আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খেলার মাঠ

আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না! সফিক এহসান (২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩ইং) কাইস্যাখালিতে রিক্সা থেকে নেমে পঞ্চাশ পয়সা নৌকা ভাড়া দিয়ে নদীটা পার হলেই বোয়ালি গ্রাম। ইছামতি নদীর তীরে ছোট সুন্দর একটা গ্রাম বোয়ালি। সাজানো গোছানো সবুজে ঘেরা এই গ্রামটি দেখতে সত্যি খুব সুন্দর। আঁকাবাঁকা মেঠো পথের দু’পাশে খেজুর, সুপারি আর বাঁশঝাড়ের কোন কমতি নেই। নির্দিষ্ট করে কোন ঘাটের নাম না বললে মাঝি নৌকা ভিড়াবে বোয়ালি বাজারের ঘাটে।

বাজারের ঠিক মধ্যেখানে একটা বিশাল বটগাছ। গাছটির গোড়া ইটের নিচু দেয়াল দ্বারা গোল করে বাঁধানো। বিভিন্নরকম মাছ-তরকারি, লুঙ্গি-গামছা ও চর্মরোগের ঔষধ বিক্রেতারা এই বট গাছের নিচেই তাদের অস্থায়ী দোকান দিয়ে বসে। এই বাজারে অধিকাংশই অস্থায়ী দোকান। পাকা দোকান বলতে গেলে হাতে গোনা দশ-বারোটা।

তারমধ্যে চার-পাঁচটা মুদির দোকান, একটা জয়নাল বেপারীর চাল-ডালের আড়ৎ, ছিদেন ঘোষের মিষ্টির দোকান, হারু নাপিতের সেলুন। উত্তর দিকের সারিতে রয়েছে একটা ডাক্তারখানা। এটাই গ্রামের একমাত্র বিজ্ঞ ডাক্তার বিধান বাবুর চেম্বার। একটা স্বর্ণকারের দোকান দিয়ে বসেছে মালেক কর্মকার। আর একটা দর্জির দোকান।

বাজারের সবচেয়ে দক্ষিণ পূর্ব কোণে যে মুদির দোকানটি আছে, সেটা হলো অমলদের দোকান। অমলের বাবা মহিন্দ্র রায় বসেন ঐ দোকানে। অমলদের বাড়িটা বাজার থেকে পূর্বে প্রায় আধ মাইল দূরে। অমলদের বাড়িতে অমলের মা, বাবা, বড় ভাই আর ছোট বোন থাকে। অমল আর তার ছোট বোন চুমকি গ্রামের সরকারী স্কুলে পড়ে।

অমল পড়ে হাই স্কুলে, ক্লাস নাইনে। আর চুমকি পড়ে পাশেই প্রাইমারী স্কুলের ক্লাস ফোর-এ। সেদিন বিকেলে পটলা এসে ডেকে নিয়ে গেল অমলকে। স্কুলের পেছনে আম বাগানের পরের খালি মাঠটাতে প্রতিদিন ফুটবল খেলে ওরা। এটা সরকারী খাস জায়গা।

বহুদিন ধরে এভাবেই পড়ে আছে। মাঠের এক কোণায় একটা বেড়ার তৈরী ছোট ঘর। এটা তাদের ক্লাব ঘর। ঘরের দরজার উপর বেশ বড় একটা সাইনবোর্ড; তাতে লেখা- বোয়ালী উদয় সূর্য ক্লাব। অমল আর পটলা ঘরে ঢুকে দেখলো- সুনীল, আশিক, গোবিন্দ, বাপ্পা, বরেণ সবাই এসে পরেছে।

বড় একটা টেবিলকে ঘিরে বসলো তারা বার-তের জন। পটলা বলল: তারপর, কী কওয়ার জন্য ডাকছিলি সুনীল? কইয়া ফ্যালা। সুনীল একটু নড়েচড়ে বসে শুরু করলো: যার জন্য সবাইকে ডাকা, চরবঙ্খুরীর দলেরা একটা লীগ খেলা ছাড়ছে। শুনছো নাকি তোমরা? অনেকেই মাথা নেড়ে সায় দিলো। সুনীল আবার শুরু করলো: তা তোমরা কী ঠিক করছো, লীগ ধরুম নাকি? গবিন্দ বলল: তুমি দলের ক্যাপ্টিন; তুমিই বুঝ, যেহেতু আমরা গতবার উত্তর পাড়ার সাথে খেইল্যা ফাইনালে জিতছি সুতরাং এইবারও খেলমু।

এইটা আবার জিগানের কী অইল? সুনীল বলল: আরে বাবারে, খেলমু কইলেই তো খেলা যায় না। চান্দার ব্যাপার আছে না! আগামী সাত তারিখের মধ্যে সবাইরে দশ ট্যাকা কইর‌্যা দেওয়া লাগবো। কি পারবা না সবাই? সবাই প্রায় সমস্বরে বলে উঠল- পারুম! দু’ একজন বলল: না পারার কী আছে? হাতে তো এখনও পাঁচদিন সময় আছে। সতের তারিখে ফাইনাল খেলা। এবার ফাইনাল খেলবে বোয়ালি আর আইলকুন্ডির দুই দল।

উত্তর পাড়ার দল এবার সেমি ফাইনালে এসে বাদ পড়ে গেছে। আজ সারা সকাল দুই দলই খুব ভাল করে প্র্যাকটিস্ করেছে। আইলকুন্ডির দলে এবার হায়ারে খেলছে কালা মনাই। আইলকুন্ডিতে মনাই দুই জন। এক জন খুব শুকনো বলে তার নাম চিকনা মনাই।

আর গায়ের রং কালো হওয়ায় এর নাম কালা মনাই। দুইটা কারণে কালা মনাই কুখ্যাত। একটি হচ্ছে- সে মাঠের যে কোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে গোল পোস্টে বল ঢুকাতে পারে। আজ পর্যন্ত এমন ঘটনা ঘটেনি যে কালা মনাই ফ্রি-কিক পেয়েছে অথচ গোল হয়নি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- খেলার মাঝখানে সে কারও ওপড় রেগে গেলে এমন ভাবে রেফারীর চোখ এড়িয়ে ফাউল করে যে ঐ ব্যাচারা তিন দিন ঠিক মত হাঁটতেই পারে না।

কাজেই বোয়ালির দলের জন্য আজ একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রচন্ড উত্তেজনার মধ্যে আছে ওরা। বিকাল সাড়ে তিনটায় খেলা আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল। আরম্ভ হল সোয়া চারটায়। খেলার প্রধান অতিথি চান্দু কমান্ডারের আসতে দেরী হয়ে গেছে।

অবশেষে খেলা আরম্ভ হল। টান টান উত্তেজনা সত্ত্বেও খেলার প্রথম অর্ধেকে কোন গোলই হলো না। তবে বোয়ালিকে কোনঠাসা করে রাখলো আইলকুন্ডির দল। দুইটা গোল হতে হতে রক্ষা পেল। রিতিমত কাল ঘাম ছুটে গেছে গোবিন্দের সেগুলো ফেরাতে।

কালা মনাই এর শেষ বলটা যে গোবিন্দ ফেরাতে পারবে তা কেউই ভাবে নি। অনেক বাধা বিপর্যয় কাটিয়ে প্রথম অর্ধেক মানে মানে শেষ করলো বোয়ালি। দ্বিতীয় অর্ধেকের একদম শুরুতেই বরেণের ভুলের জন্য একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরই বল নিয়ে মারমুখি ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো মনাই। একদম গোল পোস্টের কাছাকাছি চলে এলো সে।

গোবিন্দ বলটা লুফে নেয়ার জন্য লাফিয়ে পড়তেই মনাই কষে লাফি মারলো গোবিন্দের পেটে। পুরো মাঠে হইচই পড়ে গেল। রেফারি লাল কার্ড দিয়ে মনাইকে বের করে দিলেন। গোবিন্দর বেশ লেগেছে। তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই আবার মাঠে নেমে পড়ল সে।

আবার খেলা চলল তুমুল গতিতে। দশজন নিয়েই বেশ ভাল খেলছিল আইলকুন্ডি। তবে এবার আক্রমনে আছে বোয়ালি। ঠিক একচল্লিশ মিনিটের মাথায় ‘বেগি’ আশিক, কাটাতে কাটাতে বল নিয়ে চলে গেল বিপক্ষের প্রায় গোল পোস্টের কাছে। সেখানে গিয়ে সে হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

কারণ, জীবনে সে কখনও স্ট্রাইকে খেলেনি। গোল করবে নাকি কাউকে পাস দিবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলো না। কোন কিছু না বুঝেই সে বিপক্ষ দলের একজনকে সজোরে পাস দিয়ে বসল। বিপক্ষ দলের ছেলেটা এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। বল তার পায়ে লেগে সোজা চলে গেল গোল পোস্টের দিকে।

কিন্তু গোল কিপারও এটা আশা করেনি, সে দাঁড়িয়ে ছিল পোস্টে এক সাইডে। ফলে বলতে গেলে তার চোখের সামনে দিয়েই পোস্টের অপর প্রান্ত দিয়ে বল চলে গেল জালের ভেতর। চারদিক থেকে দর্শকদের উল্লাসী চিৎকার শোনা গেল। আরও কিছুক্ষণ পর খেলা শেষ হয়ে গেল। বোয়ালির দল খুশিতে মাঠ জুড়ে কানফাটা চিৎকার শুরু করে দিল।

চান্দু কমান্ডার অধিনায়ক সুনীলের হাতে চ্যাম্পিয়ন কাপ তুলে দিল। আর চমৎকার কয়েকটি গোল প্রতিহত করার জন্য ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হলো গোবিন্দ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আশিককে সুনীল বলল: তুই যে এতো সুন্দর গোল দিতে পারস আগে জানতাম নাতো। এর পর থিক্যা তোরে স্ট্রাইকেই রাখুম। বাপ্পা বলল: আমি তো ভাবছিলাম তুই এমন কিক করবি যে গোলকি সুদ্ধা উইরা গিয়া গোলপোস্টে ঢুকবো।

তা দেখি তুই ওগো দলের লোক দিয়া গোল দেস। তুই যে ওগো দলের পিলিয়ার হায়ার করছোস তা আমাগো আগে কবি না! আশিক হাসতে হাসতেই জবাব দেয়: বল যখন পোস্টের ভিতরে ঢুইক্যা গেছে তখনও আমি বুঝি নাই যে গোল হইছে। বাপরে, হঠাৎ চাইয়্যা দেখি তোরা কেউ নাই, আমি একলা গোলপোস্টের সামনে খাড়াইয়া রইছি। কাটাইতে কাটাইতে কখন যে মাঠ পার হইয়্যা আইছি টেরও পাই নাই। আমার কি দোষ, আমার কামই তো খালি পাস দেওয়া, দিছি! অমল বলল: যাই কস দোস্ত, গোলডা যদি তুই নিজের পায়ে দিতি তাইলে কিন্তু আজকে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ গোবিন্দ হয় না।

ঐ ব্যাটা কিন্তু আসলে কালা মনাইর এক লাত্থি খাইয়্যা হিরো হইয়্যা গেছে। নাইলে গোল কি ও একলা ফিরাইছে? পটলা আর তুই বেগি না থাকলে ও গোল খাইতো এক হালি! ওর কথায় সবাই আরেক দফা হাসলো। গোবিন্দ হাসলো সবচেয়ে বেশি। হাসতে হাসতে ওর পেটের ব্যাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। লাথিটা খুব জোরেই মেরেছিল মনাই।

ভাগ্য ভাল, পুরোপুরি লাগেনি। কাপ নিয়ে উল্লাস করতে করতে বাড়ি ফিরলো ওরা। এমনি করেই যখন সুখে-আনন্দে কাটছিলো ওদের দিন তখন হঠাৎ করে ঘটলো এক ঘটনা। সেদিন বরণে দৌঁড়ে আসলো গোবিন্দদের বাড়িতে। গোবিন্দকে পাওয়া গেল তাদের ঘরের পেছনের সব্জি বাগানে।

ওকে দেখেই বরেণ হাপাতে হাপাতে বলল: গোবিন্দ! সর্বনাশ হইয়্যা গেছে! তুই তাড়াতাড়ি সুনীলরে নিয়্যা মাঠে যা; পারলে অমলরেও লইয়্যা যা। আমি আশিক, পটলা, বাপ্পা ওগোরে লইয়্যা আইতাছি। গোবিন্দ অবাক হয়ে বলল: কেন কী হইছে? : পরে কমু, তাড়াতাড়ি যা, দেরী করিস না। বলেই আবার দৌড় দিলো বরেণ। চিন্তিত হয়ে গোবিন্দ সুনীল ও অমলকে নিয়ে মাঠে গেল।

কারা যেন জমি মাপার ফিতা দিয়ে তাদের মাঠটা মাপজোক করছে। ইতি মধ্যে সবাই এসে জুটলো মাঠে। অবাক হয়ে দেখতে লাগলো সবাই। বরেণ বলল: বুঝেছিস, এই মাঠে বাড়িটারি কিছু করবে মনে হয়। : কেন, মাঠতো আমাগো; ওরা বাড়ি করবো কেন? : সরকারী জায়গায় এতো দিন খেলছি; এখন আর পারুম না।

: সরকারী জায়গা হইলে ওরা বাড়ি করবো কেমনে? : কি জানি, মনে হয় লিজ টিজ নিছে। : না, এইডা হইতে পারে না। তাইলে আমরা খেলুম কই! এসব কথা বলতে বলতে সেদিনের মত বাড়ি ফিরলো সবাই। সবার মনেই এক অজানা আশংকা। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল একটা ইটের ভাটা হবে খাস জমিটায়।

লীজ নিয়েছেন স্বয়ং চেয়ার ম্যানের ভাইপো রশিদ গাজী। তার মত ধুরন্ধর লোক এ তল্লাটে আর নেই। সবার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো মাঠটার কোন অস্তিত্বই নেই। সেখানে তৈরী হয়েছে একটা বিশাল ইটের ভাটা। গন গন করে জ্বলছে তার আগুন।

ভক ভক করে ধোঁয়া উঠছে ভাটার চিমনি দিয়ে। ওরা সবাই মিলে যুক্তি করলো চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করবে যেন এখানে ভাটাটা না হয়। প্রয়োজনে অন্য একটা জায়গায় করা হোক। খাস জমির তো আর অভাব নেই গ্রামে। তাদের চির প্রতিদ্বন্দি উত্তর পাড়ার ফুটবল ক্লাবের সদস্যরাও এগিয়ে এলো তাদের সাহায্য করতে।

দুই দলের খেলোয়াররা ছাড়াও এগিয়ে এলো গ্রামের কিছু স্বহৃদয়বান যুবক। শুধু দ্বিমত প্রকাশ করলো তাদের বাবা-মায়েরা। তাদের ভাষ্য হল: সামান্য একটা মাঠের জন্য এতো কিসের গরজ! তবুও একদিন সবাই মিলে গেল চেয়ারম্যানের কাছে। খুলে বলল সব কথা। এমনিতে চেয়ারম্যান সাহেব বেশ ভাল মানুষ।

পর পর তিন বার চেয়ারম্যান হয়েছেন। গ্রাম্য চেয়ারম্যানদের সম্পর্কে জনসাধারণের যেরকম ধারণা উনি মোটেই সেরকম নন। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি খুব একটা সাহায্য করতে পারলেন না। তিনি ওদের বোঝালেন- জায়গাটা সে লীজ নেয় নি, নিয়েছে তার ভাইপো। তার ভাইপোর স্বভাবের জন্য এমনিতেই তাঁর সাথে খুব একটা ভাল সম্পর্ক নেই।

তাছাড়া রশিদ গাজী নাকি বেশ টাকা পয়সাও খরচ করে ফেলেছে জায়গাটার জন্য। নদীর কাছাকাছি অতোখানি খাস জায়গা একসাথে পাওয়াও বেশ দুষ্কর। তাছাড়া ইটের ভাটা হলে এলাকার খেটে খাওয়া দিন-মজুরগুলোর ও একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। সব মিলিয়ে জায়গাটা বাঁচানো সম্ভব না। তবে প্রয়োজনে ওদের খেলার জন্য আরেকটা মাঠের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে বলেও সান্তনা দিলেন তিনি।

একরকম হতাস হয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে ফিরলো ওরা সবাই। কয়েক দিনের মধ্যেই ইট-বালি সুরকিতে ভরে গেল মাঠ। পুরোদমে শুরু হয়ে গেল ভাটা তৈরীর কাজ। দেখতে দেখতে তৈরী হয়ে গেল ইটের ভাটা। কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন।

“বোয়ালি উদয় সূর্য ক্লাব”-এ নেমে এসেছে এখন সূর্যাস্তের অন্ধকার। ক্লাব ঘরের বেড়াগুলো রাখা হয়েছে স্কুলের একটা অব্যবহৃত ঘরে। ক্লাবের সদস্যরা আজকাল সারা বিকেল এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। মনে তাদের আজ সেই আগের মত আনন্দ নেই। নেই সেই উচ্ছাস।

মাঠটা চলে যাবার পর বহু দিন খেলাধূলা করা হয়নি। নানা কাজের চাপে চেয়ারম্যানও ব্যবস্থা করেনি নতুন একটা মাঠের। মাঠ হারিয়ে সবাই কেমন যেন হতাশ আর মলিন হয়ে গেছে। প্রথম দিকে তাদের বাবা মায়েরা মোটামুটি খুশিই হয়েছিল। ভেবেছিল- যাক, চেলেগুলো এবার খেলাধূলা কমিয়ে পড়াশুনায় মন দেবে।

অমলের বাবা অমলকে সেদিন বলল: খেলাধূলা তো চাঙ্গে উঠেছে, এবার একটু কাজে কর্মে মন দে। বিকেল বেলা গিয়ে আমাদের দোকানে বসবি। দেখিস আবার সব চকলেট-বিস্কুট খেয়ে শেষ করিস না যেন। কোন জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে। আস্তে আস্তে বোয়ালির সেই নাম করা ফুটবল খেলোয়াড়রা বখে যেতে শুরু করলো।

তাদের বিরুদ্ধে আসতে লাগলো ছোট-খাটো চুরি, সিগারেট খাওয়া, রাত করে বাড়ি ফেরা, খারাপ ব্যবহার করা প্রভৃতি অভিযোগ। একদিন পটলার বাবা পটলাকে এসব ব্যাপারে শাসন করলো। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরলো না পটলা। বাপ্পাকে সেদিন দেখা গেল রাস্তার পাশে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ওদের এই অধঃপতন দেখে সবার মা-বাবাই কম বেশি চিন্তায় পড়ে গেল।

কেউ কেউ ভাবলো- পিটাতে হবে ইচ্ছা মত, আবার কথা শুনবে না! এক সময় দেখা গেল বোয়ালি গ্রামের সেই উদ্যামি তরুণদের আর কোন অস্তিত্বই নেই। তাদের জায়গায় দখল করে আছে অবাধ্য ছন্নছাড়ার দল। সেই আধ ফোটা ফুলের কুঁড়ি আজ ছিন্ন মুকুলে রূপ নিয়েছে। এভাবে আস্তে আস্তে সেই ছিন্নমুকুলগুলোর অধঃপতন ভয়াবহ আকার ধারন করলো। এক সময় তারা রুখে দাঁড়াতে শুরু করলো বড়দের শাষণের বিরুদ্ধে।

ইটের ভাটা হওয়ায় গ্রামে এখন নানা রকম বাইরের লোকের ভিড়। তাদের মধ্যে উটকো লোকও আছে অনেক। ইটের ভাটার পেছনেই আজকাল জুয়ার আড্ডা বসে। মদ-গাজার আয়োজনও থাকে সেখানে। মাঝে মাঝে গ্রামের ছেলে-ছোকরাদেরও দেখা যায় সেখানে।

একদিন খুব মারামারিও হল জুয়ার আড্ডাকে কেন্দ্র করে। এসব বিষয় নিয়ে একদিন বিচার গেলো গ্রামের মাতবরের কাছে। মাতবরের বিচারে কোন ফল তো হলোই না, উপরন্তু পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলো। সেবার বার্ষিক ফলাফল প্রকাশের দিনে বোয়ালি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিমল ভট্টাচার্য গ্রামের সবার উদ্দেশ্যে একটা জন সভার আয়োজন করলেন স্কুলে। সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো ফল প্রকাশের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার জন্য।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হলো এলাকার চেয়ারম্যান সাদেক গাজীকে। এছাড়াও আরও আমন্ত্রণ জানালেন এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে। জনসভায় তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন: বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ফলাফল খুবই খারাপ। এই ফলাফলের অন্যতম কারণ হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রিদের পড়ালেখার প্রতি অমনোযোগিতা। আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারনা আছে, আর তা হলো জোড় করে পড়ার টেবিলে বসিয়ে রাখলেই লেখাপড়া হয়ে যায়।

কিন্তু কেউই বুঝতে চাই না যে, হাত বাঁধা যায়, পা বাঁধা যায় কিন্তু মন বাঁধা যায় না। আর পড়া লেখাটা হচ্ছে পুরোপুরি মনের ব্যাপার। মন যদি পড়ার মধ্যে না থাকে তাহলে সারাদিন বই সামনে নিয়ে বসে থাকলেও পড়া লেখা হবে না। পড়া লেখার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ আর প্রফুল্ল মন। আপনারা সবাই জানেন যে, আমাদের স্কুলের পাশেই যে খাস জমিটা ছিল সেখানে এখন ইটের ভাটা তৈরী হয়েছে।

আগে এই মাঠে আমাদের ছাত্ররা খেলাধূলা করতো। কিন্তু সেই মাঠ আমরা কেড়ে নিয়েছি। তার পর থেকেই ওদের এই পাঠে অমোনযোগিতা। তাই বলা যায়- তাদের এই অধঃপতনের জন্য অনেকাংশে আমরাই দায়ী। লোকজন এবার একটু নড়েচড়ে বসল।

এভাবে কেউ ভেবে দেখেনি কখনও। বিমল বাবু আবার বললেন: কিশোরদের গরম রক্ত ঘাম ঝরাবেই। সেটা খেলার জন্যই হোক আর যে জন্যই হোক। যে ছেলেগুলো রোজ বিকেলে খেলাধূলা করতো তাদেরকে যদি হঠাৎ খেলা বন্ধ করে দেয়া হয় তবে তারা কি করবে? কিভাবে কাটাবে সময়টা। আমরা সবাই জানি, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।

আর একারণেই ওরা নানা রকম অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। আর কায়িক পরিশ্রম না করলে মনও অলস হয়ে পড়ে। একারণেই ওদের লেখা পড়ায় মন নেই বলে আমার বিশ্বাস। যাইহোক, আমার বিশ্বাস ওদেরকে যদি আগের মত একটা খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে দেয়া যায় তাহলে মনে হয় ওরা আবার আগের জীবনে ফিরে আসতে পারে। আপনারা কী বলেন? এবার লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো।

আসলে মাষ্টার সাব ঠিকই কইছে। পোলাপানগুলা আগে এরহম আছিলো না। ঐ ইট খোলাডা হওয়ার পর থিকাই...। বিমল ভট্টাচার্য এবার প্রস্তাব করলেন- সবার আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যদি একটা মাঠ ওদের দেয়া যায়, তাহলে হয়তো আমাদের গ্রামের ছেলেগুলো আগের মত সুন্দর জীবনে ফিরে যেতে পারবে। আমি এবার আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, অত্র এলাকার চেয়ারম্যান জনাব সাদেক গাজীকে অনুরোধ করবো এ বিষয়ে তার মতামতসহ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দানের জন্য।

চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর বক্তৃতায় হেডমাস্টার সাহেবের সাথে একমত পোষণ করলেন। তিনি সবার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন: স্কুলের উত্তর পাশের যে খাস জমিটা আছে, ওটার জঙ্গলগুলো পরিষ্কার করলে মোটামুটি বড় একটা মাঠ হতে পারে। ছাত্ররা যদি পছন্দ করে এবং নিজেরাই জঙ্গল সাফ করে একটা মাঠ তৈরী করে নেয়, তাহলে তিনি পাকাপাকি ভাবে ওটাকে স্কুলের খেলার মাঠ হিসেবে সরকারীভাবে ব্যবস্থা করে দেবেন। তার প্রস্তাবে অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে গেল সবাই। বেশ কিছুদিন পরের কথা।

বোয়ালি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের মাঠটাতে থেকে সকাল থেকেই মাইক বাজছে। আজ এই মাঠে ‘বোয়ালি উদয় সূর্য ক্লাব’- এর পক্ষ থেকে আয়োজিত আন্তঃস্কুল ফুটবল টুর্ণামেন্টের ফাইনাল খেলা। অনেক দিন পর চির প্রতিদন্দি বোয়ালি আর আইলকুন্ডি স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে ফাইনাল খেলা হবে আজ। পুরো মাঠ সাজানো হয়েছে রঙিন পতাকা দিয়ে। ছোট ছোট বাচ্চারা মাঠের ভলেন্টিয়ার! তারা অসীম আগ্রহে মাঠের চার দিকে ফ্ল্যাগ গেঁথে দিচ্ছে।

কেউ কেউ মাঠের নুড়ি-পাথর পরিষ্কার করছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। মাঠের পশ্চিম কোণায় অতিথিদের জন্য স্টেজ করা হয়েছে। তার পাশেই ‘বোয়ালি উদয় সূর্য ক্লাব- এর ক্লাব ঘর। দরজার ওপর সাইনবোর্ডটা ঝকঝক করছে।

ক্লাবের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ বসেছে। ক্লাবের প্রতিটি সদস্য এখন বসে আছে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে। এদের দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, মাত্র ক’দিন আগেও এদর কেউ কেউ চুরি-চামারি করতো, সিগারেট খেত, পড়ালেখায় অমোনযোগী ছিল, বড়দের সাথে দুর্ব্যবহার করতো; ছিল একদল বখাটে ছোকরা! ক্লাবের ক্যাপ্টেন সুনীল সবার উদ্দেশ্যে বলল: বন্ধুরা, আইলকুন্ডির দল নাকি ঢাকা থিকা প্লেয়ার হায়ার করছে। আশিক বলল: হঅ, সেমি ফাইনালে কালা মনাই লাল কার্ড পাইয়্যা তো বাদ হইয়্যা গেছে। এই জন্যে নতুন পিলিয়ার আনছে।

পটলা বলল: আমাগো ভুল হইছে, আমাগোও পিলিয়ার হায়ার করা দরকার আছিলো। এমনেই সেমি ফাইনালে অমল ব্যথা পাইছে। আইক্যা কেমন খেলবো কে জানে? সুনীল দম্ভের কণ্ঠে বলল: বোয়ালি উদয় সূর্য ক্লাব কোনদিন হায়ারের প্লেয়ার নিয়া খেলে না। ইনশাল্লাহ্ আইজ আমরা এই আমাগো দল নিয়াই ফাইনাল জিতব। সব সদস্য একসাথে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলো: ইনশাল্লাহ্! বিকেল চারটা উন চল্লিশ।

কিছুক্ষণ আগে খেলা শুরু হয়েছে। খেলা দেখার জন্য আশপাশের চার-পাঁচ গ্রামের মানুষ ছাড়াও উপস্থিত হয়েছেন বিশিষ্ট সব লোকজন। স্বয়ং চেয়ারম্যান সাহেব বিজয়ী দলের হাতে কাপ তুলে দিবেন। টান টান উত্তেজনা চলছে খেলোয়ারদের মধ্যে। ওদের চেয়েও অনেক বেশি উত্তেজিত দর্শক হিসেবে উপস্থিত গ্রামের লোকজন।

এই খেলা যেন শুধু নিছক একটা খেলাই নয়, দুইটি গ্রামের ইজ্জতের লড়াই! ওরা পারবে তো, গ্রামের ইজ্জত রক্ষা করতে? যে ছেলেগুলো ক’দিন আগেও ছিল এই গ্রামের অভিশাপ। একদল বখাটে ছোকরা ছাড়া আর কোন পরিচয়ই যাদের ছিল না। আজ তাদের হাতেই গ্রামের ইজ্জত রক্ষার ভার! সত্যি প্রতিটি কিশোরের জন্য কী বিষ্ময়কর এই মাঠ! খেলার মাঠ! ---------- ০ ---------- ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.