আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলবদরদের শেষ মোনাজাত বা আলবদর মুজাহিদের শেষ ভাষণ...

ঢাকার পতনের পর ‘বীর’ আলবদররা পালাতে থাকে। মনসুর লিখছেন, পতন যখন আসন্ন তখন আলবদররা দিশেহারা অবস্থায় নির্দেশনার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রভুরাও পালাতে ব্যস্ত, কে কাকে নির্দেশনা দেয়। বিকেলে যখন রেসকোর্সে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলছে তখন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে বা সদর দফতরে ঢাকার আলবদররা মিলিত হলো। তাদের প্রভুদের আত্মসমর্পণের নিদ্ধান্তে তারা ‘পেরেশান’ এবং তাদের কি হবে! এ ভেবে তারা ছিল ‘উদ্বিগ্ন’ ও ‘ক্রন্দনরত।

’ এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান নাজেম আলী আহসান মুজাহিদ আলবদরদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। খালেদ লিখেছেন, ঐখানে যে সব আলবদর উপস্থিত ছিল তাদের কাছ থেকে শুনে তিনি এই বক্তৃতাটি সংকলন করেছেন এবং পরে মুজাহিদ তা সংশোধন করে সত্যায়িত করেছেন। ভাষণটি উদ্ধৃত হলো: “বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু ইন্না সালাতী” নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু একমাত্র আল্লাহ’তায়ালার জন্য। মুজাহিদ সাথীরা, আমাদের দেহ ও প্রাণ শুধু এবং শুধুই ইসলামের জন্য, আমরা ইসলামের জন্যই এসব কাজ করছি। মানে আমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী সঠিক বলে জানতাম।

আমরা পাকিস্তানকে উপাস্য মনে করে নয়, মসজিদ মনে করে আমাদের ঝুঁকি ও আমাদের ভবিষ্যৎকে এর ওপর ন্যস্ত করেছিলাম। আমাদের এই কাজ কেউ গ্রহণ করল কি না এর পরওয়া করি না। যার কবুল করা উচিত তিনি তো জানেন যে, আমাদের সামনে তার সন্তুষ্টিই ছিল মুখ্য। এটা আল্লাহরই ইচ্ছা ছিল যে, আমরা জীবনবাজি রেখে বেরিয়ে পড়ব। পরীক্ষায় সেই মুহূর্তে আমরা তাঁর কাছ থেকেই সাহায্য চেয়েছি এবং তাঁর ওপর ভরসা করেই ঐ নাজুক পরিস্থিতিতে মিশে না যাওয়ার চেষ্টা করেছি।

ওহে মজলুম পাকিস্তানের অসহায় সন্তানরা আমাদের সঙ্গে আজকে যা কিছু হবার আমরা চলে যাওয়ার গতকাল সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম। আর আজকে আমরা সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল যা আসন্ন আগামীকাল আমাদের জন্য নিয়ে আসবে। আমরা চলে যাওয়া গতকালের জন্য না লজ্জিত, আর না আসন্ন আগামী দিনের জন্য নিরাশ। পরীক্ষা আল্লাহর শাশ্বত বিধান। আর আমদেরকে শিখানো হয়েছে যে, পরীক্ষার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে।

কিন্তু পরীক্ষা যদি এসেই পড়ে তাহলে ধৈর্যের জন্য দোয়া ও কামিয়াবীর আশা নিয়ে আল্লাহর সামনে ঝুঁকে পড়তে হবে। আজকের সূর্যটি একটি কঠিন পরীক্ষা সামনে নিয়ে উদিত হয়েছে। আর আগামীকালকেরটি উদিত হবে ধিকি ধিকি আগুনের কয়লা বৃষ্টি নিয়ে। আমাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর এসব পরীক্ষায় একজন ঈমানদারের প্রত্যয় ও ধৈর্য নিয়ে এগুতে হবে।

আমরা বিশ্বাস করি যে, এই প্রাণে প্রাণ দিয়ে দেয়া এমন বিরাট সৌভাগ্য, যার চিন্তাও করা যায় না। আপন খোদার সঙ্গে নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে বেহেশত ক্রয় করার আগে কি আমরা ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করিনি? পরীক্ষার এ মুহূর্তগুলো এ জগতে সাফল্যের সুসংবাদও বটে। কাজেই এসব কঠিন মুহূর্তের সম্মুখীন হোন ঈমান প্রত্যয় ও স্বাধীন চেতনার দোয়া নিয়ে। কেননা প্রত্যয় ও ঈমানের কখনও বিনাশ নেই। ওহে দুনিয়া ভরা সকল সাফল্যের চেয়ে প্রিয় বন্ধুরা আপনারা আজকেও এক সময়ের অতি মূল্যবান সম্পদ দ্বীনকে কায়েম করা, সত্যের সাক্ষ্য দেয়া ও ইসলামী বিপ্লবের জন্য আপনাদের জীবনকে হেফাজত করা আপনাদের ওপর ফরজ।

যদি আপনাদের ঘরের দহলিজগুলো আপনাদের জন্য বন্ধ এবং আরাম আলয়গুলির প্রশস্ততা আপনাদের জন্য সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয়, তাহলে হিজরত করে চলে যাবেন। কেননা হিজরত হচ্ছে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পালন-পথের অনিবার্য সফর। হিজরত আল্লাহর সর্বশেষ নবীর সুন্নত। হিজরতের কষ্ট ও দুঃখসমূহের বেলায় কোরআন, নামাজ, রাসূলে খোদার সীরাত ও সাহাবায়ে কেরামের সীরাত জীবনী থেকে আলো গ্রহণ করবেন। কেননা জীবনের অন্ধকার পরিম-ল এগুলোর দ্বারাই আলোকিত হতে পারে।

আর ভুলবেন না, আপনারাই আলোর আমানতদার। আর আলো হচ্ছে কোরআন, সীরাত ও কর্ম। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন সেখানেই এই আলো জ্বালাবেন। ওহে আমার ভাইয়েরা, কার জানা আছে যে, আগামীকাল আমাদের মধ্যে জীবিত থাকবে এবং কার সঙ্গে কার দেখা হবে! আর ওখানে তো অবশ্যই সাক্ষাৎ হবে। তবে এই জগতে ছড়িয়ে যাওয়ার আগে সেই চেহারাগুলো প্রাণভরে দেখে নিন, এই রক্তগুলোর সঙ্গে শেষবারের মতো আলিঙ্গনবদ্ধ হোন।

কারণ হয়তো আরও একবার এখানে এভাবে একত্রিত হতে পারবে না। তবে আমাদের প্রতিপালক যদি চান আর যদি তিনি চান তাহলে আমরা আবারও এখানে মিলিত হতে পারি। সাথীরা, বন্ধুরা, ভাইয়েরা, এখন আমাদেরকে পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যেতে হবে। আপনাদের অনুভূতিগুলো একত্রিত করে নিন। আল্লাহ আমাদের সহায় ও সাহায্যকারী।

আসুন আমরা একে অপরকে দোয়ার সঙ্গে বিদায় দিই, ফি আমানিল্লাহ। বক্তৃতা শেষ। আলবদরের ডেপুটি চিফ মুজাহিদকে সবাই ‘অশ্রুসিক্ত নয়নে’ ও ‘কম্পিত ঠোঁটে’ অনুরোধ জানাল পালাতে। কিন্তু মুজাহিদ বললেন, ‘না’ আপনাদের যাওয়ার পর আমি যাব। আমিই হব ক্যাম্পের শেষ ব্যক্তি।

’ আলবদররা তখনও ক্যাম্প ছেড়ে নড়ছে না। গলাগলি করে হিক্কা তুলে কাঁদছে। তখন মুজাহিদ বললেন, ‘আমি বাধ্য হয়ে আদেশ দিচ্ছি, আপনারা হিজরতে বের হয়ে যান। ’ অর্থাৎ পালান। তখন আলবদররা তাদের সদর দফতর ছেড়ে, তাদের ভাষায়, ‘হিজরতে’ গেল।

আমাদের ভাষায় পালাল। নিরস্ত্র ব্যক্তিদের হত্যাকারী পাকিস্তানী সিপাহীদের ভৃত্য আলী আহসান মুজাহিদও বীর বিক্রমে ঢাকা ছেড়ে কাঠমান্ডুর পথে দৌড়াতে লাগল। তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.