আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার স্বপ্নচারিনী অপরিচিতা

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । তবে স্বপ্ন দেখা নিয়ে কিছুদিন যাবত একটা সমস্যা হয়ে গেছে । নতুন দেখা স্বপ্নগুলো কেন যেন পূরণ হচ্ছে না খুব শীঘ্রই এই সমস্যা কেটে যাবে এই আশাতেই আছি । অন্যদের দৃষ্টিতে সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গার তেমন তোড়জোড় ছিলো না । পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে আগের দিন ।

তাই আজ আর চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘুম থেকে তুলে দেওয়ার কথা মনে হয় নি কারো । অথচ আজই খুব সকালে উঠার দরকার ছিল । এই সকালটাতে আমার ব্যস্ততা ইউনিভার্সিটির ৬.৩০ এর বাস ধরার থেকেও বেশি । কারণ আজ সত্যিই খুব বিশেষ একটা দিন । আমার ঘুম কখনই একবারে ভাঙ্গে না ।

খুব দেরী করে ঘুম আসে আর প্রায় রোজ রাতেই একটা দুঃস্বপ্ন দেখি । প্রতি রাতে একই ব্যাপার । সঠিক বলতে পারবো না ঠিক কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে , এখন মাঝে মাঝে মনে হয় এই দুঃস্বপ্ন বোধহয় জন্ম থেকেই আমার সঙ্গী হয়ে আছে । দেখি- রাস্তা দিয়ে হাঁটছি । পড়নে কনুই পর্যন্ত গুটানো একরঙা সাদা ফুল হাতা শার্ট আর নীলচে জিন্সের প্যান্ট ।

ঢাকা শহরের কোন রাস্তাই যেন । আদলটা বেশ পরিচিত । তবে স্বপ্ন বলেই বিধাতা হয়ত করুণা করে যানজট , ধোঁয়া আর অসহ্য গরমের ব্যাপারগুলো রাখেন নি । তার বদলে তৈরি করে দিয়েছেন কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা পায়ে হাঁটা কোন ফুটপাথ । একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হওয়ায় সবুজে ঝলমল করছে গাছের পাতারা ।

স্বপ্ন শুনেছি সাদা কালো হয় । কিন্তু নিজের জীবন বাস্তবে খুব বেশি রঙিন না হলেও , স্বপ্নের বেলায় অন্তত আমাকে অন্যদের থেকে ভাগ্যবান বলা যেতেই পারে । স্বপ্নের আকাশটা সব সময়ই আশ্চর্য রকম নীল থাকে । আমি আকাশের দিকে চোখ রেখে আপন মনে হাঁটি । দু‘হাত পকেটে , মুখ দিয়ে শীষ্ বাজানোর বৃথা চেষ্টার ফলাফল আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষদের বিরক্তিমাখা অদ্ভুত চাউনি ।

আমি কিন্তু নির্বিকার । রাস্তাটা যেখানে বাঁ দিকে বেঁকে গেছে তার ঠিক আগের ল্যাম্পপোস্টটার নিচে অল্প বয়সী বেশ মায়াকারা চেহারার একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । তার হাঁতে টকটকে লাল গোলাপের একটা তোড়া । প্রতিদিনই তোড়াটা আমি তার থেকে নেই । আমার গন্তব্য রাস্তার ঐ বাঁকটার পরের ছোট্ট একটা পার্ক ।

যেখানে ঢোকার মুখের কয়েকটা বেঞ্চের পরে বিশাল একটা বটগাছ । ছায়া ঢাকা শান বাধানো বেদীতে আমার জন্য একজন অপেক্ষায় আছে । আমার যত আয়োজন , ব্যস্ততা তার জন্যই । গোলাপগুলো তার হাতে তুলে দেয়ার পর সে কতটা খুশি হতে পারে ভাবতে ভাবতে অদ্ভুত এক আনন্দে আমার নিজের মুখই হাসি হাসি হয়ে যায় । ভাবি কতটা ভণিতা করব বা অন্য কারো জন্য ফুলগুলো এনেছি বলে তাকে রাগাবো কিনা ।

হ্যাঁ , তাকে রাগাতে আমার খুবই ভালো লাগে । কারণ রাগ ভাঙ্গার পর যখন সে কেমন করুন অভিমানী এক চোখে তাকায় , নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হয় । তার কাজল লেপটে যাওয়া চোখে তাকিয়ে নিজেও কেমন এক গভীর মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই । মনে হয় , আমার পৃথিবীটা এতো অসহ্য সুন্দর কেন ? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে স্বপ্নেও আরও একবার ঘোরের মধ্যে চলে যাই নিজেও জানি না । ঘোর কাটে প্রচণ্ড হর্নের শব্দে ।

ততক্ষণে চারপাশ থেকে কৃষ্ণচূড়া , পাতার সবুজ ,আকাশের নীল আর পথচারীরা সবাই উধাও হয়ে গেছে । আমি দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার ঠিক মাঝখানে । তারপর সময় ধীর হয়ে যায় । গোলাপের তোড়াটা নিজে রাস্তায় ছিটকে পড়ার পরও হাত থেকে ফেলে দেই না । অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নিজের রক্তে ভেসে যাওয়া রাস্তাটার দিকে তাকাই , তারপর চোখ যায় তার জন্য নিয়ে আসা ফুলগুলোর দিকে ।

চশমাটা ভেঙ্গে যাওয়ায় সবকিছু কেমন ঝাপসা লাগে । তবুও আমার রক্তের লালের কাছে গোলাপের লাল হার মানে প্রতিদিনই । এরপর ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব রং আরও অস্পষ্ট হয়ে হয়ে আসে । ঘুম ভেঙ্গে দেখি শরীর ঘামে ভিজে গেছে । কেমন যেন বিষণ্ণ লাগে খুব ।

আহা , বেচারি অপেক্ষায় বসে আছে । যার অপেক্ষা মেটাতে প্রতিদিন ছুটে যাই আজও তার মুখটা দেখা হলো না । এই দুর্বিষহ স্বপ্ন দেখতে দেখতে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন । জেগে উঠার পরও এর রেশ কাটে না । সারাদিনই মনটাকে নানা এলোমেলো চিন্তা তাড়া করে ফেরে ।

আজ সকালে আমার তাড়াহুড়ার কারণ ঐ মানুষটাই । তার সাথে দেখা হবে । আচ্ছা , আমার স্বপ্নচারিনীর মুখটা কেমন ? জানি মনে মনে যদিও হাজারটা অবয়ব ভেবে রেখেছি বাস্তবে হয়তো তার কোনটাই মিলবে না । তার সাথে আমার পরিচয় তার ঐ গলার স্মরটুকু আর স্বপ্নের ঐ অদ্ভুত বিষাদ মাখা চোখ দুটো পর্যন্তই । পরিচয়ের বছর পেরিয়ে গেছে ।

কথার ফুলঝুরির অভাব হয় নি কারোরই । কিন্তু কেন যেন সামনে দাঁড়ানোর সঙ্কোচটুকু দুজনের একজনও দূর করতে পারছিলাম না । শেষ পর্যন্ত আমাকেই পারতে হল যখন দেখলাম এখনও যদি কিছু না বলি তাহলে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কিন্তু অপরিচিত কাছের মানুষটাকে হয়তো চিরদিনের মতো অন্য কারো কাছে হারাতে হবে । আজ সব বলবো তোমায় । আমার মনের জ্যোৎস্না , অমাবস্যা সব গলির দরজাই খুলে দেবো তোমার জন্য ।

খুলেতো রেখেছি সেই কবেই , তুমি জানো না কেবল । অন্ধকার ঘরের একমাত্র আলোটাও নিভে যাবে এই ভয়ে তোমাকে না বলা রাতের পর রাত জেগে ভাবা হাজারটা কল্পনার কথাও জানিয়ে দেবো আজ । খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে জানাতে যে আমাকে হবেই । রাস্তায় বের হয়ে মনে হলো আকাশের উজ্জ্বল রোদ যেন কেবলমাত্র আমার দিকে তাকিয়েই হাসছে । কে বলবে সকালে বেশ বৃষ্টি ছিল ? ঠিক করেই বাসা থেকে বের হয়েছি একটু দেরীতে পৌঁছব ।

আমার জন্য কেউ পথ চেয়ে বসে আছে এই ভাবনাটাই আজন্ম নিঃসঙ্গ আমাকে রোমাঞ্চিত করে । গলির মোড়ের ফুলের দোকানটাও হয়ে যাব ভেবে রেখেছি । আজ আমার সব সংকোচ ভাঙার দিন । তোমার জন্মদিনের সাথে মিল রেখে সবচেয়ে সুন্দর ২০টা গোলাপ দিয়ে বানানো তোড়াটা নিয়ে যখন বেরুবো তখন দোকানের একপাশে বসে থাকে ছোট্ট একটা মেয়ের দিকে চোখ পড়লো । থমকে দাঁড়ালাম ।

এই মুখ তো আমার অতি চেনা ! সেই বাচ্চা মেয়েটা যে প্রতিদিন আমাকে দেওয়ার জন্য ফুলের তোড়া হাতে দাড়িয়ে থাকে । কিন্তু এ কি করে সম্ভব ? স্বপ্ন তো চিরকাল স্বপ্নই । কেমন যেন এক ঘোরের মধ্যে আবার হাঁটা শুরু করলাম । মাত্র যা দেখলাম তাকি শুধুই আমার কল্পনা , নাকি বাস্তব ? হাঁটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বারবার । মনে হচ্ছে পায়ের নিচের মসৃণ পিচ ঢালা রাস্তাটা উঁচুনিচু হয়ে গেছে ।

হঠাৎ কে যেন কাছেই চিৎকার করে উঠলো । সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখি সবকিছু ঠিক আমার ঐ দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে গেছে । রাস্তার মাঝে আমি একা দাড়িয়ে আছি । আমাকে চাপা দিতে ছুটে আসা গাড়ির ড্রাইভারের ভয়ার্ত মুখটাও স্পষ্ট দেখলাম । ব্যবধান কমছে প্রতি মুহূর্তে ।

কি হচ্ছে এসব ?? আবার সেই স্বপ্নটাই দেখছি নাতো ?? একটু পরেই হয়তো ঘুম ভেঙে যাবে , চোখ মেলে দেখবো ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে সকালের কাঁচা রোদ ঘরে আসছে আর সেই বিষণ্ণতাটা গ্রাস করবে আরও একবার । নাকি এ বাস্তব ?? যদি তাই হয় দুঃস্বপ্নের মতো আমি আজ আর পরাজিত হবো না । অপরিচিতা , তোমার মুখোমুখি আমাকে যে এক মুহূর্তের জন্য হলেও দাড়াতে হবে । অনাদিকাল ধরে খুঁজে বেড়ানো প্রিয়তম মানুষটার দেখা কোনদিনই পাবো না , পৃথিবীকে এতটা নিষ্ঠুর ভাবতে ইচ্ছা করে না । আর সত্যিই যদি এতো কাছে এসেও তোমার সামনে পৌছাতে না পারলাম , আমার আর্তনাদ তোমার কানে যাবেই ।

আমি জানি । হাজারটা শব্দের মধ্যে থেকে আলাদা করে চিনে নিয়ে আজ অন্তত ছুটে এসো । তোমার অজান্তে হলেও পাশেইতো ছিলাম আজীবন , আজও আমি খুব কাছেই আছি । - খালিদ রহমান ফাইনান্স বিভাগ ( ৩য় বর্ষ ) , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।