আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিম্নমধ্য গন্ডি

টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল মারুফ নিজেও জানেনা। যখন ঘুম ভাঙ্গলো, তখন তার বিছানা আর বালিশের বেশ কিছুটা অংশ ভিজে গেছে বৃষ্টির ছাটে। তড়িঘড়ি উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে গ্রিলের সাথে লেগে হাতে খানিকটা ছড়ে গেল মারুফের। রাগ উঠে গেলে নিজেকে সামলাতে পারেনা মারুফ, এক ঝটকায় বালিশটা মেঝেতে ফেলে দিলো সে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পাতলা কাঁথাটার সাথে পা জড়িয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল মেঝেতে।

সামলে নিয়ে কাঁথা আর বিছানার চাদরটাও এক টানে নামিয়ে দিলো মেঝেতে। তারপর টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে সিগারেট ধরালো। মাথা দপদপ করছে রাগে। সামনে যা পাবে, ভেঙ্গে ফেলবে সে এখন। হাজার চেষ্টা করেও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা মারুফ।

মাঝে মাঝে সে জন্য বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে, কিন্তু সে নিরুপায়। আজকের সকালটা শুরুই হলো বাজে ভাবে। হয়তো সারাটা দিন এভাবেই যাবে। সিগারেট শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো মারুফ। টানা বারান্দাটার শেষ মাথায় বৃষ্টির পানি পড়ে পিচ্ছিল হয়ে ছিল, পা হড়কে গেল তার।

মেজাজটা আবার সপ্তমে চড়ে গেল মারুফের। বেশ শব্দ করেই কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিল সে, কাকে উদ্দেশ্য করে, কেউ জানেনা। তারপর ক্যান্টিনে গিয়ে ঢুকলো। তিনটা পরোটা, ডিম আর আলু ভাজি অর্ডার দিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। আজকে সকালে আর কারও সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারবে না সে, বুঝেই গেছে।

মারুফের এই চেহারার সাথে পরিচিত ক্যান্টিনের সবাই, সাবধানে ওর নাস্তাটা টেবিলে দিয়ে গেল রাজীব নামের পিচ্চি ছেলেটা। গ্লাস ভাল করে ধুয়ে পানি দিয়ে এলো এরপর। এত সকালে মারুফকে ক্যান্টিনে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছে ওরা সবাই। ততক্ষণে অবশ্য খেতে শুরু করে দিয়েছে মারুফ। আড় চোখে একবার শুধু দেখলো রাজীবকে।

এই দৃষ্টিতেই ভয় পেয়ে গেল ছেলেটা, পালিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। একজন দুজন করে ক্যান্টিনে আসতে লাগলো হলের অন্য ছেলেরা, ভরে উঠতে লাগলো ক্যান্টিন। সকাল বেলাতেই রফিক স্যারের ক্লাস, খাতা কলম গুছিয়ে শেষ বেঞ্চে গিয়ে বসলো মারুফ। বরাবর এখানেই বসে সে। মন মেজাজ ভাল থাকলে অন্যদের সাথে দু একটা কথা বলে, কিন্তু আজকের দিনটা ভাল না, তাই চুপ করে বসে রইলো সে।

সীমাহীন রাগের কারণে ওকে কিছুটা ভয়ই করে সহপাঠীরা। সহজে ওকে ঘাটাতে চায়না কেউই। আজকেও ওর চেহারা দেখেই ওরা যা বোঝার বুঝে গেছে, কেউ এগিয়ে এসে কথা বললো না ওর সাথে। মারুফও মনে মনে এটাই চাইছিল। বলা যায় না, কার কি কথায় আবার রাগ উঠে যায় ওর।

কিছুক্ষণ পর ক্লাসের বোকাসোকা আলাউদ্দিন এসে বসে ওর পাশে। কমন সেন্সের যথেষ্ট অভাব আছে এই ছেলেটার। কাকে কখন কি বলতে হবে, কিছুতেই বোঝেনা সে। বিরক্ত হয় মারুফ, কিন্তু কিছু বলে না। "একটা নতুন মেয়ে আসছে ক্লাসে, দেখেছিস মারুফ?" ফিসিফিসিয়ে বলে আলাউদ্দিন।

ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকায় মারুফ। মেয়েদের ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন সে, ক্লাসে নতুন কে আসলো, কে চলে গেল, এ ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই ওর। আর তাকেই কি না এই ছেলে বলছে নতুন মেয়েটাকে দেখেছে কি না। স্টুপিডিটির একটা সীমা আছে, এই ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে বোঝা যায় ওর স্টুপিডিটির আসলে কোন সীমা পরিসীমা নেই। মারুফের ঠাণ্ডা চোখ দেখেও দমে গেলনা আলাউদ্দিন।

বড় বড় চোখ করে আগ্রহের সাথে বলতে লাগলো - "মেয়েটা বিরাট সুন্দরী রে, ময়দার বস্তার মত ফর্সা, ইয়া বড় বড় চোখ, কলিজা কেমন করে যেন তাকাইলে। আর মেয়েটার নাম নদী"। মারুফের হাসি পেয়ে গেল ওর কথা শুনে। এইসব ছেলের ওপর সব সময় রাগ করাও যায় না, ওরা আজগুবি টাইপের কথা বলে হাসতে বাধ্য করে সবাইকে। ২) সপ্তাহ দুয়েকের ভেতর ক্লাসের সবার সাথে মিশে গেল নদী।

হাসি ঠাট্টায়, গানে, আনন্দে মাতিয়ে তুললো আড্ডা গুলোকে। ক্লাসের বাইরেও অনেকের সাথে কথা বলতে দেখা গেল ওকে। হাসি ছাড়া কথা বলতে পারেনা নদী। দিনে দিনে কলেজের কালচারাল ইভেন্ট গুলোতে সাবলীল হতে দেখা গেল ওকে। ক্লাস ব্রেকের বিরক্তিকর সময়ে এখন ক্লাসেই বসে থাকে বেশীরভাগ ছেলেমেয়ে, নদী খালি গলায় গান গেয়ে শোনায় সবাইকে।

মেঘলা দিনে বৃষ্টির গান, কারও মন ভার থাকলে আনন্দের কোন গান গেয়ে সবার অতি আপন একটা মানুষ হিসেবে স্থান করে নিলো মেয়েটা। কেবল একটা ছেলের সাথেই ওকে কথা বলতে দেখা যায়না, সে হচ্ছে মারুফ। মারুফের যে নদীকে ভাল লাগেনা, তা নয়। সে বরাবরই এসব ব্যাপারে নিঃস্পৃহ, কোন কিছুতেই যেন আগ্রহ নেই তার। একদিন লাইব্রেরী থেকে জটিল একটা নোট নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বেড়িয়ে আসছে মারুফ, করিডোরের অপর প্রান্তে তখন নদী, লাইব্রেরীতে আসছে।

হাতের ইশারায় মারুফকে থামালো নদী - - আমি নদী, আপনার নাম তো মারুফ, না? - হু, আমার নাম মারুফ। - একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না, আপনি এত ভাব নিয়ে থাকেন কেন সবসময়? কি জবাব দেবে খুঁজে পায়না মারুফ। মেজাজ খারাপ হবার মত কথা, কিন্তু কেন যেন রাগ করতে পারছেনা মারুফ, শুধু হাসে। - আমরা সবাই বন্ধু না? বন্ধুদের মাঝে কেউ মুখ গোমড়া করে থাকলে কি ভাল লাগে, বলেন? এই দেখেন, একই ক্লাসে পড়ে আমি আপনাকে আপনি করে বলছি। বন্ধুদের সাথে এই দূরত্ব রাখা কি ঠিক? - আসলে আমি কথাই কম বলি।

- কথা বেশী বলবেন ... বলবে, আচ্ছা? আমি এখন থেকে তুমি করে বলবো, তুমিও, আচ্ছা? এই দেখো, 'আচ্ছা' বলাটা কিন্তু আমার মুদ্রা দোষ। ওকে ... এখন যাই, ভাল থেকো কিন্তু মাথা ঝাঁকিয়ে চলে আসে মারুফ, জবাবে কিছু একটা বলা দরকার ছিল নদীকে, কিছুই গুছিয়ে বলতে পারেনা সে। কিন্তু মন ভরে থাকে অদ্ভুত এক আনন্দে। মেয়েটা আসলেও অন্য রকম। আকাশ ভরা রোদ যেন সাথে নিয়ে চলে সে, আলোকিত করে দেয় চতুর্দিক।

এক নিমিষে উড়িয়ে দেয় দূরত্বের দেয়ালটা। এরপর থেকে ক্লাসে টুকটাক কথা হয় ওদের, কিন্তু মারুফ তার স্বভাব বদলাতে পারেনা সেভাবে, শামুকের খোলসে ঢেকে রাখে নিজেকে, কেন রাখে নিজেও জানে না। কিন্তু কোন ভাবেই নিজেকে বদলাতে রাজী না সে, ও যা ও তাই, মারুফ নামের ছেলেটা একটু অন্য রকম, এটাই ওর পরিচয়। নিজেকে বড় কিছু বা সবার চাইতে আলাদা কিছু ভাবা নয়, এমনিতেই সে অন্য রকম। দিন গড়িয়ে যায়, এক সময় অবাক হয়ে মারুফ লক্ষ্য করে ক্লাসের বেশীরভাগ সময় ওর চোখ থাকে নদীর দিকে।

ক্লাসের পরের সময়গুলোতেও মাঝে মাঝেই নদীর কথা মনে পড়ে ওর। প্রথম প্রথম পাত্তা না দিলেও এক সময় মারুফ বুঝতে শুরু করে, সে নদীকে পছন্দ করে। কিন্তু ওর পক্ষে কোন মেয়েকে প্রোপোজ করা এক প্রকার অসম্ভব। নিজের কাটা গণ্ডীতে আটকা পড়ে আছে মারুফ নিজেই। সেখান থেকে বের হবার পথ জানা নেই ওর।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.