আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তারপর সুমনের দিন

এতকিছু ... ওই সিনেমার জন্যই... ২০০১ এর ৯/১১ এর সময়টাতে আমি কলেজে পড়তাম। ঢাকা থেকে সবে গিয়েছি, আর মফস্বলের একটা কলেজে ভর্তি হয়েছি। তিন চার দিন ক্লাস করার পর ৯/১১ এর দুর্ঘটনাটা ঘটল। ওই সময়টাতে আমি ঢাকা ছাড়ার কারনে হোক আর যে কারনেই হোক মনটা অন্যকোথাও ছিল। এতো বড় বাড়িতে আমি আর আব্বা মা।

অদ্ভুত রকম বিষণ্ণতা কাজ করতো। এর মাঝে বৃষ্টি নামত। আমি পড়াশুনা করতে পারতাম না। আমি কিছু লিখতেও পারতাম না। আমি যেটা করতাম সেটা হল রেডিও শুনতাম।

এরকম এর আগেও একবার হয়েছিল। ক্লাস এইট এ পড়ার সময়। আমার আবার ক্লাস এইট দুইটা। প্রথমটার কথা বলছি। প্রথমবার অঙ্কে ৩৩ ৩৪ পেয়ে বাজে অবস্থা, দ্বিতীয়বার কিন্তু এই আমিই অঙ্কে হায়েস্ট নাম্বার পেয়ে ফার্স্ট হয়ে যাই।

কলেজে যাই, ক্লাস করি। কোন বন্ধুবান্ধব নেই, যাদের সাথে আমি আমাকে শেয়ার করতে পারি। দুই-এক জনের সাথে টুকটাক কথা হয়, মনের মিল হয় না। ইংরেজি পড়াতেন দিলিপ বাবু। দিলিপ বাবুর সাথে বেশ অন্তরঙ্গতা হল।

তিনি ক্লাস শেষে চা খাবার জন্য আমাকে নিয়ে ছাতিম তলা যান। বসে বসে দুজন গল্প করি আর চা খাই। সেই দোকানটা খুব অন্যরকম, পাঠখড়ির বেড়া দিয়ে তৈরি দোকান; বাঁশের চড়াটে বসে পা দুলিয়ে চা খেতে হয়। আমি আর দিলিপ স্যার যখন চা খাই তখন আর কেউ আসে না, যাদের সাথে আমি পড়ি, ক্লাস করি। চায়ের দোকানের পাশে বিরাট এক ছাতিম গাছ, তার নিচে বসি মাঝে মাঝে।

অন্য এক ঘ্রাণ। তার পাশে একটা পুরনো দালান, সেখানে কৃষি ব্যাংক। ব্যাংকের পাশে হাই স্কুল। স্কুলের নাম হাবাস পুর কাশিম বাজার রাজ উচ্চ বিদ্যালয়। এলোমেলো বসে থাকি ফাকে ফাকে ক্লাস করি, মন চাইলে।

আর বাংলা ক্লাসে ম্যাডামের সাথে বাংলা কবিতার ছন্দ নিয়ে তর্ক করি। এর মাঝে একদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে মাথা খারাপের মত অবস্থা। ওখানে সেবার প্রায় সব বই আছে আর হুমায়ূন আহমেদএর অনেক দুর্লভ বই সহ প্রায় সব বই। দেশের কোন কলেজে পাঠ্য বই এর বাইরে এত বই আছে কী না সন্দেহ আছে। যাহোক লাইব্রেরিয়ানের সাথে খাতির হয়ে গেল।

ব্যাটা বাইরে খেতে গেলে আমার কাছে লাইব্রেরি রেখে যায়। আমি বসে বসে বই পড়ি। আর জানলা দিয়ে আখের খেতের দিকে তাকিয়ে থাকি। বেশিরভাগ সময় ই হুমায়ূন আহমেদ এর বই পড়া হয়। হুমায়ূন আহমেদের একটা কবিতা সংকলন ও পেলাম।

এ অদ্ভুত এক ঘোরের জগত। দুপুর দুটোয় কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, তারপর নিরুপায় হয়ে বাড়ি চলে আসি। বাসে ভাড়া ন্যায় এক টাকা, ভ্যানে তিন টাকা। দূরত্ব কিন্তু নেহায়েত কম না। তিন চার কিলোমিটার।

বাড়িতে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমাই। বিকেল হলে নদীর ধারে যাই, নয়ত মাঠের ভেতর হাঁটি, ঘাসের উপর। এর মাঝে সন্ধ্যা নেমে এলে বাড়িতে ফিরি। কী এক বিষণ্ণ জগত। আলাদা করে ভাল লাগা কিছু নেই, আলাদা করে মন্দ লাগা কিছু নেই।

এর মাঝে কিছু আত্মীয় স্বজন মারা গেলেন, তাদের দেখতে যাই। আব্বার এক বন্ধুর মা মারা গেলেন। বাড়ির পাশেই ওনাদের বাড়ী। সন্ধার পর দাফন হবে, অদ্ভুত ঘোরলাগা জোছনা। তার আগের দিন বৃষ্টি হবার কারনে মাঠ একদম নরম হয়ে আছে।

আমরা লাশ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, মাথার উপর জোছনা, পায়ের নিয়ে তুলোর মত নরম মাটি। বাড়ী ফিরে অঙ্ক করতে বসলাম, পারমুটেশন, কম্বিনেশন। ভাল্লাগেনা। অঙ্ক খাতার শেষে পাতায় মৃত্যু নিয়ে কয়েকটা লাইন লিখলাম। বহুদিন পর কিছু একটা লিখলাম।

রাত বাড়তে থাকে, ওই রাতেই নিজের মৃত্যু নিয়ে আরেকটা লেখা লিখলাম। রাত্রি আরও বাড়ে, নিজের ঘরের বাইরে আসি বেলী ফুল গাছের নিচে দাঁড়াই। মাথার উপর সেই একই চকচকে জোছনা। দূরে একটা পাখি ডেকে ওঠে বাবলা গাছে, গা ছমছম করে। ঘরে ঢুকে শুয়ে থাকি।

রেডিওর নব ঘুরিয়ে কিছুই শোনা যায়না। সব চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে আব্বার কাছে থেকে এক টুকরো জমি নিলাম। আমার কিছু পিচ্চিদের সাথে খাতির ছিল। তারা কাজ করল আমার সাথে, কুপিয়ে জমি প্রস্তুত করা হল।

আর দেয়া হল গবর সার। তারপর সেখানে ভুট্টার বীজ লাগিয়ে দিলাম, বীজ গজিয়ে গাছ বাড়ে। আমার ভীষণ ভাল লাগে। এগুলো ছিল খেতের চারপাশ দিয়ে। মানে এটা কেবল তবলার টুংটাং।

পুরো ক্ষেতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করলাম। একসময় ফুল ফুটে গেল, সকাল আর বিকেল এক হলুদের ভিতর, সূর্যমুখীর ঘ্রাণের ভিতর বুঁদ হয়ে থাকি। আমার মনেহয় মহাত্মা ভিন্সেন্ট ভ্যান গঘের কথা, যিনি বলেছিলেন মানুষের আত্মার রঙ হলুদ কষ্টের রঙ হলুদ আনন্দের রঙ হলুদ। ছবি: ফোর কাট সানফ্লাওয়ারস, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ Aug-Sep 1887 60 x 100cm Rijksmuseum, Amsterdam  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।