আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মনিরেপেক্ষতাবাদ কি কারনে ভারত বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে যুক্ত করল। আসুন জেনে নেই মেজর জলিলের ভাষায়।

সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ৯ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল। এখানে ধর্মনিরেপেক্ষতাবাদ কি কারনে ভারত বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে যুক্ত করল তার কারনগুলো তুলে ধরেছেন তিনি। এবার তৃতীয় স্তম্ভটির কিছু রহস্য উদঘাটন করা যাক। আওয়ামী লীগের ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। গভীর ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি সম্পন্ন বাংলাদেশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ আরোপ করার বিষয়টিকে মোটেই হালকা করে দেখার কোন অবকাশ নেই।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের জনগণের গভীর ধর্মীয় আবেগ-অণুভূতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভাবে ওয়াকিফ্‌হাল থাকা সত্বেও বাংলাদেশের উপর ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবদ’ চাপিয়ে দেয়ার মত এতবড় একটি ভুল পদক্ষেপ নিতে গেল কোন সাহসে? ভারতেরই অনুগত তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকারের মাথায় এতবড় একটি ভুলের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ভারত কি এভাবে আওয়ামী লীগেরই রাতারাতি ধ্বংস কামনা করেছিল? যদি উপরোক্ত প্রশ্নের একটিও সঠিক না হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের জনগণের উপর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চাপিয়ে দেয়ার অন্তরালে ভারতের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল? বাংলাদেশের জনগণ কেবল ধর্মপ্রাণই নয়, এ মাটির শতকরা ৯০ভাগেরও অধিক জনগণ পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্র ইসলাম একটি সার্বিক জীবন সত্তা, কেবল একটি গতানুগতিক ধর্ম নয়। ইসলাম ভিত্তিক গড়ে ওঠা এই সার্বিক জীবন সত্তা বোধকে রক্ষা করার জন্য এদেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। প্রতিবেশী ভারত এইতহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কোন কারণই নেই। এতো কিছু অবগতির পরেও ভারত আজ্ঞাবহ আওয়ামী লীগকে বাধ্য করেছে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা বহন করতে।

এর স্পষ্ট জবাব হচ্ছে ভারত মোটেই ভুল করেনি। আওয়ামী লীগের উপর ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দিয়ে ভারত আওয়ামী লীগেরও সর্বনাশ কামনা করেনি। ভারতের হিসেবে বিন্দুমাত্র ভুল নেই। আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতের প্রধান শত্রুকে ভারত চিহ্নিত করতে মোটেও ভুল করেনি। দর্শনগত ভাবে মার্কসবাদ ভিত্তিক সমাজতন্ত্রও তাদের শত্রু, কিন্তু সে শত্রু তেমন জোরালো নয়।

সে শত্রু আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে শূণ্য এবং রাজনৈতিগত ভাবে দুর্বল। ভারতীয় পুঁজিবাদের দাপট এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতার জোর দিয়ে তারা সমাজতন্ত্র নামক শত্রুটির শ্বাসরুদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হবে। কিন্তু যে শত্রুটির ভয়ে তার প্রকম্পিত তাকে তো পুঁজিবাদ, কিম্বা পৌত্তলিকতাবাদ ভিত্তিক ঠুনকো আধ্যাত্মিকতার জোরে কোনক্রমেই বশ করা যাবে না। তৌহীদবাদ ভিত্তিক পবিত্র ইসলামকই হচ্ছে ভারতের প্রধানতম ভীতি। ইসলামের ঐতিহ্যবাহী নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ এবং আশ্চর্যজনক আধ্যাত্মিকতার সম্মুখে ভারত যে কোন এক সময় নিরুপায় হতে বাধ্য হবে সে তত্ত্ব ও রহস্য আমরা অনুভব করতে সক্ষম না হলেও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের ধারক-বাহক ভারতীয় শাসকচক্রের মোটেও অজানা নয়।

বিশাল ভারতের বিভিন্ন সংকটের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংকট হচ্ছে একটি অন্যতম প্রধান সংকট। জাতীয় এবং আন্তর্জাহিক ক্ষেত্রে ভারত নীতিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করলেও ভারতীয় সমাজ জীবনের বুনোট এখনো হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিশপ্ত বর্ণবৈষম্যের প্রভাব মুক্ত মোটেও নয়। হিন্দু ধর্মের এই বর্ণবৈষম্য অথবা ‘জাত ও শ্রেনী’ ভেদ-এর কারণে প্রায়শই ভারতের বুকে যে উদ্‌গীরণ ঘটে, তা অগ্নিগিরির লাভার চেয়েও ধ্বংসাত্মক। এ ধরনের উদ্‌গীরণ ভঅরতীয় জীবনের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ছক তছনছ করে দেয়। ভারতের ৭৫ কোটি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ভারত হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা না করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ অবলম্বন করতে বাধ্য হলো কেন? কারণটা সহজ।

সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চাপের মুখে ভারতকে যদি ১৯৪৭ সালে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হতো তাহলে তাতে আপত্তির কিছুই থাকত না। কিম্বা ভারতে বসবাসরত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তেমন কিছু করারও থাকত না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ তাতে বরং খুশীই হতো। কিন্তু তা করা হয়নি কেবল আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য। কারণ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হলে ভারতের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারত।

ভারতের বাইরে কোন হিন্দুরাষ্ট্র নেই, তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধু হিসেবে সহজে কাউকে নীতিগতভাবে পেত না। দ্বিতীয়ত, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হলে ভারতের আভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক সংকট তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা থাকত এবং সে কারণেই ভারত জাতীয়ভাবে থাকত বিধ্বস্ত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হয়ে পড়ত বন্ধুহীন। এই দ্বিমুখী সংকট উত্তরণের লক্ষ্যেই ভারত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকে নাখোশ করেও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকেই রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষনা করতে বাধ্য থেকেছে। ভারতীয় শাসক চক্র এ কথা ভাল করেই জানে যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের জাত-শ্রেণীভেদের বিষবাষ্প কেবল তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ ঘোষনার প্রলেপ দিয়ে মুছে ফেলা যাবে না। তবু তো বাহ্যত চোখ লজ্জা থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পাওয়া গেল।

দেশের অভ্যন্তরে হিন্দুধর্মের জাত-শ্রেণীভেদের অনলে দেশ ও জাতি ঝুলতে থাক, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’-এর আনুষ্ঠানিক লেবাস দিয়ে বন্ধু সন্ধানে তো কোন বেগ পেতে হবে না। ভারতের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়ার মূল ব্যাপারটা এখানেই। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার’ আড়ালে ভারত যে একটি সাম্প্রদায়িক হিন্দুরাষ্ট্র এ সত্য আজ বিশ্বে কার না জানা? এই হিন্দু ভারত হিন্দু ধর্মের জাত-শ্রেণী ভেদের বিপরীতে ইসলামী সাম্যবাদকে যমের মতই ভয় পায়। ভয় তো পাওয়ারই কথা, কারণ জাত-শ্রেণী ভেদের কঠিন অভিশাপের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষ বিদ্রোহ যে একদিন করবেই তা ধ্রুব সত্য এবং ইসলামের সাম্যবাদী নীতি ভারতরে নির্যাতিত মানব গোষ্ঠীকে আকস্মিক ভাবেই ইসলামের পতাকাতলে সমবেত করতে পারে। বাংলাদেশের ১১ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১০ কোটিই হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারী।

তাছাড়া, বাংলাদেশের বিস্ময়কর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা নেই বলেই অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা কখনই নির্যাতিত কিম্বা সামাজিক ভাবে সংকটাপন্নও হচ্ছে না। তেমন একটা কিছু হলেও না হয় আধিপত্যবাদী ভারতীয় চক্র বাংলাদশের উপর সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার একটা সুযোগ লাভ করত। তেমন তো কোন সুযোগ নেই, কিন্তু বাংলাদেশের উপর ভারতের কর্তৃত্ব কোন না কোন উপায়ে তো প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপনের তেমন কোন প্রয়োজন পড়বে না। সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বাংলাদেশের উপর অটোম্যাটিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে যাবে।

বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতি হচ্ছে ইসলাম ভিত্তিক, কারণ ইসলামই হচ্ছে শতকরা ৯০ ভাগ জনগণের ধর্ম এবং ধর্মকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন। তাই ইসলাম ধর্মের গভীর আবেগ অনুভূতির শিকড় থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে বিচ্ছিন্ন করতে হলে প্রয়োজন এমন একটি দর্শন, যা মানুষকে ইসলাম ধর্মের কঠিন অনুশাসন মেনে চলার পথে নিরুৎসাহ করে তুলবে। অপরদিকে, তরুণ-যুবক শ্রেণীকে প্রলুব্ধ করবে এক বাঁধনহারা জীবন যাপনের এক ফাঁদে পা দিতে। ধীরে ধীরে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুপস্থিতি তরুণ-যুবক শ্রেণীকে বেপরোয়া আরম-আয়েশ, ভোগপূর্ণ উচ্ছৃংখল জীবন পদ্ধিতর দিকে ঠেলে দিলেই তারা হয়ে পড়বে শিকড়হীন পরগাছারমতন। তাদের আবেগ-অনুভূতি সমাজের গভীরে প্রোতথিত থাকবে না বলেই তারা হবে ভাসমান উচ্ছৃংখল জনগোষ্ঠী।

তখন তারা আ ইসলামের ঐতিহ্যে গর্ববোধ করবে না এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। কারণ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ তরুণ-যুবকদেরকে ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে এবং ধর্মীয় অনুভূতি একেবারেই মিটিয়ে দেয়া। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীনতারই লেবসী নাম। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে বস্তুভিত্তিক দর্শনের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভংগী। এই দৃষ্টিভংগী চূড়ান্তভাবেই বস্তুকেন্দ্রিক এবং অধিবিদ্যামুক্ত।

এই দৃষ্টিভংগীর আওতায় স্রষ্টা কিম্বা পারলৌকিক কোন শক্তির কোন স্থান নেই। সুতরাং ধর্শেরও কোন স্থান নেই। মুসলিম তরুণ-যুব গোষ্ঠি এই নাস্তিক্যবাদী তত্ত্বে প্রভাবিত হলে তারা স্বেচ্ছায়ই ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে উঠবে এবং তাহলেই ভারতীয় শাসকচক্রের গোপন স্বপ্ন বাসতবায়িত হয়ে যায়- অর্থাৎ বাংলাদেশের উপর ভারতীয় সংস্কৃতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে একটি সুকৌশল ঠান্ডা যুদ্ধ। ভারত তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষবাদ জুড়ে দিয়ে মোটেও ভুল করেনি, অথবা নিছক লক্ষ্যহীন ভাবেই ধর্মনিরপেক্ষবাদ জুড়ে দেয়নি।

এতো গেল বাংলাদেশের রাষ্টীয় ৪ মূলনীতির তৃতীয় স্তম্ভ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।