www.facebook.com/mahamudul.hasan.9619 ভ্রমন করা, লেখালেখি করা, বিজ্ঞান ওয়েবসাইট দেখা, অনেক বই ও ম্যাগাজিন পড়ি এবং ওয়েবসাইট প্রোগ্রামিং করতে খুব পছন্দ করি। নো ইজি ডে-লাদেন হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-১ (মার্ক ওয়েন)
নো ইজি ডে - লাদেন হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-২
চাপা শব্দে বেরিয়ে গেল দুটি বুলেট...
ওয়াশিংটন থেকে ভিডিওতে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও অন্যরা
অ্যাবোটাবাদের বাড়িটির মূল ভবনের প্যাঁচানো সিঁড়ির পাটাতনে চিত হয়ে পড়ে আছে লাদেনপুত্র খালিদের রক্তাক্ত লাশ। মার্কিন কমান্ডোরা প্রথমে অতিথিশালায় হত্যা করেছেন লাদেনের বার্তাবাহক আরশাদ খান ওরফে আল-কুয়েতিকে, তারপর মূল ভবনের নিচতলায় হত্যা করেছেন তাঁর ভাই আবরার খানকে ও তাঁর স্ত্রী বুশরাকে। তারপর দোতলার সিঁড়িতে হত্যা করেছেন লাদেনের ছেলে খালিদকে। অতিথিশালায় আরশাদ খান আত্মরক্ষার চেষ্টায় গুলি চালিয়েছিলেন; কিন্তু তার পর থেকে এ পর্যন্ত কমান্ডোদের দিকে আর একটি গুলিও কেউ ছোড়েনি।
মার্কিন কমান্ডোরা প্রায় বিনা যুদ্ধে পৌঁছে গেল ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’ নামের অভিযানের চূড়ান্ত পর্বে, যার ঘোষিত লক্ষ্য আমেরিকার এক নম্বর শত্রু ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত অথবা মৃত—যেকোনো অবস্থায় আটক করা।
লাদেন তিনতলায়, তাঁর কাছে যেতে হবে এই প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়েই। মসৃণ টাইলের ধাপগুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে খালিদের রক্তে। সিঁড়িতে যথারীতি অন্ধকার, কিন্তু নাইট-ভিশন গগলসের ভেতর দিয়ে কমান্ডোরা দেখছেন, সবকিছু ধুয়ে যাচ্ছে সবুজ আভায়। খালিদের লাশের পাশে যে কমান্ডো (পয়েন্ট ম্যান—আক্রমণকারী গ্রুপের সম্মুখ ব্যক্তি) দাঁড়িয়ে ছিলেন, দোতলার ঘরগুলো পরিষ্কার করার পর পেছনের কমান্ডোদের ‘প্রস্তুত’ সংকেত পেয়ে তিনি উঠতে শুরু করলেন ওপরের দিকে।
তাঁকে অনুসরণ করতে করতে ম্যাট বিসোনেট ভাবছেন, ‘এ বাড়িতে এখন জীবিত পুরুষ আছেন মাত্র একজন, তিনি লাদেন। ...অথবা তিনতলায় কে আছে সেটা কোনো বিষয় নয়। বিষয় হলো, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি সম্ভবত একটা বন্দুকযুদ্ধের দিকে, আর এ রকম অপরিসর জায়গায় যেকোনো বন্দুকযুদ্ধ শেষ হতে কয়েক সেকেন্ড লাগে না। ভুল করার কোনো সুযোগ নেই...। ’
‘আমার ঠিক সামনেই পয়েন্ট ম্যান, বিশেষ কিছু করার নেই আমার, আমি তার পেছনে আছি তাকে সহযোগিতা করার জন্য।
আনুমানিক ১৫ মিনিট পার হয়েছে; শরীরে আত্মঘাতী বোমা বেঁধে নেওয়া অথবা বুলেটভর্তি অস্ত্র হাতে নিয়ে আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকার জন্য এটা যথেষ্ট সময়। ...
‘সিঁড়ির ওপরের শেষ ধাপটির সামনে একটা সরু গলির মতো। গলির শেষ মাথায় বেলকনিতে যাওয়ার একটা দরজা। সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে ফুট পাঁচেক সামনে ডানে ও বাঁয়ে দুটি দরজা। সিঁড়িটি অপেক্ষাকৃত সরু...আমার সামনে পয়েন্ট ম্যান, তার সামনে কী, আমি দেখতে পাচ্ছি না...সিঁড়ি ওপরের দিকে ক্রমে আরও সরু হয়ে আসছে...সিঁড়ির শেষ মাথায় উঠতে আমার যখন পাঁচ কি ছয়টি ধাপ বাকি, আমি শুনতে পেলাম শব্দনিরোধকের ভেতর দিয়ে চাপা শব্দে বেরিয়ে গেল দুটি বুলেট: বপ্! বপ্!
‘পয়েন্ট ম্যান তার কাছ থেকে ফুট দশেক সামনে গলিটার ডান দিকের দরজাটি থেকে একটা মাথা বের হতে দেখতে পায়।
আমার অবস্থান থেকে বোঝার উপায় নেই, গুলি ঠিক লক্ষ্যবস্তুতে লাগল কি না। লোকটা অন্ধকার ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘সবার আগে পয়েন্ট ম্যান সিঁড়ির সামনের জায়গাটিতে পৌঁছাল, তারপর ধীরে ধীরে এগোতে লাগল ওই দরজাটির দিকে। না, সিনেমার দৃশ্যের মতো বন্দুক চালাতে চালাতে আমরা ঝড়ের গতিতে ওই ঘরে গিয়ে ঢুকি না; আমরা সময় নিই...পয়েন্ট ম্যান তার রাইফেল তাক করে ঘরটির ভেতরে ঢুকে পড়ে, তার পেছনে আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকি খোলা দরজাটির দিকে। তাড়াহুড়ো নয়, বরং চৌকাঠের কাছে থেমে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, ঘরের ভেতরে তাকাই।
আমরা দেখতে পাই, একটা খাটের পায়ার কাছে পড়ে আছে এক লোক, তার পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন আর আরবি ভাষায় চিৎকার ও বিলাপ করছেন দুই মহিলা। তাঁদের পরনে লম্বা পোশাক, আলুথালু চুল দেখে মনে হয় তাঁরা ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কম বয়সী মহিলাটি চোখ তুলে তাকালেন, দরজায় দেখতে পেলেন আমাদের। তিনি আরবিতে চিৎকার করতে করতে ছুটে গেলেন পয়েন্ট ম্যানের দিকে। পাঁচ ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা।
পয়েন্ট ম্যান তার অস্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে রেখে দুই মহিলাকে দুই হাতে ধরে নিয়ে গেলেন ঘরটির এক কোণের দিকে। ওদের দুজনের মধ্যে একজনের শরীরেও যদি আত্মঘাতী বোমা বাঁধা থাকে, তাহলে পয়েন্ট ম্যান সম্ভবত আমাদের জীবন রক্ষা করতে পারবে, কিন্তু সে নিজের প্রাণটা নিশ্চিত খোয়াবে। এই নিঃস্বার্থ সিদ্ধান্তটা সে নিয়েছে এক নিমেষে...। ’
আমেরিকা লাদেনকে হাতে পাওয়ার চেষ্টা করেছে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ২৫ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার।
এমনকি, আফগানিস্তানে পুরোদমে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে, যে যুদ্ধ এক দশক ধরে চলেছে এবং আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধ হিসেবে রেকর্ড গড়েছে। লাদেনকে মারতে গিয়ে আমেরিকান সেনারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হত্যা করেছেন প্রায় ১৫ হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষকে। কিন্তু ওসামা বিন লাদেন থেকে গেছেন আমেরিকানদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিল ক্লিনটন ও জর্জ বুশ—দুই প্রেসিডেন্টের শাসনকাল পেরিয়ে গেছে নিষ্ফলভাবে। মার্কিন গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী সামরিক কৌশলবিদদের বোকা বানিয়ে লাদেন আফগানিস্তানের দুর্গম পাথুরে পাহাড়-পর্বতের গুহা ছেড়ে পাঁচ বছর ধরে বাস করছেন মার্কিন-মিত্র পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ৮০ মাইল দূরে অ্যাবোটাবাদ শহরের একটি বাড়িতে, যার আশপাশে কোনো পাহাড়-পর্বত বা বনজঙ্গল নেই।
ওই বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমি।
মার্কিন গোয়েন্দারা দীর্ঘ সময় গোপন অনুসরণ ও অনুসন্ধানের পর নিশ্চিত হয়েছে, ওই বাড়িতেই বাস করছেন ওসামা বিন লাদেন। ২০০৫ সালে তাঁর জন্যই বাড়িটি বানিয়েছেন পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তান এলাকার দুই ধনাঢ্য ভাই আরশাদ খান ও আবরার খান। স্থানীয় লোকেরা বাড়িটি চেনে ‘ওয়াজিরিস্তান হাভেলি’ নামে। কিন্তু সেই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে তাদের কারও কোনো জানাশোনা নেই।
তারা স্থানীয় কারও সঙ্গে মেলামেশা করে না, শিশুরা বাড়ি থেকে বের হয় না। এক একর জমির ওপর তিনতলা বাড়িটি চারপাশ থেকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা; প্রাচীরের উচ্চতা কোথাও ১২ ফুট, কোথাও ১৮ ফুট। তার ওপর রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া।
আমেরিকার ‘লাদেন শিকার’ শুরু হওয়ার দশম বছরে, ২০১১ সালের ২ মের প্রথম প্রহরে সেই বাড়ির তিনতলার একটি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছেন ওসামা বিন লাদেন; ম্যাট বিসোনেটের সহযোদ্ধা পয়েন্ট ম্যানের একটি গুলিতে উড়ে গেছে তাঁর কপালের ডান পাশ থেকে মাথার একটা অংশ। দরজায় তাঁর মাথাটি দেখামাত্র গুলি চালিয়ে দিয়েছেন পয়েন্ট ম্যান।
কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কথা ছিল তাঁকে জীবিত অবস্থায় আটকের চেষ্টা করার। সিআইএর সে সময়ের ডিরেক্টর লিওন প্যানেট্টা ৩ মে এক বিবৃতিতে বলেন, ওসামা বিন লাদেন যদি আত্মসমর্পণ করতেন, তাহলে মার্কিন সেনারা তাঁকে গ্রেপ্তার করত। তিনি তা করেননি, তাই মার্কিন বাহিনীর পূর্ণ অধিকার আছে তাঁকে হত্যা করার। লাদেন হত্যা অভিযানের সত্যিকারের বিবরণ তখন পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে দেওয়া ঘটনার বিবরণ বারবার বদলে যাচ্ছিল।
লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা সে সময় পরিবর্তিত ভাষ্যগুলো নিয়ে আলাদা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রথমে দাবি করা হয়েছিল, আক্রমণের সময় লাদেন সশস্ত্র ছিলেন। তারপর বলা হয়, না, অস্ত্র তাঁর হাতে ছিল না, কিন্তু তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, বরং গ্রেপ্তারে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ডিরেক্টর ক্লাউদিও করদোনে ৪ মে মন্তব্য করেন, লাদেন নিরস্ত্র ছিলেন, তাহলে কীভাবে তিনি গ্রেপ্তারে বাধা দিয়েছিলেন, তা পরিষ্কার নয়।
পয়েন্ট ম্যানের বুলেটের আঘাতে খুলির একটা অংশ উড়ে যাওয়ার পরও লাদেন কিছু সময় বেঁচে ছিলেন।
পয়েন্ট ম্যান যখন দুই মহিলাকে ঘরটির এক কোণের দিকে নিয়ে যায়, তখন দরজার চৌকাঠে অপেক্ষমাণ ম্যাট বিসোনেট ও তাঁর আরেক সঙ্গী ঘরটির ভেতরে ঢোকেন। ম্যাটের বিবরণ: ‘আমরা দেখতে পেলাম, খাটের পায়ার কাছে মেঝেতে পড়ে আছে লোকটি। তাঁর পরনে সাদা গেঞ্জি, খয়েরি জোব্বা আর ঢিলা খয়েরি পাজামা। পয়েন্ট ম্যানের গুলি ঢুকে গেছে তাঁর মাথার ডান পাশে। খুলির ওই অংশটি থেকে রক্ত ও মগজ বেরিয়ে এসেছে।
তখনো তিনি মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। আমি ও আমার সঙ্গী লেজার যন্ত্রের রশ্মি ফেলে দেখে নিলাম তাঁর বুক; তারপর কয়েকটি গুলি চালালাম। বুলেটগুলো তাঁর বুকে ঢুকে দেহটাকে তুলে আছড়ে ফেলল মেঝের ওপর, তারপর নিথর হয়ে গেল...। ’
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্দেশে ও সিআইএর পরিচালনায় মার্কিন নেভি সিল টিম সিক্সের ২৪ জন কমান্ডো ২০১১ সালের ১ মে দিবাগত রাতে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে দুটি ‘ব্ল্যাক হক’ স্টিলদ হেলিকপ্টারে করে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের একটি বাড়ির ওপর যে আক্রমণ চালায়, সেটি যে ওসামা বিন লাদেনকে আটক করার অভিযান (ক্যাপচার অপারেশন) ছিল না, বরং ছিল পূর্বপরিকল্পিত এক হত্যা অভিযান (কিলিং মিশন), ম্যাট বিসোনেটের এই বিবরণ থেকে সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্কিন প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য এটা বেশ বিব্রতকর।
কারণ, বর্ণনাকারী ম্যাট বিসোনেট এমন এক ব্যক্তি, যিনি নিজ হাতে মুমূর্ষু লাদেনকে গুলি করে তাঁর মৃত্যু ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু মাথায় গুলিবিদ্ধ লাদেন মেঝেতে পড়ে যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, তখন তাঁর পক্ষ থেকে মার্কিন কমান্ডোদের জন্য কী এমন হুমকি ছিল যে তাঁর বুকে আবারও গুলি চালিয়ে ওই মুহূর্তেই তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছিল?
নাইট-ভিশন গগলসের ভেতর দিয়ে তাকালে সবুজ আভায় মানুষকে কি মানুষ বলে মনে হয় না?
চলবে...
ওসামা বিন লাদেন হত্যা অভিযানে অংশগ্রহণকারী মার্কিন নেভি সিলের সদস্য ম্যাট বিসোনেটের প্রত্যক্ষ বয়ান থেকে কিছু অংশ "প্রথম আলো" পএিকাতে প্রকাশিত। লেখক-মশিউল আলম: সাংবাদিক। মার্ক ওয়েন ছদ্মনামে তাঁর লেখা বই “নো ইজি ডে” ৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসেছে এবং বিক্রি তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।