আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিন্তু জীবন কি এতই সস্তা, জামান?

"হরি আছেন পূর্বে, আল্লা আছেন পশ্চিমে, তুমি তোমার হৃদয় খুঁজে দেখ- করিম ও রাম উভয়েই আছেন হৃদয়ে; এ জগতের সমস্ত মানব-মানবীই তাঁর অংশ। " (সন্ত কবীরের গান; তর্জমা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) "আজকে রাস্তা অচল,হয়তো আরো কদিন বিক্ষোভ,তারপর বছরে একদিন একটু মনে করা,তারপর আর সেটা ও না। জীবন কি এতই সস্তা? তুমি যেখানে থাকো,অনেক ভাল থাক Mohammad Touhiduzzaman। পরম করুনাময়ের কাছে এটাই প্রার্থনা। তিনি তোমাকে জান্নাতবাসি করুন,আমিন।

" (বুশরা হকঃ আমাদের বন্ধু, জামানের সহপাঠী) জামান আমাদের বন্ধু ছিল। "ছিল" লিখতে খুব কষ্ট হচ্ছে, তবু লিখতে হচ্ছে এই কারনে যে সে এখন আর নেই। গতকাল রাত সাতটার দিকে, প্রায় দু'ঘন্টা জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে থাকার পর, জামান মারা গেছে। তার হাসিমুখ আর আমরা ক্যাম্পাসে দেখব না, ক্লাসরুমে দেখব না, করিডোরে দেখব না। সে সব সময় কথা বলার আগে আমার কাঁধে হাত রাখত, হেসে বলত, "কি রে, ইরফান? কেমন আছিস দোস্তো?" আর কোনোদিন সে আমার কাঁধে সে হাত রাখবে না, জানতে চাইবে না আমি কেমন আছি।

জামান রে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছেঃ আমি ভালো নেই দোস্তো, আমরা ভালো নেই। তুই নেই জেনেও কি ভাবে আমরা ভালো থাকতে পারি? কাল সন্ধ্যায় যখন তোর মৃত্যুসংবাদ শুনলাম, নিজের কানে নয়, আমি জিগাতলায় আমাদের বাসায় আমার রুমে বসে ছিলাম, আব্বুর কাছ থেকে খবরটা শোনার সাথে সাথে আমার মনে হল আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে, আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছিল, কিন্তু কেন জানি আমি কাঁদতে পারছিলাম না, খুব রাগ হচ্ছিল, তোর জায়গায় আমিও তো থাকতে পারতাম, কেন তোর মত এত ভালো একটা ছেলেকে এভাবে চলে যেতে হবে!!! আমি নিঝুমকে ফোন দিলাম একটা অযৌক্তিক আশা নিয়ে, "যদি টিভির খবর ভুল হয়?", কিন্তু এই সব সংবাদ কোনোদিনও ভুল হয় না, নিঝুম ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করল... তোর মৃত্যুর পর শাহবাগে গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, পুলিশ বক্সে আগুন ধরানো হয়েছে, আজ সকালে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে; আমি কোনোটাতেই ছিলাম না। কাপুরুষ বলবি? বিশ্বাস কর, আমি যদি বিশ্বাস করতে পারতাম যে তুই মৃত তবে অবশ্যই আমি গাড়ি ভাঙায় থাকতাম, আমি অগ্নিসংযোগে থাকতাম, আমি মিছিলে থাকতাম। যারা আমাকে চেনে তারা জানে যে আমি আর যাই হই না কেন, কাপুরুষ না। কিন্তু আমি তো এখনো এটা মেনে নিতে পারছি না যে তুই মৃত।

আমার কাছে তো তুই জীবিত। আমার কাছে তো মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ক্যাম্পাসে তোর সাথে আমার দ্যাখা হয়ে যাবে, তুই হাসিমুখে জিজ্ঞাস করবি, "হেই ইরফান, কেমন আছিস?" একটু আগে ATN সংবাদের রিপোর্টে সাংবাদিক বলার চেষ্টা করছিলেন তোর মৃত্যুর প্রতিবাদে সকাল থেকে যে বিক্ষোভ হয়েছে তাতে নাকি "জনজীবনে অশেষ দুর্ভোগের সৃষ্টি" হয়েছে। তোর জীবন কি জনজীবনের বাইরের কিছু? নাকি তোর বিশ বছরের জীবনের চেয়ে তিন ঘন্টার জনজীবনের মূল্য বেশি? বাসযাত্রী এক "ভদ্রলোক" হাসতে হাসতে বলছিলেন যে তাকে প্রাইভেট চাকরি করতে হয়, এই ধরণের "তুচ্ছ"(তার ভাষায়) ঘটনায় রাস্তাঘাটে আটকে থাকলে তাকে বসের বকুনি খেতে হবে। জামান, আল্লাহ তোকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়ে এক অর্থে রক্ষা করেছেন এমন এক এনিমেল ফার্মে বাস করার হাত থেকে যেখানে বিশ বছরের একটা ছেলের মৃত্যু "তুচ্ছ" ঘটনা এবং "প্রাইভেট চাকরি করতে গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে যাওয়া" মহা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু আমাদের কি হবে, আমরা যারা বেঁচে আছি (আসলেই বেঁচে আছি? নাকি স্রেফ নিঃশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি আর মনে করছি নিঃশ্বাস নেওয়া মানেই বেঁচে থাকা!) এই মৃত্যুউপত্যকায়।

তুই সেলিব্রেটি হলে তোকে নিয়ে খুব হৈ চৈ হত, দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবিরা তোকে নিয়ে দিনের পর দিন পত্রিকায় কলাম লিখে যেতেন, প্রতিবছর তোর মৃত্যুতে আলোচনা সভা হত, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তৌহিদুজ্জামান তো কিশোরগঞ্জের এক সাধারণ ছেলে, যে গ্রেট এক্সপেকটেশনস নিয়ে পা রেখেছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে, অসাধারণ কিছু হয়ে ওঠার ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে, এবং যে এখন লাশ হয়ে ফিরে গেছে কিশোরগঞ্জে। তাই তোকে নিয়ে খুব কম মাতামাতি হবে। তবু আমি লিখছি তোকে নিয়ে, যে তোরই মত অতিসাধারণ এক ছেলে, যে অসাধারণ হতে চায় না, চায় সকলের জন্য এমন একটা সমাজ যেখানে প্রতিটি মানুষ মানুষের সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। যেখানে "সড়ক দুর্ঘটনা"-য় নিহত হতে হবে না তোর-আমার মত সাধারণ ও তারেক-মিশুকের মত অসাধারণ কোনো মানুষকেই।

যেখানে বালির বস্তার নিচে চাপা পড়ে মারা যেতে হবে না কোনো ঘুমন্ত গারমেন্টস শ্রমিককে, যেখানে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে হবে না সারা দেশের মানুষের ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য ফসল ফলানো কোনো কৃষককে... এমন একটা সমাজ যতদিন নির্মিত না হচ্ছে আমাদের সামষ্টিক প্রয়াসে, ততদিন তোর কাছে (এবং তোর মত লক্ষ লক্ষ মানুষ যাঁরা মারা গেছে ও যাচ্ছে শাসকশ্রেণীর হিংস্রতা/দায়িত্বজ্ঞানহীনতা/সাম্রাজ্যবাদের দালালি-র মানসিকতা ইত্যাদির শিকার হয়ে তাঁদের কাছে) আমরা অপরাধী হয়ে থাকব। ততদিন পর্যন্ত তোর কাছে রাখা প্রশ্নের উত্তর একটাই। "হ্যাঁ, জীবন এতই সস্তা..."  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.