"সময়ের অতল গহ্বরে মিলিয়ে যাওয়া শেষ আলোক রশ্মি"
সুকৌশলী তীরন্দাজের মত নিজের লক্ষ্যকে ইচ্ছার দ্বারপ্রান্তে গেঁথে ফেলতে চেয়েছিলেন আদনান সাহেব । কতটুকু পেরেছেন তা বুঝা যায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নতুন মডেলের প্রিমো এবং নিজেদের বস্ত্রকারখানা দেখলে । রোজকার মত যখন নিজের ভারী দেহটাকে টেনে ছয়তলার এক কোণে ফেলেন তখন পরিতৃপ্তির হাঁসিতে সম্প্রসারিত হয় মুখমণ্ডল । আহ কি শান্তি ! অন্তত এই জায়গাতে আমিই বস, আপন মনে ভাবেন তিনি ।
পরিশ্রান্ত দেহ যখন ক্লান্তির প্রয়াসে আশ্রয় খুঁজতে থাকে ।
তখন আর জায়গা না পেয়ে নিজের বিশাল সুইভেল চেয়ারে সুখনিদ্রা যান তিনি । একটু পর নাসিকা গ্রন্থ পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে না পারায় শ্বাস প্রশ্বাসের গতি প্রখর হয়ে ওঠে এবং তারা সশব্দে নিজস্ব পদ্ধতিতে যাতায়াত করতে থাকে । আদনান সাহেবের ঘুম ভাঙ্গে দিবাস্বপ্নে । টেলিফোন বাজতে থাকে । টেলিফোন তোলে নিশ্চুপ শুনে যান ।
তারপর ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজেকে তরতাজা করেন । কিছু ফরেন ডেলিগেট আসার কথা আজকে । বাসায় ফোন করে জানালেন লাঞ্চে দেরি হবে ।
আদনান সাহেবের ছোট শ্যালিকা পিংকি এবার ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে । কোচিং এবং এডমিশন টেস্ট বাবদ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বোনের বাসায় টেম্পোরারি গেস্ট বনে যাওয়া ।
আর বোনের মেয়েটাকে একটু আধটু হেল্প করা ।
ওদের দ্বিতীয় কোন সন্তান নেই । এ নিয়ে প্রায়ই বাগবিতণ্ডা, একে অন্যের অক্ষমতা জাহির করা ; এগুলো ওরা যতই ধামাচাপা দিতে চায় লাভ হয়না । পিংকি বেচারির শ্রবণসীমার চারপাশে বীরদর্পে বিচরণ করে শব্দগুলো । যৌবনের পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা টিপে টিপে সাবধানে চলে সে ।
দুয়েকবার হোঁচট যে খায়নি তা নয় তারপরও নিজেকে সামলে নিয়েছে । প্রতিরাতেই সে তাদের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত হয় । দাম্পত্য জীবনের কোলাহল ওর কাছে এসে স্বেচ্ছায় কানাকানি করে । নিশিতে সে অনুধাবন করে দম্পতিদ্বয় জেগে আছে । একটু পর পর ভেসে আসা যৌনজীবনের উত্তেজিত কামুক শব্দযুগল উত্তাল যৌবনে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে ।
। সিমির কোণার রুম থেকে এসব শোনাই যায় না । কারণ ওর রুমের জানালা দেয়ালের অন্যদিকে আর পিংকির রুমের জানালাটা ওদের জানালার একই সারিতে । কতবার যে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে সে; থাক না চলুক সেসব অনর্থক কথোপকথন । নিঃশব্দ রাত্রির একাকীত্বতা দূরীভূত করতে সেসবকে আঁকড়ে ধরে পিংকি ।
সিমি পিংকি খেতে আয়; আদনান সাহেবের স্ত্রী সেলিনা পারভিন ডিনারে এভাবেই ওদের ডাকেন সবসময় । আহারাদির পর্ব শেষ হলে আদনান সাহেব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হোন ।
আহারে! বোনটা আমার শরমে ঠিকমত খাইতে পারে না, সেলিনা বিলাপ করতে থাকে । এই তুমি ওর সামনে কখনো বসবা না, দেখনা ও কেমন লজ্জা পায় ।
-কইসে তোমারে ! আমি তো নতুন বেয়াই যে দেখলেই লজ্জা লাগে ।
জিজ্ঞ্যাস করে দেখো তোমার বোনেরে ।
আচ্ছা ঠিকাছে । জিজ্ঞাস করার দরকার নাই । আমরা খাওয়ার পর ওকে ডাকলেই চলবে, সেলিনা বলতে থাকে ।
যথাসময়ে সবাই খেতে বসেছে কিন্তু পিংকি আসে নি ।
পিংকি কই? আদনান সাহেব জিজ্ঞাস করেন ।
-খাবার সময় হয় নি এখনো । তোমাকে আগে দিয়ে দিচ্ছি ।
কি যে শুরু করছ তোমরা । ডাকো তোমার বোন আর মেয়েকে ।
এই পিংকি সিমি খেতে আয়, বলে নিজেই ডাকা শুরু করলেন । এরপর থেকে সেলিনা হয়ে যায় শুধু খাবারের আয়োজক, আর ডাকাডাকির দায়িত্বটা স্বেচ্ছায় নিয়ে নেন আদনান সাহেব ।
ব্যাতিক্রম কিছু একটা ঘটেছে কিন্তু ধরতে পারছে না পিংকি । শুধু জানে আদনান সাহেব ডাক দিয়েছেন । কিন্তু এর বাইরেও কিছু একটা আছে ।
ওর সিক্সথ সেন্স বলে দিচ্ছে সেটা ।
আদনান সাহেবের মেয়ে সিমি পড়ে স্কলাস্টিকায় । যাতায়াতের দায়িত্বে থাকে সেলিনা । সেক্ষেত্রে শনিবার আদনান সাহেব বাসাই থাকেন । পিংকি কোচিং এ যায় বারোটার পরে ।
শনিবার দিনটা একটু আরাম করেন তিনি । ঘুম থেকে ওঠেন দশটারও পরে । টেবিলে নাস্তা দেওয়াই থাকে । কাজের বুয়া এগারোটায় বিদায় হয় । তবে আজকে আধা ঘন্টা আগেই চলে গেছে ।
আদনান সাহেব টেবিলে বসে নাস্তা করেন আর পত্রিকায় চোখ বুলান । বিরক্ত হয়ে শব্দ করে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখেন । কিসের এক গোপন অভিসন্ধিতে ইতিউতি তাকান আশেপাশে । তারপর চোখ পড়ে পিংকির রুমের দিকে ।
মেয়েটা নেই ! আবার তাকান সিমির রুমের দিকে, সেখানেও নেই !!
গেলো কোথায় তাহলে? বাথরুমের দরজাগুলোও খোলা ।
আদনান সাহেব ফোন করলেন সেলিনার কাছে, উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞ্যাস করলেন ওর কথা । লাভ হলো না কোনো । মেয়েটা পালিয়ে গেছে । কিন্তু কেন? ভাবেন তিনি । চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে তাঁর; মাইয়া তো সেয়ানা হইয়া গেছে ।
যুবতী মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুবই প্রবল থাকে বলা যায় । পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে তারা নিজেকে মেটোমরফসিস করতে পারে । না পারলে স্থান বদল করে । পিংকির কথাই ধরা যাক তাহলে ...
আদনান সাহেব লক্ষ্য করতেন যখনই তিনি আড় চোখে দুয়েকবার মেয়েটার বাড়ন্ত সম্পদের দিকে দৃষ্টিলেহন করতেন, মেয়েটা ঠিকই নিজেকে প্রতিরোধ করে ফেলত । খাদ্যের বদলে তাঁর দৃষ্টি চলে যেত দৈহিক স্থানগুলোতে ।
নিজেকে সামলাতে তখন খুব হিমশিম খেতে হত তাঁকে । আবার না দেখতে পারলে নিজেরও খাওয়া হজম হতোনা । আড়ালে আবডালে দুয়েকবার চোখটিপ কিংবা ইশারা দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন কিন্তু মেয়েটা বুঝেও না বুঝার ভান করতো ।
পিংকির ইন্টেলেকচুয়াল ক্ষমতা অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই, সবকিছু সে লজিকের দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ করতে পছন্দ করত । আদনান সাহেবের অভিব্যাক্তির দরুন সে যতটুকু যা ই বুঝতে পেরেছে তার চেয়েও বেশি বুঝেছে খাবার টেবিলে সম্ভাষণের ধরন দেখে ।
মানুষের অতি সাধারণ একটি প্রবণতা হচ্ছে, প্রিয় মানুষ কিংবা পছন্দের কাউকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া । কাউকে যদি জিজ্ঞ্যাস করা হয়, মিলি লিলি দুজনের ভেতর কে বেশি সুন্দরী ; তাহলে নিশ্চয় তাকে একটু হলেও ভাবতে হবে । চিন্তাধারা হবে ব্যাক্তিক নয় বরং নামগত ।
এক্ষেত্রে পিংকি কোনো চিন্তা না করেই বলে দিতে পারবে মিলি বেশি সুন্দরী । কারণ সুন্দরীদের সবাই পছন্দ করে এবং দুজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যে বেশি সুন্দরী তার নামটাই আগে জুড়ে দেয় সবাই ।
দেখা যায় দু জন স্টুডেন্ট রনি জনি । এখন টিচার যদি দুজন কে একসাথে এভাবে ডাকেন জনি রনি; তাহলে বুঝতে হবে যে রনির চেয়ে জনি বেশি মেধাবী কিংবা স্যার জনিকেই বেশি পছন্দ করেন ।
সেলিনা এতদিন ওদের খাবার টেবিলে ডাকতেন সিমি পিংকি বলে । এতেই পিংকি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো । কিন্তু যেদিন আদনান সাহেব ওদের ডাকলেন পিংকি সিমি বলে সেদিনই ওর মনে ব্যাপারটি খুঁত খুঁত করতে থাকে ।
তৎক্ষণাৎ বুঝতে না পারলেও সে পরে বুঝতে পারে । যে কোন সময়ই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে । পুরুষদের বিশ্বাস নেই, এ জাতীয় মনোভাব পোষণ করে সে সম্ভাব্য দিনটিও বের করে ফেলতে সক্ষম হয় ।
পিংকি বাসায় ফিরে দুপুরের পরে যখন সিমির স্কুল থেকে ফেরার সময় হয় । আসতে না আসতেই আদনান সাহেব আর সেলিনার কাছে ওকে জবাবদিহিতা করতে হয় ।
না বলে কোথায় গেছিলি? সেলিনা জিজ্ঞাস করে ।
-কোচিং এ । নির্লিপ্ত জবাব ওর ।
কোচিং না দুপুরে হয়? এবার আদনান সাহেব জিজ্ঞাস করেন ।
-শিফট করে নিয়েছি ।
হঠাৎ শিফট করার এত দরকার পড়ল কেন? ধমকে ওঠেন তিনি । সেলিনা কেমন একটা বুনো দৃষ্টিতে তাকায় স্বামীর দিকে ।
সেলিনা বলেন, তুমি ওকে ধমক দিচ্ছ কেন?
-কই ধমক দিলাম । জিজ্ঞ্যাস করলাম মাত্র ।
এই তুই রুমে যা ।
পিংকি চলে যায় ।
গভীর রাত্রে পিংকি কান না পাতলেও শুনতে পায় উত্তেজিত কথাবার্তা চলছে স্বামী স্ত্রীর মাঝে । ওকে জড়িয়ে তির্যক বাক্যগুলো কান দিয়ে প্রবেশ করে সীসা ঢেলে দেয় মগজে । অনেক দিন পর আজ সে সকল দ্বিধাগ্রস্থতা ঝেড়ে ফেলে জানালার দিকে হাত বাড়ায় । আস্তে করে দক্ষিণা জানালাটা বন্ধ করে দেয় এবং শব্দগুলো চাপা পড়ে যায় তাতে ।
তবুও মনের ভেতর খচখচ করে শব্দশলাকা নিঃশব্দে অনপনেয় কারুকাজ খুঁচিয়ে যায় ।
-------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।