আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নো ইজি ডে - লাদেন হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-২

www.facebook.com/mahamudul.hasan.9619 ভ্রমন করা, লেখালেখি করা, বিজ্ঞান ওয়েবসাইট দেখা, অনেক বই ও ম্যাগাজিন পড়ি এবং ওয়েবসাইট প্রোগ্রামিং করতে খুব পছন্দ করি। নো ইজি ডে-লাদেন হত্যার প্রত্যক্ষ বয়ান-১ (মার্ক ওয়েন) ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে... খালিদ বিন লাদেন অ্যাবোটাবাদের যে বাড়িটিতে লাদেন থাকতেন, সেটির ছিল দুটি অংশ। একটি অতিথিশালা, সেটিতে থাকতেন লাদেনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচর ও বার্তাবাহক আরশাদ খান ওরফে আল-কুয়েতি। এ লেখার গত পর্বে ম্যাট বিসোনেট ও তাঁর গ্রুপের সদস্য উইল ওই অতিথিশালায় আরশাদ খানকে গুলি করে হত্যা করেছেন। তারপর তাঁরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন বাড়িটির মূল অংশে ঢোকার উদ্দেশ্যে।

মূল অংশটি তিনতলা। মার্কিন কমান্ডোদের ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে, ওই অংশের নিচতলায় সপরিবারে বাস করেন আরশাদ খানের ছোট ভাই, লাদেনের আরেক বার্তাবাহক আবরার খান। দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে বাস করেন লাদেন-পরিবারের সদস্যরা। লাদেন তাঁর পঞ্চম স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন তিনতলায়। দোতলায় তাঁর এক ছেলে ও তাঁর পরিবার।

বাড়ির দুটি অংশের মাঝখানে একটি উঁচু দেয়াল। সেখানে একটি দরজায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভেতরের আঙিনায় ঢুকে পড়েন কমান্ডোরা। অভিযানের শুরুতে কমান্ডোরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এগিয়েছেন। ম্যাট ও তাঁর গ্রুপ আক্রমণ চালিয়েছে অতিথিশালায়, অন্য গ্রুপটি অন্য দিক থেকে ঢুকে পড়েছে বাড়িটির মূল অংশে। অতিথিশালার অভিযান শেষ করে ম্যাট ও তাঁর সঙ্গীরা মূল ভবনে ঢোকার পর দেখতে পান যে অন্য গ্রুপটি সেখানে ইতিমধ্যে তৎপর।

ম্যাট লিখছেন, ‘টমের তিন সদস্যের দলটি নিচতলায় ঢুকে পড়েছে। ভেতরটা অন্ধকার, প্রায় পিচের মতো কালো, কিন্তু নাইট ভিশন গগলসের ভেতর দিয়ে ওরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। ওরা সহজেই একটা লম্বা করিডরের মতো দেখতে পায়, দুপাশে দুটি করে মোট চারটি দরজা। কয়েক কদম এগোতেই ওদের পয়েন্টম্যান দেখতে পায়, বাঁ পাশের প্রথম ঘরটির দরজা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটি লোকের মাথা। ’ এই মুহূর্তে ম্যাট বিসোনেটের ধারণা, একটু আগে অতিথিশালায় তাঁরা আরশাদ খানকে হত্যা করার সময় আরশাদ তাঁদের দিকে একে-৪৭ রাইফেল থেকে যে গুলিগোলা ছুড়েছেন, তার শব্দ নিশ্চয়ই এই ভবন থেকে শোনা গেছে।

যাঁরা এখানে আছেন, তাঁরা প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় পেয়েছেন, সুতরাং টমের কমান্ডো বাহিনী কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। পয়েন্টম্যান দরজায় লোকটির মাথা দেখার সঙ্গে সঙ্গে ‘একটা গুলি চালাল,’ লিখছেন মার্ক ওয়েন ছদ্মনামধারী ম্যাট বিসোনেট, ‘গুলি লোকটিকে আঘাত করল; পরে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে সে আবরার আল-কুয়েতি (আবরার খান), সে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে হল পেরিয়ে টমের দল গিয়ে থামল দরজার কাছে। আহত আবরার আল-কুয়েতি মেঝেতে পড়ে তড়পাচ্ছে। ওরা আবার গুলি শুরু করল; গুলির ঠিক আগমুহূর্তে তাকে বাঁচাতে তার সামনে লাফ দিয়ে এসে পড়ল তার স্ত্রী বুশরা।

দ্বিতীয়বারের গুলিতে দুজনেই প্রাণ হারাল। ’ আবরার খান প্রথম গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় নিরস্ত্র ছিলেন; সম্ভবত কৌতূহলবশে দরজা দিয়ে মাথাটা একটুখানি বের করে তাকিয়েছিলেন মাত্র। ঠিক সেই মহূর্তেই ম্যাট বিসোনেটের বর্ণিত পয়েন্টম্যান তাঁকে গুলি কনে। তারপর মেঝেতে পড়ে যখন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন, তখন তাঁর ওপর আবার গুলি করে তারা, তখনো তিনি নিরস্ত্র এবং তাঁর দিক থেকে মার্কিন কমান্ডো সদস্যদের কোনো ঝুঁকির সম্ভাবনাই ছিল না। মুমূর্ষু আবরারের মৃত্যু নিশ্চিত করতে গিয়ে কমান্ডোরা তাঁর স্ত্রীকেও হত্যা করে, এবং তারপর দেখতে পায়, ঘরের এক কোণে একটি একে-৪৭ রাইফেল।

ম্যাটের বিবরণ থেকে মনে হয় না, আবরার সেটি স্পর্শ করেছেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন, বিশেষত সিআইএর কর্তারা পরে দাবি করেন, লাদেনের সহযোগী সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে মার্কিন বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা ও পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে কেউ লিখেছিলেন, আবরার খান গুলি করার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন; কেউ লিখেছেন, যখন তিনি অস্ত্র হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন মার্কিন সৈন্যরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। আবরার খান ও তাঁর স্ত্রী বুশরাকে হত্যা করার পর মার্কিন কমান্ডোদের এগিয়ে যাওয়া সম্পর্কে ম্যাট লিখছেন, ‘টমের দলটি দেখতে পায় ঘরের এক কোণে আরেক মহিলা, তার পাশে কয়েকটি শিশু চিৎকার করে কাঁদছে। ঘরটিতে একটা একে-৪৭ ছিল।

টম সেটি হাতে তুলে নিয়ে গুলি বের করে ফেলে দেয়; তখন তার দলের অন্য সদস্যরা অন্য ঘরগুলোতে তল্লাশি চালায়। ...সাধারণভাবে আমরা যা করি, ওই মহিলা আর শিশুদের ওপর নজর রাখার জন্য সেখানে আমাদের কাউকে রেখে যাওয়া, কিন্তু এখানে সেই সময় ছিল না বা যথেষ্ট লোকবল ছিল না। মহিলা আর শিশুদের ওখানে রেখে ওরা ঘরটি থেকে বের হয়ে আসে। ’ কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা জানেন, বাড়িটিতে ওই রাতে অবস্থান করছিলেন মোট চারজন পুরুষ। তাঁদের মধ্যে লাদেনের দুই বার্তাবাহক ভাই ইতিমধ্যে নিহত।

বাকি রইলেন দুজন: লাদেন ও তাঁর এক ছেলে। ছেলে দোতলায়, বাবা তিনতলায়। বাবার কাছে পৌঁছাতে হলে ছেলেকে অতিক্রম করে যেতে হবে। কিন্তু দোতলায় ওঠার পথে একটি ধাতব দরজা। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হলো সেটি।

তারপর ম্যাটের ভাষায়: ‘খোলা দরজা দিয়ে আমরা সিঁড়ির দিকে যাওয়া শুরু করলাম। ...টাইলস বসানো সিঁড়িটি প্যাঁচানো, ধাপগুলো বসানো ৯০ ডিগ্রি কোণে, ছোট ছোট অংশে ভাগ করা। আমরা জানি না, ওপরে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। সেখানে লাদেন বা যে-ই ঘাপটি মেরে থাকুক না কেন, অস্ত্র হাতে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় সে পেয়েছে। ঘূর্ণির মতো এই সিঁড়িটিই যেহেতু আমাদের ওপরে ওঠার একমাত্র পথ, আমরা সেখানে সহজেই আটকে যেতে পারতাম।

...অন্ধকার, আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব নিঃশব্দে এগোতে। আমাদের প্রতিটি ধাপ সতর্ক, মাপা। কোনো কথা নেই। কোনো চিৎকার নেই। কোনো ছোটাছুটি নেই... ‘আমি যখন সিঁড়ির দ্বিতীয় ডেকের ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছি, অন্য আক্রমণকারীরা ততক্ষণে সিঁড়ি থেকে নেমে গেছে।

দোতলার শুরুতে লম্বা একটা করিডরের মতো, সেটি গিয়ে পৌঁছেছে ভবনটির দক্ষিণ দিকের এক টেরাসে। দোতলায় চারটি দরজা, সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছেই দুটি, আর অন্য দুটি দূরে সেই টেরাসের কাছে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার সঙ্গীরা সন্তর্পণে করিডরের মতো জায়গাটা পেরিয়ে দরজাগুলোর দিকে এগোচ্ছে। ‘লক্ষ করলাম, আমার কাছ থেকে তিন-চারটি ধাপ ওপরে সিঁড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের মাঝখানের ল্যান্ডিংয়ে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের আরেক সঙ্গী। সেখানে পড়ে আছে একটি লাশ।

ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে নিচে মার্বেলের মেঝেতে। ’ লাশটি ওসামা বিন লাদেনের ২৩ বছর বয়সী ছেলে খালিদ বিন লাদেনের। ম্যাট বিসোনেট এখানে পরের বর্ণনাটি দিয়েছেন আগে। প্রথমে তিনি দেখেছেন লাশটি পড়ে আছে। পরে জেনেছেন, কয়েক মুহূর্ত আগে কীভাবে খালিদকে হত্যা করা হয়েছে।

ম্যাট লিখছেন, সিঁড়ির ওই জায়গাটিতে তাঁর সঙ্গী আক্রমণকারী ‘দেখতে পায়, এক লোক মাথা বাড়িয়ে দিয়ে ঝট করে আবার সরিয়ে নিল। গোয়েন্দা তথ্য থেকে আমরা জানি, বাড়িটাতে সর্বোচ্চ চারজন পুরুষ লোক থাকতে পারে। লাদেনের এক ছেলে খালিদ খুব সম্ভব দ্বিতীয় তলায় থাকে, আর লাদেন তৃতীয় তলায়। ‘সিঁড়ির কোণ থেকে যে মাথাটি বেরিয়ে এসেছিল, তার চুল ছিল ছোট করে ছাঁটা, মুখে দাড়ি ছিল না। সে অবশ্যই লাদেনের ছেলে।

আমাদের সঙ্গী আক্রমণকারী ফিসফিস করে ডেকে উঠল, “খালিদ! খালিদ!” ‘হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের শব্দ, গুলির শব্দ, বিস্ফোরণের শব্দ—সবই শুনতে পেয়েছে তারা। কিন্তু এখন সেসব থেমে গেছে। আমাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এই নীরবতার মধ্যে সিঁড়ির ওই লোকটি শুনতে পেল তার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। আমার মনে হলো, সে হয়তো ভাবছে: “ওরা আমার নাম জানে?” ‘এই কৌতূহলেই সে আবার মাথা বের করে দেখতে চায়, কে তাকে নাম ধরে ডাকছে।

যে মুহূর্তে সে মাথা বের করল, আমাদের সঙ্গী আক্রমণকারী গুলি চালিয়ে দিল তার মুখমণ্ডলে। তার দেহটি সিঁড়ি বেয়ে গড়াতে গড়াতে এসে থামল ওই ল্যান্ডিংয়ে। ’ মার্কিন কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা আরও একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করলেন। ম্যাট বিসোনেটের বিবরণ থেকে মনেই হয় না যে, এভাবে একের পর এক নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করায় তাঁরা কোনো আইনগত বা নৈতিক বাধা অনুভব করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্দেশ ছিল ওসামা বিন লাদেনকে জীবিত আটক করার, সেটা করতে গিয়ে যদি মার্কিন সৈন্যরা সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হতেন, তাহলেই কেবল তাঁকে হত্যা করা আইনসিদ্ধ হতো।

‘ক্যাপচার অর কিল’ বলা হয়েছিল এটা বোঝাতেই। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর সদস্যরা এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আদৌ বোঝেন বলে ম্যাট বিসোনেটের বর্ণনা থেকে মনে হয় না। চলবে... ওসামা বিন লাদেন হত্যা অভিযানে অংশগ্রহণকারী মার্কিন নেভি সিলের সদস্য ম্যাট বিসোনেটের প্রত্যক্ষ বয়ান থেকে কিছু অংশ "প্রথম আলো" পএিকাতে প্রকাশিত। লেখক-মশিউল আলম: সাংবাদিক। মার্ক ওয়েন ছদ্মনামে তাঁর লেখা বই “নো ইজি ডে” ৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসেছে এবং বিক্রি তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর বইটি প্রকাশের ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল, তবে এখনো সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নেভি সিলের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সদস্য মার্ক ওয়েনকে (ম্যাট বিসোনেট) ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।