আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাদা,সাদা আরও সাদা !!

জেগে, ঘুমিয়ে, আড্ডায়, গল্পে, প্রার্থনায়, কবিতায়, সিনেমায়- সবখানে শুধু স্বপ্ন দেখি। : আল্লাহ, তোকে যা সুইট লাগছে না!! তোর চামড়ায় এত ফেয়ারনেস এল কিভাবে রে? কি ইউজ করিস তুই? : (লাজুক হাসি হেসে) এইতো তেমন কিছু না। লাক্স ইউজ করি আর ফেয়ার এন্ড লাভলী ইউজ করি মাঝে মাঝে। একটা বিউটি পার্লারের মেম্বার……….এই আর কি!! আজকালকার যুগের এক জোড়া তরুণী যখন একসাথে হয় তখন এমন আলাপ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। শুধু মেয়েরাই বা কেন, তরুণেরাও কম যায় না।

এখনকার সময়ের তরুণদের ড্রেসিং কেবিনেটও ফেয়ারনেস ক্রিম দিয়ে ভরা থাকে !! সাদা হতে ব্যস্ত সবাই। সাদা হওয়ার ধুম পড়ে গেছে চারিদিকে। আমাদের আরও সাদা হতে হবে। সাদা না হলে স্মার্ট লাগে না, সাদা না হলে প্রেম করা যায় না, মেয়েদের ক্ষেত্রেতো সাদা না হলে বিয়ে দেওয়া নিয়েই সমস্যা হয়ে যায়! কেন এই সাদা হওয়ার প্রতিযোগিতা? ফেয়ারনেস ক্রিমের কেন এত রমরমা ব্যবসা। কেন সৌন্দর্য মানেই শুধু সাদা চামড়া ? উত্তর দেয়া একটু মুশকিল।

কারণ যে জেনারেশনের কথা বলে লেখা শুরু করেছি সে জেনারেশনের সুন্দরী নারী কিংবা সুন্দর ছেলে মানেই ফর্সা মেয়ে/ ছেলে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখে আসছি সুন্দরী আপুদের জয়জয়কার। সিনেমার নায়ক-নায়িকা তো ফর্সাই সাথে সাথে তাদের চেলাচামুন্ডাদেরকেও দেখা যায় এক স্তর মেকআপ মেখে ফর্সা হওয়ার চেস্টা করতে। একমাত্র ভিলেনগুলোকেই দেখতাম একটু কালো রংয়ের।

এমন না যে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতার গায়ের রং কালো হতেই হবে, কিন্তু আশ্চর্য হলেও জাম্বুর মত অভিনেতাদের সিনেমাতে ব্যবহার করাই হত যেন তার কালো চেহারা আর ভিম সদৃশ শরীর দেখে দর্শকদের মনে ভিলেনের প্রতি ঘৃণা জন্মে! জন্ম থেকেই একটা জেনারেশন যদি এসব দেখে বড় হয় তাদের চোখে সাদাই তো সুন্দর হবে। কেউ যদি শুধু সাদা নিয়ে মেতে থাকে তাহলে আমার কি সমস্যা? আসলে কোন সমস্যা নেই। কারণ আমি নিজেও জন্ম থেকে উজ্জ্বল শ্যামলা চামড়ার অধিকারী। সাদা হওয়া নিয়ে আমার কোন টেনশন নাই। আবার এটা নিয়ে আমার কোন গর্বও নাই।

তাই প্রশ্ন থেকেই যায়। সমাজের মাঝে চলা এই সাদা হওয়ার প্রতিযোগিতা কতটুকু সুস্থ ? এর ভিত্তি কি? এ ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কোন চিন্তা আছে কি নাকি আমরা সবাই কারও খেলার পুতুল? যে ব্যাপারটা বেশি ভাবায় সেটা হচ্ছে জন্মগতভাবে আমরা সাদা নই। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষেরই জাতিগতভাবে গায়ের রং শ্যামলা কিংবা কালো। জন্মগতভাবে ফর্সা গায়ের রং এখানে একটু দুষ্প্রাপ্য। এবং একটা সময় ছিলো মানুষের মনে সাদা/কালো গায়ের রং নিয়ে হয়তো কোন টেনশনও ছিলো না।

সৌন্দর্যের সংজ্ঞা তখন হয়তো অনেক বড় ছিলো, গায়ের রংয়ের সীমানায় তাকে হয়তো বাধা যেত না। সমস্যা শুরু হয় সম্ভবত এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ দখলদারিত্বের পর থেকে। যখন মানুষ দেখা শুরু করল তাদের প্রভুরা সব সাদা আর তাদের চালচলনে রাজকীয় ভাব, তখনই হয়তো তাদের মনে সাদা মানেই অভিজাত শ্রেণী বলে মাথায় গেথে গেছে। ব্রিটিশদের ২০০ বছরের শাসনামলে মানুষের মনের এই ধারণা দুরতো হয়ই নি, বরং আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। যতই কবি লিখে যাক কালো মেয়ের হরিণী চোখের কথা বাঙ্গালীর মনে সাদা চামড়াই অনুকরণীয় হিসেবে গেথে গেছে।

আর বিশ্বায়নের এই যুগে সেই ধারণার উন্নততর সংস্করণ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের চারপাশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাদা চামড়ার মনিষীদের মতবাদ নিয়ে উল্লাস করতে দেখা যায়, কিন্তু সেই একই কথা এই দেশেরই কোন লেখক হয়তো অনেক আগেই লিখে রেখে গেছেন সে ব্যাপারে তারা উদাস। সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলোতে মেয়েরা নিজেদের ফর্সা আর সুন্দরী প্রমাণে ব্যস্ত কারণ তাদের কাছে সাদা গায়ের রং মানেই সৌন্দর্য। সুন্দরী মডেলরা বিলবোর্ডে উপস্থিত হয় এক/ দুই স্তর মেকআপ মেখে। বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদ নিয়ে ব্যস্ত এই আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের কোন ফুটবলারের নাম বলতে আমি হয়তো একজনের নামও বলতে পারব না !! (আসলেই একজনের নামও মনে করতে পারলাম না) বিজ্ঞান বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে এখন চালু হয়েছে GRE ট্রেন্ডস।

সবাই অনার্স শেষে GRE দিয়ে বাইরে যাওয়ার ধান্দায় আছে। এমন না যে, বাইরে যাওয়া মানেই খারাপ কিংবা বাইরে গেলেই সে দেশের জন্য কিছু করতে পারবে না। বরং বাইরে থেকে কিছু শিখে এসে দেশে সেই জ্ঞানটা কাজে লাগালেই কিন্তু দেশ অনেকটা এগিয়ে যায়। কিন্তু কয়জনই বা আর দেশে ফিরে আসে!! (কিংবা বলা ভালো- ফিরতে পারে !!) তার ভিতর আবার আস্তে তরুণ সমাজের মাঝে ছড়াচ্ছে নিজ দেশের প্রতি উষ্মা। সব ভালো সাদা চামড়ার দেশেই, এই গেঁয়ো দেশে কিছু নেই।

পেশাদারিত্বের দিক দিয়ে পশ্চিমারা নিজেদেরকে অনেক আগেই ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আমরা তাদের কাছ থেকে এই পেশাদারিত্বের দীক্ষা নিতে পারি কিন্তু তারা মানেই ভালো, তাদের সব কথাই ঠিক এমনটা ভাবাতো তাদেরকে গডের আসনে বসানোরই সামিল! একটা সময় ছিলো কিংবা বলা যায় এখনও সেই ট্রেডিশনটা রয়ে গেছে, বাইরে যাওয়া মানেই ভালো বিয়ে হওয়ার নিশ্চয়তা! : আপনার ছেলে কি করে? : ওতো এখন আমেরিকায় আছে। আপনার ছেলে? : ও আগামীকাল অষ্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিচ্ছে! এটা হচ্ছে দুইজন সুখী এবং সন্তান গর্বে গর্বিত বাবার কথোপকথন। একটা ছেলে অনেক কষ্টে দেশে নিজের কোন প্রতিষ্ঠান হয়তো দাড় করাচ্ছে তার চাইতে দেখা যায় বিয়ের বাজারে ঐ বিদেশ ফেরত পাত্রের মুল্য বেশি। সাদা চামড়াদের দ্বারা সার্টিফায়েড বলে কথা।

গতকয়েকদিন ধরে ব্রিটেনের রাজপুত্র প্রিন্স উইলিয়ামসের দেহে ভারতীয় জীন থাকা নিয়ে উল্লসিত এই উপমহাদেশের মিডিয়া। যেন রাজপরিবারের কারও দেহে এই অঞ্চলের বীজ খুঁজে পাওয়া গেলে আমরা সবাই জাতে উঠে যাবো! আসলে এইসবই আমাদের সেই ব্রিটিশদের চাকর থাকার সময় গড়ে ওঠা মানসিকতার ফল। যতই বলি আমরা স্বাধীন, আসলে আমরা স্বাধীন না। আমরা চরমভাবে শীকলে আবদ্ধ, আমাদের চিন্তায় শিকল পড়ে গেছে। আমাদেরকে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো পুতুলের মত নাচিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

বিনিময়ে হয়তো তারা আমাদের যুবসমাজের এক অংশকে চাকরি দিচ্ছে। সেই অংশকে ৭০,০০০- ১,০০,০০০ বেতনে নিয়োগ দিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছে ৫,০০,০০০ টাকার কাজ। আমাদের অসৎ রাজনীতির ধারা তাদের এই অবাধ লুটপাটকে আরও সহজ করে দিচ্ছে। কয়েক কোটি টাকা উপঢৌকন দিয়ে তারা কয়েকশ কোটি টাকার কর মওকুফ করে এই দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। যে শেভরনের বিরুদ্ধে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সেই শেভরনের বাংলাদেশ শাখার অধিকাংশ কর্মচারী কিন্তু বাংলাদেশীই।

এমনকি দুই রাজনৈতিক দলের মাঝে ঝামেলা হলে সেটার মিমাংসা করার জন্য তারা ছুটে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমলাদের কাছে !! এই সাদা হওয়ার, সাদাকে অনুসরণ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের নিজস্বতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। সমাজে এখন ওপেন সিক্রেটলি বর্ণবাদের চর্চা চলছে। কালো মেয়ে, সে যতই গুণের অধিকারী হোক না কেন, সে তার উপযুক্ত জীবনসঙ্গী খুঁজে পাচ্ছে না। কর্পোরেট অফিসের চাকরিগুলোতে ফেয়ার কমপ্লেকশনের অধিকারীরা অঘোষিতভাবে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। অথচ যে সাদা চামড়াদের আমরা অনুসরণ করি সে সাদা চামড়ারা কিন্তু অনেক আগেই বর্ণবাদের শেকল থেকে অনেকাংশেই বের হয়ে এসেছে।

মর্গান ফ্রীম্যান কিংবা উইল স্মিথের মত শক্তিমান অভিনেতারা হলিউড কাপাচ্ছে। আর আমাদের নায়কেরা কড়া মেকআপ আর লিপস্টিক মেখে নিজেদেরকে নিজেরাই উপহাস করছেন। আর সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে আমি এই কথাগুলোই যদি আজ প্রচার করতে যাই তবে অনেকেই এটাকে “সুশীল” কথাবার্তা বলে উপহাস করবে, পাত্তাই দিতে চাইবে না কেউ। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি কোনদিন সাদা চামড়াদের দ্বারা সার্টিফায়েড হয়ে আসি তখন আবার আমি যা বলি তাই ঠিক হয়ে দাঁড়াবে। তারপরও আশায় থাকি সামনে কোন একদিন নিশ্চয়ই আসবে যেদিন আমরা নই, আমাদেরকেই অনুকরণ করবে সাদা চামড়ারা।

এই দেশেই আবার জগদীশচন্দ্র, কুদরত-ই-খুদার মত উদ্ভাবকেরা জন্মাবে। আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেই জীবন পাল্টে দেওয়ার মত সিনেমায় অভিনয় করবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের হিরো হবে এই দেশেরই কোন তুখোড় লেখক কিংবা উদ্যোক্তা। আমাদের পত্রিকাগুলো নেইমারের ট্রান্সফারের খবরকে পাশ কাটিয়ে এমিলিদের বিশাল বিশাল অর্জনে ভরে থাকবে। শুধুমাত্র কালো হওয়ার জন্য আর কোন মেয়েকে সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে না।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।