আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবু সাইয়ীদের 'রূপান্তর': পুরাণচর্চার প্রয়াস

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ... মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবকে তীরচালনা শিক্ষা দিতেন গুরু দ্রোণাচার্য। দ্রোণাচার্য ঘোষণা দেন অর্জুনই হলেন শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ, তার সেরা শিষ্য। এদিকে উপজাতি এক যুবরাজ একলব্য দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে চাইলে ছোট জাত হবার কারণে একলব্যকে শিক্ষাপ্রদানে অস্বীকৃতি জানান দ্রোণাচার্য। একলব্য দ্রোণাচার্যকেই গুরু মেনে তীরচালনার অধ্যবসায় করতে থাকে এবং দক্ষ হয়ে ওঠে। অর্জুন একলব্যের দক্ষতার পরিচয় পেয়ে গুরুর কাছে নিবেদন করে যে, একলব্যের কারণে তার তীরন্দাজির খ্যাতি হুমকির সম্মুখিন।

গুরু অর্জুনকে আশ্বস্ত করে একলব্যের কাছে গিয়ে জানতে চান সে এই দক্ষতা কোত্থেকে অর্জন করেছে? একলব্য জানায় দ্রোণাচার্যই তার গুরু। গুরু এবার গুরুদক্ষিণা চান একলব্যের কাছে। বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিতে হয় একলব্যকে। এভাবে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন থাকে। এই বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে বিপদে পড়ে নির্মাতা আরিফ।

কারণ স্পটে ভীড় করা সাঁওতাল যুবকরা বলতে থাকে যে অভিনেতা তীর ধরতে জানেনা; তীর ধরতে হয় মধ্যমা ও তর্জনী দিয়ে অথচ অভিনেতা ধরেছে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে। সাঁওতালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা বংশ পরম্পরা ধরে এভাবেই তীর চালিয়ে আসছে। তাদের এই মন্তব্য আরিফকে বিভ্রান্ত করে। আরিফ তার চিত্রনাট্য পাল্টে ফেলে। নতুন কাহিনীতে নতুনভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা শুরু করে আরিফ, যেখানে সাঁওতালদের অভিনেতা হিসেবে নিযুক্ত করে।

নতুনভাবে লিখিত কাহিনীতে দেখা যায় যে একলব্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে, তার অনুমতি নিয়ে তার অনুসারীরা মধ্যমা ও তর্জনী দিয়ে তীরচালনার চর্চা শুরু করে। এভাবে ক্ষমতার রূপান্তর হতে থাকে, চলচ্চিত্রের মধ্যে যে চলচ্চিত্র নির্মিত হতে থাকে তারও নাম দেয়া হয় রূপান্তর। রূপান্তর (২০০৮) চলচ্চিত্রের মূল থিমটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। একলব্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে দ্রোণাচার্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিয়েছিল। উচ্চজাতের পক্ষ নিয়ে নিম্নজাতের প্রতি দ্রোণাচার্যের এই অন্যায় আদেশ রূপান্তর চলচ্চিত্রের মূল থিমের সূচনাবিন্দু।

এই ধারণাকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে আরিফ পড়ে বিপদে। কারণ স্থানীয় সাঁওতালরা দাবি করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে তীরচালনার কোনো ব্যাপারই নেই। আরিফ বোঝার চেষ্টা করে যে একলব্যর তীরন্দাজীকে খর্ব করার জন্যই যদি বৃদ্ধাঙ্গুলি বিসর্জন দেয় একলব্য, তাহলে তারই অনুসারীরা (সাঁওতালরা নিজেদের একলব্যের অনুসারী দাবি করে, কারণ তারাও নিম্নজাতের এক জনগোষ্ঠী) কেন বৃদ্ধাঙ্গুলি আদৌ ব্যবহার করেনা? মহাভারতের রেফারেন্স একালে কাজে দিচ্ছে না। রেফারেন্সবিহীন মধ্যবর্তী সময়টায় বৃদ্ধাঙ্গুলি থেকে ক্রমশ তর্জনী-মধ্যমায় সরে আসার বিষয়টিকেই পরিচালক মানুষের ক্ষমতার রূপান্তর হিসেবে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। উচ্চজাতের ক্ষমতাবানদের অন্যায় আদেশের প্রতি নিম্নজাতের মানুষদের টিকে থাকার কৌশলের রাজনৈতিক ইতিহাসটিকে আবু সাইয়ীদ রূপান্তর চলচ্চিত্রে বিধৃত করতে চেয়েছেন, যদিও সেই ইতিহাস কোথাও লেখা নেই।

নিপীড়িতের লড়াই-সংগ্রাম-নিবিষ্টতার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে রূপান্তর। তবে এই পুরাণ-আখ্যানকে বিশ্বস্তরূপে চিত্রায়ণ করার জন্য যেরকম বড় ক্যানভাস বা ভৌগোলিক বিন্যাস ফ্রেমবন্দি করা প্রয়োজন ছিল, চলচ্চিত্রে তার ঘাটতি ছিল বলা যায়। যে লোকেশন চলচ্চিত্রটির জন্য বেছে নেয়া হয়েছে তা বাংলাদেশের বিচারে মন্দ নয়, কিন্তু তা মহাভারতের মহা আখ্যানের তুলনায় সামান্য মনে হয়। পাণ্ডবদের তীরচালনায় প্রশিক্ষণপ্রদান করছেন দ্রোণাচার্য -- শুরুর সেটটাকেও বিশ্বস্ত মনে হয়না। আরিফ ও তার সহকারি পরিচালক শায়লার সংলাপগুলোও ম্যাড়মেড়ে লাগে, কিছুটা অনির্দিষ্টও ঠেকে।

ছবিতে শায়লা একমাত্র নারীচরিত্র, তার সঙ্গে আরিফের সম্পর্কটিকে নৈর্ব্যক্তিক এবং পরিচালক ও সহকারীর পেশাদারিত্বের ঘেরাটোপে বন্দি রাখার মাধ্যমে নাটকীয়তা সৃষ্টির সুযোগ হারিয়েছেন পরিচালক। এরকম ‘চলচ্চিত্র নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র’গুলোতে (ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ডে ফর নাইট, মৃণাল সেনের আকালের সন্ধানে এরকম চলচ্চিত্র) সাধারণত ভেতরের চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বাইরের চলচ্চিত্রেও যথেষ্ট পরিমাণ ঘটনা ও কাহিনীবিন্যাস বরাদ্দ থাকে। কিন্তু রূপান্তর চলচ্চিত্রে বাইরের অংশে কাহিনী বলতে আরিফের বিভ্রান্তিতে পড়া এবং শায়লা বা সাঁওতালদের সঙ্গে সেবিষয়ে আলাপ। তবে সাঁওতাল নারীদের নৃত্যগীত ও পুরুষদের বাদ্য চলচ্চিত্রে ভিন্ন এক দ্যোতনা এনেছে। এই নৃত্যগীত চলচ্চিত্রে সাজেস্টিভ, মূল ন্যারেটিভের সঙ্গে তার যোগ নেই -- কোনো উপলক্ষ্য নয়, চলচ্চিত্রের নাটকীয়তাকে প্রলম্বিত করার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

বিশেষত আরিফ যখন মাঝরাতে তর্জনা ও মধ্যমা টেবিলল্যাম্পের ওপরে রেখে ছাদে ছায়া ফেলে তীরচালনা কৌশলের রূপান্তর বুঝতে মগ্ন, তখন ক্রস কাটিং সম্পাদনার মাধ্যমে ভিজ্যুয়ালে বা নেপথ্যের শব্দে সাঁওতালদের নৃত্যগীত দেখা বা শোনা যায়। রূপান্তর ২০০৭ সালে নেদারল্যান্ডের রটারডাম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের হুবার্ট বল ফান্ড থেকে অনুদান পেয়েছিল। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকেও অনুদান পায়। রূপান্তর ট্রাইবাল শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (ভারত) শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে ২০০৯ সালে। এরপরও রূপান্তর চলচ্চিত্রটিকে বলতে হয় চমৎকার এক থিমের গড়পড়তা চলচ্চিত্ররূপ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।