আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপাবৃণু, অথবা নীরার মা হওয়া

প্রকীর্ণ করি অর্ণে আলোক বিসর্গী বীথিকায় বজ্রমুষ্টি শিথিল হয়ে এল তার। যে জীবন যাবার উপক্রম করতেই নীরা তাকে খামচে আঁকড়ে ধরেছিল আহূত এক দ্বিতীয়া সত্ত্বার ধ্রুব আকর্ষণে, তা যেন হঠাৎ ফিরে এল। শরীরের প্রতিটি কোষ এক তীব্র সংকোচন প্রতিজ্ঞায় তার পেলব দেহটিকে একটি পিণ্ডে পরিণত করতে চেয়েছিল। প্রক্রিয়াটি পিছিয়ে গেছে। অনন্তকাল পর এসেছে কুঞ্চিত উন্মত্থিত বিছানায় ব্যক্ত গ্লানির ছাপ ঢেকে পিঠ ছোঁয়াবার সুযোগ।

ছাদের পানে চোখ মেলে চাইল নীরা। সেখানে স্থানে স্থানে পলেস্তরা খসে গেছে শীতার্ত পথশিশুর অচর্চিত ঠোঁটের মতন। নিরন্তর অবসন্ন হয়ে বসে থাকা মায়ের মুখের দিকে তাকাল সে। পঞ্চাশোর্ধ্ব, চেতনা ও যাতনায় ক্লিষ্ট একজোড়া চোখ দেখতে পেল। সময় বুঝি অসম্ভব প্রসারিত হয়ে গেছে তার কাছে।

দেখতে পেল মায়ের ঠোঁটজোড়া ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেছে। ভেবেছিল বহুদূর হতে একটি স্নেহময় ডাক ভেসে আসবে। এল খুব কাছ থেকে, যার অর্থ- ফের ধাতস্থ হয়ে উঠেছে সে। ‘নীরা, মামণি আমার? কথা বল! কেমন লাগছে এখন?’ ব্যাগ্র কণ্ঠ প্রশ্নালু মমতাময়ীর। জবাবে ক্লান্ত অবসন্ন নীরার ক্ষীণকণ্ঠ।

‘ব্যাথাটা চলে গেছে মা। কিন্তু, আবার আসবে’। বর্ষীয়সীর আর্দ্র চোখের দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করল সে। চেয়ে দেখল তাঁর ক্রমে শুভ্র হয়ে আসা মলিন কেশপাশ। খুব বলতে ইচ্ছে হল, ‘এত কষ্ট করেছ মা তুমি আমাদের জন্যে! আজ আমি সব বুঝতে পারছি! তুমি কি চাও আমার কাছে?’ অর্বাচীন কথনসমস্ত।

অর্থহীন, তথাপি অর্থপূর্ণ! দরজায় হালকা টোকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন একজন শ্বেত এপ্রনধারিণী। পিজি হাসপাতালের এককালের যশস্বী অধ্যাপিকা ড. শরিফা শামসুদ্দিনের পুত্রবধু এবং অত্র স্বর্ণালী নার্সিং হোমের একজন নিয়মিত গাইনোকোলোজিস্ট ইনি। আগ্রীবা মেহেদিরঙা চুল, ভারী কাচের চশমা, বিবিধ এস্টারে স্ফীত উদর, খর্বাকৃতি এবং ফর্সা। তাঁকে দেখে মনে হতে পারে ত্বকটুকু শ্যামলা হলেই যেন ভাল ছিল। কেননা, তাতে নাকের নিচের হালকা গোঁফের রেখাটি এতটা প্রকট রূপে দেখা যেত না।

এখন যেমন তার সদর্প উপস্থিতি পিটুইটারি গ্ল্যান্ডঘটিত অসমতা প্রকাশ করছে। তাঁর ব্যাক্তিত্বে এ গোঁফটুকুর ছাপ পড়েছে নিঃসন্দেহে। কিঞ্চিৎ গলা ঝেড়ে নিয়ে নীরার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন তিনি, ‘আপনি একটু বাহিরে আসুন প্লিজ’। নীরার দুর্বল হাতে একটি উষ্ণতা ক্ষণিকের জন্যে বেড়েই অন্তর্হিত হল। মৃদু শব্দে টুলটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মা।

নীরা অনুভব করল তার ইন্দ্রিয়ানুভূতির তীব্রতা অসহ্য রকম বেড়ে উঠেছে। কেননা টুল সরাবার সামান্য শব্দও তার কানের পর্দায় আঘাত করেছে ভীষণ জোরে। শুধু শ্রবণশক্তিই নয়; ঘ্রাণশক্তিও অসম্ভব বেড়ে গেছে। অন্যসময় হলে হয়ত টেরটিও পেত না, কিন্তু এখন এ মুহূর্তে দণ্ডায়মানা এপ্রনধারিণীর শরীর হতে ভেসে আসা বেনজিনের উগ্র গন্ধটুকু, তার কাছে মাত্রাছাড়া অসহনীয় ঠেকছে। ভদ্রমহিলা মাকে নিয়ে অদৃশ্য হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে।

‘আপনার মেয়ের পেইন ইন্টারভ্যাল ঠিক আছে। চিন্তার কারণ নেই। এবার বলুন কি সিদ্ধান্ত নিলেন’। সম্মুখ উপবেশনকারিণীর চোখে স্থির সংবদ্ধ দৃষ্টি প্রফেসরের পুত্রবধূর। নীরার মা অস্বস্তি বোধ করলেন।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁর চোখজোড়া বারবার ঐ গোঁফজোড়ার দিকে চলে যাচ্ছে। তবে স্বীকার করতেই হবে, এ আরোপিত ব্যাক্তিত্বটির সামনে তাঁর সহজাত ব্যাক্তিত্ব কিছুটা পরাস্ত হয়ে পড়েছে। নিজেকে শাসন করলেন তিনি। পরাস্ত হলে চলবে না। তাঁকে এখন শক্ত কণ্ঠে কিছু কথা বলতে হবে।

চশমার আড়ালে থাকা স্থির একজোড়া লালচে চোখে দৃষ্টিসঞ্চালন করলেন তিনি। স্নায়ুর খেলা এককালে তিনিও মন্দ খেলতেন না। সৌম্য কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। আমি বা আমার মেয়ে, কেউই সিজার চাইনা। আমরা চাই নরমাল ডেলিভারি হোক’।

‘আহহা, আপনি বুঝতে পারছেন না!’ অসহিষ্ণুতার সুর প্রকট চিকিৎসক ভদ্রমহোদয়ার কণ্ঠে, চোখে মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ। চেয়ারটা সশব্দে পেছনে ঠেলে তাতে হস্তিনীসদৃশ শরীরটিকে এলিয়ে দিয়ে, হাতের বহুল ব্যবহৃত জীর্ণপ্রায় স্টেথোস্কোপের প্লাস্টিকের নলটিকে অস্থির ভাবে প্যাঁচাতে লাগলেন তিনি ভরাট কব্জিতে। তারপর হঠাৎ সম্মুখে ঝুঁকে এলেন। বললেন, ‘আপনার মেয়ের জরায়ুর মুখ দশ সেন্টিমিটার খুলতে হবে সেজন্যে, তা জানেন? এখনও পর্যন্ত খুলেছে মাত্র দু সেন্টিমিটার’। নীরার মা স্থির সংকল্প।

দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, আমার মেয়ের বয়েস ঊনত্রিশ। তার বয়েস যদি কুড়ি হত আমার সন্ত্রস্ত হবার কারণ ছিল। আপনারা আরেকটু সময় নিন না প্লিজ! সিজারের ব্যাপারে আমার নিকটাত্মীয়া অনেকেরই অভিজ্ঞতা বেশ খারাপ। আমি তাদের অনেক কটকেনা; ধরাবাঁধা নিয়মকানুন দেখেছি। আমি চাই না আমার মেয়েকে সেসব দুর্যোগের ভেতর দিয়ে যেতে হোক।

আমরা সবাই চাইছি শিশুটি যেন যথাসম্ভব প্রাকৃতিক উপায়ে পৃথিবীতে আসে। এটা তো মা শিশু দুজনার জন্যেই ভাল, তাইনা? সেক্ষেত্রে আপনাদের ফিরে ফিরে এমন আপত্তি- বলতে বাধ্য হচ্ছি ডক্টর- আমাকে যথেষ্ট বিস্মিত করছে’। শেষ কথাক’টা বলতে গিয়ে নীরার মায়ের ঘাড়ের কাছটা তিরতির করে কেঁপে উঠল। ব্যাথা করতে শুরু করল তারপর। বুঝতে পারলেন ব্লাডপ্রেশার হঠাৎ বেড়ে গেছে।

কিন্তু কথাগুলো বলতে পেরে ভালও লাগছে। মেয়ে তাঁর নিতান্তই সুস্থ এবং পর্যাপ্ত অর্থব্যয়েও নেই ন্যূনতম সংকীর্ণতা। তবে কেন এমন উটকো জবরদস্তি ওদের? ভাবলেন তিনি। ওদিকে ডাক্তারের মুখে পড়েছে স্পষ্ট অপমানের ছায়া। কণ্ঠের পূর্বেকার নগ্ন অসহিষ্ণুতার গায়ে খানিকটা কাপড় চাপিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ব্যাপারটা তাহলে আপনার মেয়ের ওপর নির্ভর করবে পুরোপুরি। ম্যাডামকে বলেছিলাম আপনাদের সিদ্ধান্তের কথা। তিনি বলে দিয়েছেন, সন্ধ্যের আগে যদি জরায়ুমুখ পর্যাপ্ত খোলে, তো ডেলিভারি হবে। নচেৎ তিনি থাকতে পারবেন না। তাঁর বিশেষ তাড়া আছে’।

নীরার মায়ের মনে হল তাঁর মাথায় বুঝি আগুন ধরে গেছে। হার্ট বিট মিস করল পরপর ক’বার। জিভ তেতো হয়ে গেল। থুতু জমল মুখে। তবু কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললেন, ‘আপনারা শেষ মুহূর্তে কেন এমন করছেন।

আপনাদের খুব বেশি অসুবিধে হলে মেয়েকে আমরা অন্য ক্লিনিকে নিয়ে যাব। তবু দয়া করে এভাবে কথা বলবেন না। মা হিসেবে আমি কেমন মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তা আপনাদের খানিকটা হলেও বোঝা উচিৎ। আপনারাও তো সন্তানের মা। নন?’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার।

জীর্ণ স্টেথোস্কোপটা পুরুষ্টু কব্জি থেকে খুলে নিয়ে এপ্রনের পকেটে রাখলেন। চোখ দেখে ভাবনা কিছু আঁচ করা গেল না। বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি আপনার মেয়ের কাছে যান। ম্যাডাম কিছুক্ষণ পরই আসবেন’। মিনিট পনেরর মাঝে নীরার মা টের পেলেন, প্রায় রোগিণীশূন্য এ মেটারনিটি ক্লিনিকটির প্রতিটি স্টাফের আচরণে হঠাৎ সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন এসেছে।

পূর্বেকার কোমলকণ্ঠী আয়ারা এখন সশব্দে দরজা খুলে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই ঘরে ঢুকে পড়ছে কি বেরুচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে বিধায় একজন সরোষে জানালার কবাট লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। ওপাশের মোরগফুল গাছের টিয়েসবুজ পাতা যে আটকা পড়েছে জানালার দু’ কবাটের মাঝে, লক্ষ্যই করল না। আরেকজন কোন একভাবে মেঝে মোছা শেষ করে জলভরা বালতির হাতলে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বসল। কিছু জল ছলকে মেঝেতে পড়ল দরজার কাছটায়, মুছে দিয়ে যাবার প্রয়োজন বোধ করল না।

রুটিন চেকে আসতো কমবয়েসী সুশ্রীমতন এক মেয়ে, কথা বলত খুব যত্ন করে। কেমন দুর্বিনীত ভঙ্গিতে যেনতেনভাবে নীরার ব্লাডপ্রেশার মেপে নিয়ে হেলার সঙ্গে হাতটা বিছানায় ফেলে দিয়ে দ্রুত চলে গেল। নীরার মা ভেবে পেলেন না, এসব কি প্রকৃতই ঘটে চলেছে নাকি তাঁর চোখের ভুল। নীরা ক্লান্ত সমর্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল তাঁকে, ‘অরুণ আসছে না মা?’ তিনি অমনস্ক হয়ে উত্তর দিলেন, ‘হু, ফোন করেছিল। বলেছে কাছিয়ে এসেছে’।

হঠাৎ কুঁকড়ে গেল নীরার ঋজু শরীর। গোঙানির মত অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। বড় বড় চোখ দুটোয় আতঙ্ক ঘনিয়ে এল। ব্যাথাটা ফিরে এসেছে। অসহনীয় যন্ত্রণাটুকু তলপেট থেকে বেরিয়ে শরীরের প্রতিটি কোষের ভেতর ছড়িয়ে গেল মুহূর্তের ব্যাবধানে।

নীরার মনে হল, সারা বিছানায়-সারা শরীরে বুঝি কিলবিল করছে লক্ষ লক্ষ কিলার ক্যাটারপিলার, যাদের ঘিনঘিনে নরম দেহের ওপর বিবর্তনের ফসল ঐ সবুজ দূর্বাঘাসের মতন বিষাক্ত কাঁটাগুলো; তার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চিতেD বিঁধে গিয়ে ভয়াবহ মৃত্যুগরল ঢেলে চলেছে। বিছানা খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে সরীসৃপের রক্তাক্ত ছিন্ন প্রত্যঙ্গের মতন ছটফট করতে লাগল সে। এমন সময় দরজা ঠেলে সন্ত্রস্ত মুখে ঘরে ঢুকল অরুণ। সঙ্গে সঙ্গে নীরার চিৎকার, ‘বেরোও অরুণ, প্লিজ! দূরে যাও! আই’ম সরি! আই’ম সরি!’ অরুণ ভীত মুখে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ নিষ্ফল আক্রোশে মুঠো পাকিয়ে বিছানায় আঘাত করে চলল নীরা, যেন পিষে মারতে চাইল ক্লেদাক্ত শুঁয়োপোকা গুলোকে।

হঠাৎ বিগত প্রতিটিবারের মত ব্যাথাটা ফের ভোজবাজির মত উধাও হয়ে যেতেই, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের চোখে। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠল, ‘মা। আর একবার যদি এ ব্যাথা আসে, আমি মারা যাব। স্রেফ মারা যাব’। অরুণের কথা মনে এল তার।

বলল, ‘অরুণ কোথায়? বেচারা। ওকে আসতে বল না!’ রাত আটটায় নীরাকে যখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল, তখন তার জরায়ুমুখের ব্যাস আট সেন্টিমিটারের কিছু কম। দেখা গেল নাট্যমঞ্চের অন্যতমা অভিনেত্রী হবার জন্যে সেখানে প্রস্তুত প্রফেসর ড. শরিফা শামসুদ্দিন। পূর্বঘোষিত ‘বিশেষ তাড়া’ উপলক্ষে চলে যাননি তিনি। পেট সমান উঁচু একটি টেবিলে শুইয়ে দেয়া হল নীরাকে।

তার মেঘকালো রাশিকৃত চুল শিওরের দেউড়ি পেরিয়ে মেঝের খুব কাছে এসে থেমে গেল। রক্তশূন্য ঠোঁটে শুষ্ক জিভ ঠেকিয়ে ভেজাবার বৃথা চেষ্টা করে গেল সে কিছুক্ষণ। জল চাইতে গিয়েও চাইল না। তলপেটটা ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিয়ে উঠছিল। যে কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে ব্যাথাটা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এত যাতনার পরও এর মাঝে এক বিচিত্র আনন্দকে প্রচ্ছন্ন দেখতে পেল সে। এ আনন্দ, প্রথম মা হবার অতুলনীয় অনাস্বাদিতপূর্ব স্বর্গীয় আনন্দ। ঠোঁটজোড়ায় ছোট্ট স্মিত হাসি রেখাপাত করল তার। আর কিছুক্ষণের মাঝেই কি সেই আশ্চর্য মানবীটিকে সে বুকের কাছে পেতে যাচ্ছে না- রাতের পর রাত যার সুখস্বপ্নে শুধু প্রহরের পর প্রহর গুনে গেছে? মনে মনে প্রিয় এ প্রশ্নের তৃষিত উত্তরটি নিজেই দিল সে। ‘যাচ্ছে বৈ কি’।

অবশেষে পাঁজর গুঁড়িয়ে দেয়া সেই আরাধ্য যাতনাটি ফিরে এল আরও একবার! করুণ ওঙ্কারে শিউরে উঠল উপস্থিত কায়ারা। বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যে অভিজ্ঞতাটির ওপর ধুলো পড়ে গিয়েছিল, এক অসহ্য মনোবলসম্পন্না একগুঁয়ে রমণী এসে তাদের ফের তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হাঁপরের মত ওঠানামা করছে নীরার বুক। স্ফীত তলপেট আর ঈষৎ ফাঁক হয়ে হেলে পড়ে থাকা পা দুটো তার ললিত অবয়বে আশ্চর্য অসহায়ত্ব এনে দিয়েছে। ড. শরিফা শামসুদ্দিন জোর গলায় বলে উঠলেন, ‘প্রেশার দিন! হচ্ছে না।

আরও প্রেশার দিন তলপেটে!’ নীরার বুকে তৎক্ষণাৎ কিছু বলার মত যথেষ্ট শ্বাস সঞ্চিত ছিল না। দম ফুরিয়ে আসছিল ঘন ঘন। টুকরো টুকরো করে বলল সে, ‘আমি পারছি না ডক্টর! কিভাবে প্রেশার দেব আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে শিখিয়ে দিন না একটু, দোহাই লাগে?’ প্রফসরের পুত্রবধূ ঠা ঠা করে হেসে উঠলেন এ কথায়। বললেন, ‘এতে শেখাবার কি আছে।

সবাই পারে’। ‘কিন্তু আমি পারছি না ডক্টর, আই বেগ টু ইউ!’ নীরা কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করে গেল। ‘একটু শিখিয়ে দিন না প্লিজ! একবার?’ পরবর্তী ত্রিশটি মিনিট জীবনে প্রথমবারের মত মা হতে চলা একজন নারীর আনাড়ি প্রয়াস উপভোগ করলেন উপস্থিত সুধী নারীবৃন্দ। এটি ছিল পৃথিবীর বুকে এযাবতকালের সর্বাপেক্ষা দীর্ঘতর এবং একপেশে, একাকী ত্রিশটি মিনিট। দরদর করে ঘামছিল নীরা।

এক প্যাডেলস্ট্যান্ড ফ্যান দাঁড়িয়ে ছিল তার মাথার কাছে। বন্ধ। নীরা বলল, ‘পাখাটা একটু চালিয়ে দিতে বলুন না ডক্টর! আমার অসম্ভব গরম লাগছে’। তলপেটে হাত রাখা আদিবাসী ছাঁচঢালা বশংবদ সহকারী বলে উঠলেন, ‘ধৈর্য ধরে থাকুন। এসি তো চালানোই আছে’।

ফের ব্যাথা অন্তর্হিত হল। সমস্ত শক্তি হারিয়ে একান্ত অমিত আঁধারে আরও একবারের মত নিজেকে সঁপে দিল নীরা। প্রতিবারই তার একান্ত যাচনা ছিল, এবারই যেন সেই জীয়ন্তে মৃত্যুস্বাদের শেষাংশ এবং শ্রেষ্ঠাংশটুকু অবতীর্ণ হয়। অবশেষে তাই হল। খানিকবাদেই যাবতীয় ঘটনাপ্রবাহের শেষাংশ এবং শ্রেষ্ঠাংশটুকু অবতীর্ণ হল, যেখানে রেড কুইন থিওরেমের সার্থক অভিযোজনোত্তর প্রাণীজগতে দুটো পৃথক যৌনসত্ত্বার আবির্ভাবের ফলস্বরূপ নারীসত্ত্বাটির গর্ভধারণ নামক প্রাকৃতিক পাশবিক তথাপি সর্বাপেক্ষা স্পর্শকাতর এবং অর্থবহ ঘটনার চূড়ান্ত ধাপে একটি অপেক্ষমাণ প্রাণের বিশেষণাতীত যন্ত্রণাঋদ্ধ উপায়ে মাতৃগর্ভকে বিদায় জানাবার আদিম প্রকৃয়ার বিপরীতে, বেজেই চলেছিল নীরার বিস্ময়াভিভূত জঠরমাতৃত্বের বিদায়ী ঘণ্টাধ্বনি।

যাতনার তীব্রতায় বিদ্যুৎবেগে সে প্রফেসরের সুডৌল হাতটি ধরে ফেলল। দেবী দুর্গার মত চোখজোড়ায় আকুল মিনতি ফুটিয়ে বলে উঠল, ‘ডক্টর। আমাকে বাঁচান প্লিজ। আমাকে বাঁচান। আমি যে মারা যাচ্ছি!’ করুণার্দ্র ডাক্তার তার মুঠো থেকে হাতটি ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘বাঁচতে চাইলে নিজ দায়িত্বে বাঁচুন।

আমার আর কিছু করণীয় নেই’। অনাগত সন্তানের নিষ্পাপ মুখচ্ছবি একটিবার দেখে যাবার শম্পাপ্রতীতি জীবনের গায়ে তার শেষ মানবিক নখর বসাল। এক আদিম প্রাকৃতিক সঙ্কেতে দুজন নার্স নীরার দুটি হাত চেপে ধরলেন। আরও দুজন পা দুটো সরিয়ে নিলেন দুদিকে। একজন হাত রাখলেন তলপেটে।

ধারাল ব্লেড নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন প্রফেসরের পুত্রবধূ। অভিজ্ঞ হাতে চিরে দিলেন জরায়ুর মুখ, চারবার। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিল আহবকুঞ্চিত শুভ্র বিছানা। ড. শরিফা শামসুদ্দিন কক্ষ কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘প্রেশার দিন আরও! প্রেশার...!’ নীরা নিষ্ক্রিয় পড়ে রইল। অনিমিলিত চোখের কোণ ভিজিয়ে দিয়ে শুধু দু’ ফোঁটা অশ্রু গড়াল তার।

________ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.