি স্বাভাবিক হলেও আমাদের অংশের মাটি টকটকে লাল।

পানির রঙও কেমন যেন লালচে। তবে গ্রামের দিকে এমন হতেই পারে, এই ভেবে তা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। তবে আরেকটা জিনিস লক্ষ করলাম যে, আমাদের অংশের ওপর দিয়েই কেবল সা সা করে বাতাস হচ্ছে আর মাটির ধুলো উড়ে ধূলিঝড়ের মত হচ্ছে। তবে পিকনিকের আনন্দে এ ব্যাপারটাও গা করলাম না। তো, আমরা সারাদিনটা খুব এঞ্জয় করলাম।

রাত ১২.৩০ এর দিকে পিকনিক শেষ হল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম রাতটা ওখানেই যে ছোট্ট কুঁড়েঘর আছে সেখানে কাটিয়ে দেবার। তো সব গোছগাছ করতে করতে ১টার মত বেজে গেল। আমি তখনএকটু প্রস্রাব করার জন্য পুকুরের দিকে নির্জনে গেলাম। গিয়ে আমার ভয়ে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

কেননা যা দেখলাম, তার চেয়ে লোমহর্ষক হয়ত আর কিছু হতে পারে না। দেখলাম, পুরো পুকুরের পানির রঙ টকটকে লাল। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওটা আসলে রক্ত। আর ঐ রক্ত প্লাবিত হয়ে পাড় বেয়ে মাটিতে উঠে এসে মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি একদম শিওর যে ওটা রক্তই ছিল কারণ রক্ত আমার পায়েও লাগছিল এবং আমি টা অনুভবও করেছি।

আমি প্রচণ্ড ভয়ে জ্ঞান হারালাম। কিন্তু অচেতন অবস্থায়ও আমি অবচেতন মনে বুঝতে পারলাম যে, বাবা-দাদার মত আমারও মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। আমিও হার্ট এটাক করলাম, অবশ্যই প্রচণ্ড ভয়ে, হার্ট-বিট মিস করে। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের আশীর্বাদেই বলুন আর ডাক্তারদের কর্ম দক্ষতায়ই বলুন, আমি এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ৩ সপ্তাহ পর মোটামুটি সুস্থ হলাম।

তারপরের সপ্তাহটা হয়ত আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমি আমাদের ঘেরটা যে গ্রামে, সেখানে ফিরে গেলাম। গোয়েন্দা হিসেবে নিজের কৃতিত্বে নয় বরঞ্চ অনেকটা ভাগ্যের সহায়তায়েই গ্রামের এক বৃদ্ধার কাছে আমাদের ঐ জমির পূর্ব মালিকের পরিচয় এবং তার দেশের বাড়ির ঠিকানা জানতে পারলাম। বুড়ির দাবি অনুযায়ী, ঐ ব্যক্তি যার নাম জানতে পারলাম নয়ন, সে স্ত্রীপুত্র মারা যাবার পর বরিশালের এক গ্রামে চলে গিয়েছিল, যেটা তার গ্রামের বাড়ি। ডাক্তার আমাকে ফুল বেড রেস্টে থাকতে বলেছিলেন।

তাই বাসার কারোরই আমার এই ছোটাছুটি পছন্দ হচ্ছিল না। তবু সবার মানা অগ্রাহ্য করে আমি ছুটে গেলাম বরিশালে, সেই গ্রামে। গিয়ে কোন লাভই হল না। শুধু এটুকুই জানতে পারলাম যে বছর ১৫ আগে নয়ন মারা গেছে, বিনা চিকিৎসায়ে। এবং তার মৃত্যুর কারণও হার্ট এটাক।

যাইহোক, সেদিনই মাগরিবের নামাজ পড়তে আমি ঐ গ্রামের মসজিদে গেলাম। বাইরের লোক বলে মসজিদের ইমাম আমার প্রতি আগ্রহী হলেন এবং আমার আগমনের কারণ জানতে চেলেন। আমি বললাম যে আমি নয়ন নামের এক লোকের খোজে এসেছি। এ কথা শুনে তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তুমি নামাজের পর দাঁড়াবে। কথা আছে।

’ নামাজ শেষে তিনি ভাল করে জেনে নিলেন আমি ঠিক কোন নয়নের খোঁজে এসেছি। দেখা গেল তিনি যার কথা ভাবছিলেন, এ সেই। তাই তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন যে কেন আমি নয়নকে খুঁজতে এসেছি। কিছুটা ইতস্তত করতে থাকলেও শেষে আমি সব ঘটনা তাকে খুলে বললাম। তিনি শুনে জবাব দিলেন, ‘তুমি যে উত্তর জানতে ঘর ছেড়েছ, সে উত্তর আমার জানা আছে।

’ এরপর তিনি যা বললেন, তা অনেকটা এরকমঃ “আমি এ মসজিদে গত ৩০ বছর ধরে ইমামতি করছি। এ গ্রামে আসার পর থেকেই নয়নকে চিনতাম কিন্তু তাকে কখন মসজিদমুখো হতে দেখি নি। কিন্তু মৃত্যুর মাত্র মাসখানেক আগে থেকে হঠাত সে বদলে গেল। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে লাগল। তাকে দেখতাম নামাজ শেষেও সে নফল নামাজ পড়ছে আর মোনাজাত ধরে খুব কান্নাকাটি করছে।

একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে কি তোমার এতো দুঃখ কিসের? তখন সে আমাকে বলল যে সে অনেক বড় একটা পাপ করছে। আমি জানতে চেলাম সেটা কি। সে সেদিন না বললেও পরে নিজে একদিন এসে বলল যে স্বাধীনতার ২ বছর পর সে এক রাতে নিজ হাঁতে তার বৌ আর ছেলেকে বটি দিয়ে জবাই করে মেরেছে আর তারপর বাড়ির পাশের পুকুরে লাশ ফেলে দিয়েছে। তারপর থেকে শুরু হয়েছে তার দুঃস্বপ্নের দিন। তিনি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন দিবাগত রাত ১টার দিকে আর তার পর থেকে যে কদিন সে ঐ বাড়িতে ছিলেন, স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত, ঠিক ঐ সময়।

স্বপ্ন ছিল এমন যে, পুকুর থেকে রক্ত এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে এসে সে দেখতেন যে সত্যিই পুকুরে পানির বদলে রক্ত, চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার শরীরে রক্ত স্পর্শ করছে না। আর তারপর যা ঘটেছে তোমার পরিবারের সাথে, তা তো তুমি জানই। তোমার দাদাজানের মৃত্যুর কোথাও শুনেছি আমি নয়নের কাছে। ” সব শুনে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

এতদিনের চিরচেনা ভৌতিক কাহিনীর সাথে এই ঘটনার কোন মিল না পেয়ে কিছুটা খটকাও লাগল। হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হুজুর, আমার সাথে এই যে ঘটনা ঘটল আর তার পেছনকার যোগসূত্রের তো কোন মিল খুঁজে পেলাম না। ’ -‘কিরকম?’ -এই যে, আমার দাদাজানের মৃত্যু ঘটার কারণ ঐ জমি যদি হয়েও থাকে, কিন্তু তিনি তো জমিটা কেনার পর ঐ জমিতে যাবার সুযোগই পান নি। শুধু জমিটা কিনলেন বলেই তাকে মরতে হল? আবার আমার বাবা তো প্রথমদিকে অনেকবার ঐ জমিতে গেছেন, মাছ চাষের চেষ্টাও করেছেন। তখনতো তিনি মরলেন না।

মারা গেলেন তারও ৩৪ বছর পর, যদিও পেছনে ঐ জমির ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সেদিক থেকে এক আমিই তো ঘটনার পুর ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি। তবুও তো আল্লাহপাকের অশেষ মেহেরবানিতে আমি জানে বেচে গেলাম। আরেকটা ব্যাপার যে আমার বাবা, দাদা এবং নয়ন তিন জনেরই মৃত্যু হার্ট এটাকে। আমিও এর শিকার হয়েছিলাম।

-তো এ থেকে তুমি কি বলতে চাও? -এটুকুই বলতে চাই, ঘটনার এতো অসামঞ্জস্যতা তো আগে কখনো শুনি নাই। হুজুর এবার খুব কড়াভাবে বললেন, প্রকৃতির সব বিষয় জানতে চাওয়া ভুল। তুমি একবার বেঁচে গেছ, আর এ ব্যাপারে মাথা ঘামিও না। হুজুর শেষ এই কথাগুলা মনে খুব লাগলেও সে যে খুবই বন্ধুবৎসল তার প্রমাণ পেলাম যখন সে আমাকে রাতটা তার সাথে মসজিদেই কাটাতে বললেন। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন বিপত্নীক এবং নিঃসন্তান।

যাই হোক, অচেনা জায়গা আর রাত হয়ে গেছে বলে আমি তার সাথে রাত কাটানোরই সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্ত দুঃখের কথা, ঐ রাতেই হুজুর হার্ট এটাক করে মারা গেলেন। ডাক্তার এসে একে বার্ধক্যজনিত মৃত্যু বলে আখ্যা দিলেন। কিন্তু একমাত্র আমিই তার পাশে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে দেখেছিলাম যে তার চোখ থেকে লাল রশ্মি বের হচ্ছে। ঘটনার কোন কূলকিনারা আমি করতে পারি নি।

শুধু এটুকু বুঝেছি যে প্রকৃতি নিজেই খুব কনফিউজড। তাই একটা অন্ধকার ঘটনাকে লোকের সামনে আনার জন্য সে সত্তরোর্ধ এক লোককে ১৫ বছর বাঁচিয়ে রেখেছিল কিন্তু সেই অন্ধকারকে পূর্ণ আলোকিত না করে দিয়েই লোকটাকে কেড়ে নিল। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।