আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাংখ্য: বাংলার লোকায়ত দর্শন

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাংলার লোকগান বাঙালির মরমের কথা বলে বলেই মরমি। কিংবা বাংলার লোকগান নিগূঢ় দার্শনিক চিন্তায় আচ্ছন্ন বলেই মরমি । বাঙালির মরমে প্রতি পলে দার্শনিক চিন্তাস্রোত উত্থিত হয় বলেই বাঙালির একান্ত সত্তাটি গভীরতরো আধ্যাত্বিক চেতনা সমৃদ্ধ ।

আবহমান কাল থেকেই বাঙালির দার্শনিক ভাবনার নানান স্তর বাংলার মরমি লোকগান আজও সস্নেহে ধারণ করে রেখেছে। বাংলার লোকগানে গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব প্রচারিত হয় বলেই বাংলার লোকগান তত্ত্বভিত্তিক বা থিউরিটিক্যাল। যে গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বাংলার মাটিতেই সুদীর্ঘ বছরে গড়ে উঠেছে। মরমিতত্ত্ব বাংলার প্রতিনিয়ত সাধুসমাজে আলোচিত হয় বটে তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মরমিতত্ত্বের সংযোগ ওই লোকগানের মাধ্যমেই। আবহমান কাল ধরেই বাংলার মরমিয়া ভাবনাটি বাংলার বিশিষ্ট ভাবসম্পদ রূপে গন্য।

ভাটিয়ালি কিংবা ভাওয়াইয়া গানে ঠিক সেভাবে না হলেও - বাউল, মারফতি, দেহতত্ত্ব কিংবা মুর্শিদিগানের প্রতিটি চরণ নিগূঢ় তাত্ত্বিক ভাবনায় মোড়ানো। এর কারণ বাংলার মরমি লোকগানের ওপর স্পষ্টতই সাতটি দার্শনিক মতবাদের অতি গভীর এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব। এই দার্শনিক মতবাদগুলি হল: সাংখ্য, যোগ, তন্ত্র, বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব, সুফি ও বাউল। সুদীর্ঘকাল ধরেই সংগীত-মার্গ বাঙালির সাধনপদ্ধতি। চর্যার কবিরাও গান গাইতেন, গান গেয়ে তাদের রহস্যময় তত্ত্ব প্রচার করতেন ।

এভাবেই গানে ভিতর দিয়ে আবহমান বাংলার দাশনিক চিন্তাটি প্রকাশ পেয়েছে। দার্শনিকতত্ত্ব উপলব্দি ছাড়াই লোকগানের নিজস্ব মোহনীয় সুরের আবেশ বাঙালির স্পর্শকাতর স্নায়ূকে আচ্ছন্ন করে বটে- তবে মরমি গান পরিপূর্ণ উপলব্দির জন্য বাংলার দার্শনিক সিদ্ধান্তগুলির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় থাকা জরুরি বলে মনে হয়। এই উদ্দেশেই এই পোস্টে সাংখ্য দর্শন সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। সাংখ্যদর্শন বাংলার সবচে প্রাচীন ভাবদর্শন। এই দর্শন ২৭০০ বছরের পুরনো।

কেননা, সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা কপিল- এর জন্ম ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব। সাংখ্যদর্শন নিয়ে ব্যাপক গবেষনা করেছেন অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে। অধ্যাপক গার্বে কপিলের সময়কাল Seventh century b.c. বলে উল্লেখ করেছেন। সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল প্রাচীন বঙ্গবাসী ছিলেন। এবং এই তথ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই।

তার কারণ আবহমান কাল থেকেই বাংলা দার্শনিক চিন্তার লীলাভূমি। বাংলার এই মহত্তম দিকের ইঙ্গিত করে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন: ‘আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড় অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ। ' (সোনালি কাবিন) সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল যে প্রাচীন বঙ্গবাসী ছিলেন সেটি বিশিষ্ট গবেষক তপোব্রত সান্যাল এর লেখার সেরকম ইঙ্গিত রয়েছে। গঙ্গা: তত্ত্ব ও তথ্য বইতে তপোব্রত সান্যাল লিখেছেন: ‘ প্রাচীনকালের লেখকরা বঙ্গকে উপেক্ষা করলেও মহামুনি কপিলের সঙ্গে গঙ্গার সম্পর্কে কে মান্য করেছেন। সাংখ্য-দর্শনের প্রবর্তক কপিল যে বঙ্গবাসী ছিলেন, তার প্রমান আছে।

সাংখ্যই ভারতের প্রাচীনতম দর্শন। বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বের উৎসও এই সাংখ্যদর্শন। বস্তুত, বুদ্ধের দু’জন গুরুই ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী। সনাতন ধর্মাবলম্বী আর্যশাস্ত্রীরা কপিলের লোকায়ত সাংখ্যশাস্ত্রকে কখনোই মেনে নেন নি, কারণ কপিল বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেননি। মনে হয় এই কারণেই বৌদ্ধ-অধ্যুষিত বঙ্গ আর্যদের দ্বারা অবহেলিত হয়েছে।

’ (পৃষ্ঠা ১৬)। অধ্যাপক রিচার্ড গার্বে লিখেছেন, "In Kapila’s doctrine, for the first time in the history of the world, the complete independence and freedom of the human mind, its full confidence in its own powers were exhibited." ( দেখুন: পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর লেখা The Discovery of India.( P.184) তথ্যটি শিহরিত করে! কাজেই, আয়োনিয়ার থালেস নন - বরং বিশ্বের প্রথম মানবতাবদী দার্শনিকটির নাম কপিল। এবং তাঁর জন্মস্থান প্রাচীন বাংলা! কবি আল মাহমুদ এর সোনালি কাবিন কাব্যে কপিল-এর মুক্ত স্বাধীন মানসিকতার উল্লেখ রয়েছে- আমার তো কপিলে বিশ্বাস প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ। (তার মানে প্রেম স্বাধীন মুক্ত। যে প্রেম কোনও দিনই ধর্ম কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল নয়।

প্রেম সামাজিক নয়- এমনও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে এই চরণ দুটিতে। আর কপিলের একজন দার্শনিক এর উল্লেখ থাকায় বোঝায় যায় বাংলার লোকায়ত মতের স্বাধীনতার ভিত্তি ... ) ‘সাংখ্য’ শব্দটি এসেছে ‘সংখ্যা’ শব্দটি থেকে। সাংখ্যদর্শনের প্রবর্তক কপিল মহাবিশ্বের উদ্ভব ব্যাখ্যা করেছেন। মহাবিশ্বের উদ্ভব ব্যাখ্যা করার সময় কপিল ‘পঞ্চবিংশটি সংখ্যক’ তার মানে ২৫টি জাগতিক পদার্থের উল্লেখ করেছেন। সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে বলেই দর্শনটির নাম সাংখ্য-এরকমই অনেকেই মনে করে থাকেন ।

এখানে বলে রাখি। কপিল তাঁর দার্শনিক মতবাদের ঠিক কী নাম দিয়েছিলেন তা আমরা জানি না। এর কারণ কপিলের প্রাচীনত্ব। কপিল ইতিহাসের এক ধূসর সময়ে বেঁচে ছিলেন। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে উত্তর ভারতে ঈশ্বরকৃষ্ণ নামে একজন পন্ডিত বাস করতেন।

ইনি ‘সাংখ্যকারিকা’ নামে সংস্কৃত ভাষায় একটি ছোট বই লেখেন। কি ছিল সেই বইতে? কপিলের সাংখ্যদর্শন বিষয়ে সত্তরটির মতন শ্লোক। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকাই সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের প্রধান উৎস। বিশ্বজগতের উদ্ভব কী ভাবে হল কপিল তার নিজস্ব একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর এই ব্যাখ্যা একুশ শতকের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী কতদূর সত্য সেটি প্রতিপন্ন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

আমাদের উদ্দেশ্য হল প্রাচীন বাংলার একজন চিন্তাশীল মানুষ ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত থেকে বিশ্বজগতের উদ্ভব কীভাবে হল সেটি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন । বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই বিষয়টির তাৎপর্য অনেক গভীর বলে মনে করি। এবং কপিল প্রাচীন বঙ্গের অধিবাসী ছিলেন বলেই আমরা তাঁর মানবিক কৃতির উত্তরাধিকার ... এই ভেবে শিহরিত হই। প্রাচীন ভারতে ছয়টি দার্শনিক মত ছিল । সাংখ্য, ন্যায়, বেদান্ত, মীমাংশা, যোগ এবং বৈশেষিক।

এই দার্শনিক মতবাদের মধ্যে সাংখ্যই ভারতবর্ষের সবচে প্রাচীন দর্শন। এবং সাংখ্যদর্শনের উদ্ভব বাংলায় হওয়ায় সাংখ্য অবৈদিক দর্শন, অর্থাৎ দর্শনটি অনার্য । পরে অবশ্য সাংখ্যদর্শনকে আর্যরা তাদের ধর্মশাস্ত্রে অর্ন্তভূক্ত করে। যে কারণে সাংখ্যদর্শনের উল্লেখ আমরা মহাভারত এবং গীতায় দেখতে পাই। মহাভারতে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন যে: "প্রকৃতি ও পুরুষে সর্বত্র বিরাজমান শিব।

" গীতায় সাংখ্য দর্শনের মূলকথা বলা হয়েছে এভাবে:" যার জন্মও হয় না, মৃত্যুও হয় না, যে অগ্নিতে দ্বগ্ধ হয় না, অস্ত্রেতে আহত হয় না, সেই অবিনাশী আত্মাকে জানলে আর দুঃখ থাকে না। " তো, কপিল বিশ্বজগতের উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে গেলেন কেন? তার কারণ দুঃখ। ব্যাখ্যা করি। কপিল এর জন্ম যিশুখ্রিস্টের জন্মের সাত শ বছর আগে প্রাচীন বাংলায় কোনও এক মাতৃতান্ত্রিক কৌমগ্রামে। কৌম গ্রাম বললাম এই কারণে যে ততদিনে হয়তো বাঙালি সমাজে রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে তোলেনি।

সে যাই হোক। সেই কৌমগ্রামটি কোথায় ছিল? আজ আর তা বলা সম্ভব নয়। তবে যশোরের কপোতাক্ষ নদের পড়ে কপিলমুনি নামে একটি গ্রাম রয়েছে। হয়তো কপিলমুনি গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন কপিল। পরে ... পরিনত বয়েসে উত্তর ভারতের কোনও নগরে তাঁর দর্শন প্রচার করেছিলেন।

তারপর সাংখ্যদর্শন তার তীব্র আকর্ষনের কারণেই ভারতীয় দর্শনের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যায়। তবে কপিলের মতবাদ বেদবিরোধী হওয়ায় উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পরবর্তীকালে সাংখ্যদর্শনকে ঠিক ধ্বংস না-করলেও বিকৃত করে ফেলেছিল। যেমন নিরেশ্বরবাদী সাংখ্যদর্শনকে বিজ্ঞানভিক্ষু নামে এক পন্ডিত বলেছেন: কপিন ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন! এসব সত্ত্বেও আর্যসমাজে কপিলকে অত্যন্ত সম্মান করে বলা হয়েছে ‘আদিবিদ্যান’। সে যাই হোক। কপিল সংসারে মানুষকে দুঃখ ভোগ করতে দেখেছেন।

একই সঙ্গে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় ভেবেছেন। কপিল লক্ষ্য করেছেন যে- মানুষ সংসারে ত্রিবিধ দুঃখ ভোগ করে। (এক) আধ্যাত্মিক (দুই) আধিভৌতিক এবং (তিন) আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ হল: কাম, ক্রোধ , লোভ -এসব রিপুতে তাড়িত হলে যে দুঃখ সেটি। মানব, পশু, পাখি, সরীসৃপ এবং জড়বস্তু থেকে যে দুঃখ পায় কপিল তাকে আধিভৌতিক দুঃখ বলেছেন ।

এবং আধিদৈবিক দুঃখ হল ভূকম্পন, বন্যা বা অপ্রাকৃত শক্তি ইত্যাদি। কপিল চিন্তাশীল বলেই প্রশ্ন করেছেন: কিন্তু, কে দুঃখ ভোগ করে? কেন মানুষ দুঃখ ভোগ করে। কেননা, সুখ কিংবা দুঃখের অনুভূতি হয় মানবদেহে। এই উত্তরের সঙ্গে কপিল একমত নন। কেননা, কপিল মনে করেন যে, ‘যে দুঃখ ভোগ করে, সে স্বতন্ত্র।

সেই তুমি। তোমার দেহ তুমি নহে। যে সুখদুঃখ ভোগ করে সেই আত্মা। সে হল পুরুষ। পুরুষ ছাড়া জগতে আর যা যা আছে সে হল প্রকৃতি।

দেহ প্রকৃতি বলে প্রকৃতি দুঃখভোগ করে না। দুঃখভোগ করে পুরুষ। ’ কেন? কেন পুরুষ দুঃখভোগ করে ? কপিল বলছেন যে, ‘প্রকৃতির সহিত সংযোগই পুরুষের দুঃখের কারণ। ’ এর মানে কী? এর মানে হল প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগ হলে বিশ্বের উদ্ভব হয়- সেই সঙ্গে দুঃখেরও উদ্ভব হয়। এবার আমরা সংক্ষেপে সাংখ্যদর্শনের সৃষ্টিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে পরে আবার কপিলের দুঃখতত্ত্বে ফিরে যাব।

প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগ হলে বিশ্বজগতের উদ্ভবই কেবল না- বিশ্বজগতের বিবর্তনও শুরু হয়। The chain of evolution begins when purusha impinges on prakriti, much as a magnet draws unto itself iron shavings (Encyclopedia Britannica ). এই বির্বতনের কারণ হল প্রকৃতির সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ। কপিল মনে করেন ... এই গুণগুলি প্রকৃতির আত্মস্বরূপ। যে কারণে তিনি বলেছেন: এক ত্রিগুণাত্মিকা নিত্য জড় প্রকৃতিই জগৎকারণ। কাজেই বিশ্বজগতের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই! কেননা, Purusha and prakriti being sufficient to explain the universe, the existence of a god is not hypothesized (Encyclopedia Britannica). সাংখ্যদর্শন এই কারণেই বেদবিরোধী।

কেননা, বেদ এর মুলে রয়েছে পরম ব্রহ্মার ধারণা। বেদান্ত আর্যদর্শন। কপিলের সাংখ্যদর্শন অনার্য। এ কারণেই বেদবিরোধী। তপোব্রত সান্যাল যে জন্য লিখেছেন: ‘সনাতন ধর্মাবলম্বী আর্যশাস্ত্রীরা কপিলের লোকায়ত সাংখ্যশাস্ত্রকে কখনোই মেনে নেন নি, কারণ কপিল বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেননি।

মনে হয় এই কারণেই বৌদ্ধ-অধ্যুষিত বঙ্গ আর্যদের দ্বারা অবহেলিত হয়েছে। ’ নিরেশ্বরবাদী কপিল ছিলেন- ‘সৎকার্যবাদী’। এর মানে কপিল বিশ্বাস করতেন যে ... কোনও কার্য উদ্ভবের আগেই তার কারণে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পরে ব্যক্ত হয় মাত্র, নতুন আরম্ভ হয় না। এই দৃশ্যমান বিশ্বজগৎ স্থূল।

এর কারণ সূক্ষ্ম হতে পারে না। এই যুক্তিতে কপিল কেবল ঈশ্বর নয়- জগতের মূলে পরমাণুর অস্তিত্বও অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে জগতের মূল হল প্রকৃতি। এবং প্রকৃতির মূল হল শূন্য। কপিল এই জন্য প্রকৃতিকে ‘অমূল -মূল’ বলেছেন।

তার মানে প্রকৃতির মূল শূন্য। পরবর্তীকালে গৌতম বুদ্ধ এই শূন্যতাকে আরও গভীর তত্ত্বীয় রূপ দিয়েছেন। যে কারণে তপোব্রত সান্যাল লিখেছেন: ‘বৌদ্ধধর্মের মূলতত্ত্বের উৎসও এই সাংখ্যদর্শন। বস্তুত, বুদ্ধের দু’জন গুরুই ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী। ’ কপিল বলেছেন, অচেতন জড় প্রকৃতির বিকার বা পরিণামের ফলেই সমস্ত বিশ্ব ব্যাপার উৎপন্ন হয়েছে।

সুতরাং বিশ্বভ্রহ্মান্ড হল ত্রিগুণা প্রকৃতির পরিণাম বা অভিব্যক্তি। প্রকৃতির সহিত পুরুষের সংযোগের ফলে প্রথমে উৎপন্ন হয় মহৎ; এর পর অহঙ্কার; এরপর পঞ্চ তন্মাত্র; এরপর একাদশ ইন্দ্রিয় এবং এরপর স্থূল ভূত। মহৎ অর্থ চেতনা। অহঙ্কার হল: ‘আমি জ্ঞান’। পঞ্চ তন্মাত্র হল: শব্দ, র্স্পশ, রূপ, রস ও গন্ধ।

একাদশ ইন্দ্রিয় হল: পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয়; পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং অন্তরিন্দ্রিয়। এবং স্থূল ভূত হল: ক্ষিতি, জল, তেজ, মরুৎ এবং আকাশ। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ - প্রকৃতির তিনটি গুণের কারণেই বিভিন্ন ধরনের পদার্থ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। কপিল মনে করেন: মহা বিশ্ব হল প্রকৃতির তিনটি গুণের পরিণাম বা বিকার। কপিলের মতে বিশ্বজগতে সব মিলিয়ে জাগতিক পদার্থ রয়েছে পঁচিশটি।

১. প্রকৃতি । ২. পুরুষ। ৩. মহৎ ৪. অহঙ্কর ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ পঞ্চ তন্মাত্র ১০ ১১ ১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬ ১৭ ১৮ ১৯ ২০ একাদশ ইন্দ্রিয় ২১ ২২ ২৩ ২৪ ২৫ স্থ’ল ভূত এবার আবার দুঃখের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কপিল বলছেন যে, ‘প্রকৃতির সহিত সংযোগই পুরুষের দুঃখের কারণ। এবং এই সংযোগের উচ্চেদেই দুঃখ নিবারণের উপায়।

সুতরাং তাহাই পুরুষার্থ। প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগের উচ্ছেদই দুঃখ মুক্তি। ’ কিন্তু, কী ভাবে? কপিল বলছেন যে বিবেকজ্ঞান- এর মাধ্যমে। বিবেকজ্ঞানই দুঃখ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু, বিবেকজ্ঞান কি? আমি অচেতন প্রকৃতি নই, আমি হলাম চৈতন্যময় পুরুষ।

এ উপলব্দিই হচ্ছে বিবেকজ্ঞান। এই বিবেকজ্ঞান হলেই দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব। তার মানে আমরা যদি অচেতন জড় প্রকৃতিকে ‘আমি’ বলে ভুল না করে নির্লিপ্ত সাক্ষীমাত্র চৈতন্যস্বরূপ পুরুষকে ‘আমি’ বলে বুঝি তবে পরিনামী প্রকৃতিতে জন্ম মৃত্যু আঘাত ব্যাধি জরা যাই হোক না কেন সে দুঃখ আমাতে আরোপিত হয়ে আমাকে কষ্ট দেবে না। গীতায় সাংখ্যের মূলতত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে: যার জন্মও হয় না, মৃত্যুও হয় না, যে অগ্নিতে দ্বগ্ধ হয় না, অস্ত্রেতে আহত হয় না, সেই অবিনাশী আত্মাকে জানলে আর দুঃখ থাকে না। আজ থেকে ২৭০০ বছর আগে কপিল যেন আমাদের নির্দেশ করেই বলছেন: ত্রিগুণা প্রকৃতিতে পরিণাম হচ্ছে।

আমাতে নয়। এই বিবেকজ্ঞানের ফলেই দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। এই নিগূঢ় তত্ত্বটি আজও বাংলার মরমি লোকগান ধারণ করে আছে। তবে এত দীর্ঘকাল পরে দর্শনটি আর বাংলার মানসজগতে অবিকৃত নেই। বাংলার দার্শনিক জগতে আদি সাংখ্যদর্শন অনেকটাই ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

যেমন আমরা দেখেছি সাংখ্যদর্শনের একটি প্রধান কনসেপ্ট হল ‘প্রকৃতি ও পুরুষ’। কপিল ‘প্রকৃতি ও পুরুষ’ কে জগতের দুটি নিত্য পদার্থ বলেছেন। অথচ পরবর্তী সময়ে বাংলার ভাবজগতে প্রকৃতি নারী হিসেবে এবং পুরুষ পুরুষ হিসেবে উপস্থিত। কপিল প্রকৃতিকে অচেতন জড় বললেও বাংলায় প্রকৃতি কেবল সচেতনই নয়- প্রকৃতি (বা নারী) আদ্যশক্তি। আসলে বাংলার ভাবজগৎ সাংখ্যদর্শনের পরিভাষা গ্রহন করেছে এবং সেই পরিভাষা নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেছে।

যেমন: কপিল- এর মতে সচেতন পুরুষ যখন অচেতন প্রকৃতির সংর্স্পশে আসে তখন বিশ্বজগতের উদ্ভব হয়; একই সঙ্গে বস্তুর উৎপত্তি এবং বিবর্তন আরম্ভ হয়। সেই সঙ্গে দুঃখেরও সৃষ্টি হয়। অথচ, মধ্যযুগের বজ্রযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধরা মনে করতেন যে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনে মহাসুখ উৎপন্ন হয়। এই মহাসুখই শূন্য নিরঞ্জন। এবং এই শূন্য নিরঞ্জনই বজ্রযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধকের পরমার্থ বা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

তথ্যসূত্র: বঙ্কিম রচনাবলী; সাহিত্য সমগ্র (সাংখ্যদর্শন; পৃষ্ঠা; ২২১) কনকপ্রভা বন্দ্যোপাধ্যায়; সাংখ্য-পতঞ্জল দর্শন। http://www.sacred-texts.com/hin/sak/ Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।