আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্লেটোর ইউটোপিয়া ও বাস্তবতা

আগের প্লেটোর ইউটোপিয়া নামক লেখায় প্লেটোর ইউটোপিয়ান সমাজ কিরকম সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া হয়েছে। প্লেটোর সমসাময়িক সমাজ ছিল গণতান্ত্রিক। প্লেটোর কল্পিত সমাজকে দেখে মনে হতে পারে তিনি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন! কারণ ইউটোপিয়ান সমাজ গণতন্ত্র থেকে দূরে স্বেচ্ছাচারী একটি সমাজ। ধনী এথেনিয়ান পরিবারের সদস্য হয়ে প্লেটো গণতন্ত্রকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। এই গণতন্ত্রের বলি হয়েছিল তার চাচা ক্রিটিয়াস ও গুরু সক্রেটিস।

ফলে গণতন্ত্র তার কল্পিত সমাজে অনুপস্থিত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেসময়ের গ্রীক সমাজের তুলনায় ইউটোপিয়ান সমাজ কতটুকু বাস্তব ছিল- এ পর্বে সেটার উপর কিছুটা আলোকপাত করা হবে কয়েক হাজার বছর আগের প্রাচীন সভ্যতা গ্রীসে গণতন্ত্র ছিল! কিন্তু সে গণতন্ত্র নিয়ে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাসের কিছু ছিল না। প্রাচীন গ্রীস ছিল অনেকগুলো নগর রাজ্যের (Polis)সমষ্টি। যেমনঃ স্পার্টা, এথেন্স, থেবেস এবং করিন্থ। ঐ নগররাজ্যে কোন রাজা ছিল না।

এগুলো শাসিত হতো ধনী সিনেট সদস্যদের দ্বারা। এটাকে ধনীদের গণতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্র (Oligarchy) বলা যায়। শাসন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভুমিকা ছিল নগণ্য। অল্প কিছু লোকেরই ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার ছিল। আর রাষ্ট্রে অনেক দাস ছিল যারা ঠিক মানুষ বলে গণ্য হতো না।

কোন কোন রাজ্যে এই দাসদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ। প্লেটোর কল্পিত সমাজে এই দাসরা আলাদা কোন মর্যাদা পায়নি। তিনি দাসপ্রথাকেই সমর্থন করেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন দাসব্যবস্থায় মনিবের সাথে সাথে দাসরাও উপকৃত হয়। গ্রীক সমাজে সামাজিক মর্যাদায় নারীরা ছিল দাসদের খুব কাছাকাছি।

একটু ধারণা দিলে হয়তো পরিষ্কার হবে। একসময় গ্রীসে যে অলিম্পিক খেলার আয়োজন হতো তা ছিল শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য, কোন নারীর সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না, যদি ধরা পড়ত তাহলে কপালে জুটত নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড। প্লেটো নারী স্বাধীনতার কথা বললেও তার ইউটোপিয়াতে নারীরা ‘যোগ্য’ সন্তান উৎপাদনের জন্য যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। পরিবারকে তিনি দেখেছেন স্বার্থপর বানানোর প্রতিষ্ঠান হিসেবে, কারণ তা বাইরের পরিবেশের সাথে শত্রুতা তৈরী করে। পরিবার ব্যক্তিকে বৃহৎ সমাজের সাথে মিশতে বাধার সৃষ্টি করে।

তাই নারীদের ‘যোগ্য’ সন্তান উৎপাদনে পরিবারের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেছেন। নারী ও পুরুষের মধ্যে ভালবাসার মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনের চেয়ে যোগ্য লোকদের দ্বারা ‘যোগ্য’ সন্তান উৎপাদন সমাজের জন্য কল্যাণকর। তবে তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে ভালবাসাকে নিরুৎসাহিত করেননি, কিন্তু সে ভালবাসায় শারীরিক সম্পর্কের চেয়ে আত্নার সম্পর্কই প্রধান যাকে প্লেটোনিক লাভ বলা হয়। তৎকালীন গ্রীক সমাজের নারীদের প্রতি যে দাসসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার থেকে প্লেটোর সমাজে নারীদের অবস্থান খুব একটা উন্নত হয়নি। প্রাচীন গ্রীক ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল দেবতা নির্ভর।

তাদের মধ্যে অনেক খারাপ বৈশিষ্ঠ্যের দেবতাও ছিল। কোন কোন দেবতা মানুষের প্রতি ভয়ানক হিংসা পোষণ করত। গ্রীক সমাজের এই দেবতা নির্ভরতার মধ্যেও সেখানে একেশ্বরবাদীতার একটা জায়গা ছিল। অনেক দেবতা থাকা সত্ত্বেও দেবতা জিউস ছিলেন দেবতাদের দেবতা যার কাছে অন্য দেবতারা নগণ্য। দেবতাদের সন্মানে তারা নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যে খেলাধুলার আয়োজন করত, এর মধ্যে দেবতা জিউস এর সন্মানে আয়োজিত প্রধান ক্রীড়া উৎসবটি ছিল অলিম্পিক।

খ্রিষ্টিয়ান সেইন্ট অগাস্টিন প্লেটোকে প্যাগান দার্শনিক হিসেবে আখ্যায়িত করলেও চিন্তা চেতনায় তাকে ক্রিষ্টিয়ানিটির খুব নিকটবর্তী হিসেবে দেখেছেন। ফিলো (খৃষ্টপূর্ব ৫০ -২০) ইহুদী ধর্মকে প্লেটোনিস্ট ফর্মে ব্যাখ্যা করেছিলেন। টারটুল্লিয়ান প্লেটোনিক ক্রিস্টিয়ানিটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। প্লেটোর সর্বশক্তিমান স্রষ্টা শুধু ভালোর জন্যই দায়ী। আর তার প্রাকৃতিক বিশ্ব অনেক বেশী নিয়মতান্ত্রিক ও গোছালো।

প্লেটোর কল্পিত ইউটোপিয়ান সমাজ ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে একেবারে অপরিচিত কোন ধারণা ছিল না। প্লেটোর জন্মস্থান এথেন্স সাহিত্য, শিল্প-কলা ও ধর্মীয় আচার আচরণের ছিল এক অভূতপূর্ব মিলনকেন্দ্র। তাছাড়া ছিল তুলনামূলকভাবে অধিকতর গণতান্ত্রিক। সেখানে প্লেটোর কল্পিত আদর্শ সমাজ এর স্থান করে নেয়ার সম্ভবনা ছিল খুবই কম। তবে গ্রীসের নগররাজ্যগুলো একে অপরের সাথে সাংস্কৃতিক লেনদেন করত, তাদের চিন্তাধারা একে অপরকে প্রভাবিত করত।

ফলে এথেন্সে না হলেও গ্রীসের অন্য কোথায় ইউটোপিয়ার জন্য ক্ষেত্র বিদ্যমান ছিল। এথেন্সের দীর্ঘদিনের শত্রু স্পার্টার সমাজ প্লেটোর কল্পিত সমাজ থেকে একেবারে দূরে ছিল না। স্পারটানরা ছিল নামকরা যোদ্ধা। স্পারটায় নাগরিকদের রাষ্ট্রের কাছে পুরোপুরি দায়বদ্ধ থাকতে হতো, আর এর জন্য রাষ্ট্রের কঠোর আইন কানুনের বাধ্যবাধকতা ছিল। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা ও গজিয়ে উঠা দাসবিদ্রোহকে নির্মূলের জন্য নাগরিকদের প্রচন্ড অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে লড়াকু সৈনিক হতে হতো।

সেজন্য বাল্যকাল থেকেই তাদের সেভাবে গড়ে তোলা হতো। জন্মের পরপর তাদের বাবা-মা তাদেরকে সারারাত পাহাড়ে ফেলে রাখতো বাচ্চার শক্তিমত্তা বুঝার জন্য, দেখতো তারা বাচতে সক্ষম কিনা। সাত বছর বয়সেই তাদের পরিবার আলাদা করে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তাছাড়া সবসময় ইউনিফর্ম পড়ে থাকতে হতো, আর নিয়মের বিচ্যুতি ঘটলে কঠোর শাস্তির মধ্য দিয়ে যেতে হতো। ৩০ বছর বয়সের আগে তাদের পরিবারে ফিরে আসার উপায় ছিল না।

আর ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকতে হতো। প্লেটো তার রিপাবলিকে তিনি গ্রীক সমাজের বিরাজমান মুষ্ঠিমেয় ধনীদের গণতন্ত্রকে সঙ্কুচিত করেছেন। গণতন্ত্র ব্যাক্তির সুপ্ত বিকাশ ঘটায়, কিন্তু এটি মানুষকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলে। তাই প্লেটো এর বিরোধীতা করেছেন। তার ইউটোপিয়া ছিল নিখুত লোকদের দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্র যেখানে শাসকরা দার্শনিক (Philisopher King)।

এটা প্লেটোর উপর প্রভাববিস্তারকারী পীথাগোরাসের দার্শনিক সমাজের মতই। প্লেটোর নিজের যুগে সিসিলি ও দক্ষিণ ইটালীর তারেস (আধুনিক তারান্তো) পীথাগোরাসপন্থী আরকাইটাসরা (Archytus) রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন। সাধারণ আইন প্রনয়ণের জন্য দার্শনিক নিয়োগ করা হয়েছিল। ছিল স্পার্টার মতো কঠোর নিয়মতান্ত্রিক সমাজের উদাহরণ। সে সময়ে গ্রীসের কলোনীগুলো যেহেতু মূল নগরীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ছিল সেখানে প্লেটোর অন্যসারীদের পক্ষে যেকোন একটিতে তার কল্পিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কিছু ছিল না।

কিন্তু প্লেটোকে বাণিজ্যনগরী সিরাকুজে স্থায়ীভাবে চলে যেতে হয়েছিল যেখান থেকে ইউটোপিয়াকে প্রতিষ্ঠা করা তার ও তার অনুসারীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সূত্রঃ ১. PLATO A very short Introduction, Julia Annas ২. সমাজ ও সভ্যতার ইতিকথা, ডঃ মোহম্মদ গোলাম রসুল, আলীগড় লাইব্রেরী, ১৫, বাংলাবাজার, ঢাকা। ৩. প্লেটোর ইউটোপিয়া ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, বারট্রান্ড রাসেল, অনুবাদঃ মশিউল আলম, অবসর প্রকাশণী ৪. Glimpses of World History, Jawaharlal Nehru, Oxford University Press ৫. Rise of City States, http://www.ushistory.org/civ/5a.asp ৬. Click This Link ৭. http://www.enotes.com/plato-reference/plato/ নোট: সদালাপে আমি শামস নামে লিখে থাকি। লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে প্রকাশিত হয়েছিল।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।