আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপ্রত্যাশিত

খোঁড়াখুঁড়ি করায় রাস্তার বেহাল দশা। প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। চপ্পলের কল্যাণে প্যান্টের পেছনের অংশটার যাচ্ছেতাই অবস্থা। ছাতা দিয়ে শরীর ঢাকতে গেলে খবরের কাগজগুলো ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু শরীর ভিজলেও কাগজ বাঁচাতে হবে।

ভেজা কাগজ কেউ নিতে চায় না। লস্‌ হয়ে যায়। শরিফ একটা দোকানের সামনে ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে কাগজগুলো ভাঁজ করে কৌশলে বগলে চেপে হাঁটা শুরু করে। দশটার মধ্যে সব বিক্রি শেষ করতে হবে। এরপর বের হতে হবে আমড়ার ঝাঁকি নিয়ে।

দুপুর পর্যন্ত ফলের ফেরিওয়ালা। বিকেলে এখানে ওখানে বসে থাকা প্রেমিক জুটির কাছে ফুল বিক্রি। দুইটা লাল, তিনটা হলুদ গোলাপ আর কয়েকটা পাতাবাহারের পাতা একসাথে বেঁধে ফুলের তোড়া। শরীফের ছোটোবোন এগুলো খুব যত্ন করে বাঁধে। স্কুল থেকে এসেই লেগে পড়ে।

শরিফের মা শাহবাগ থেকে ফুলগুলো কিনে আনে। শরিফা ওগুলো সাজায়। সাজায় মানে সাজিয়ে দেয়। প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য রেডিমেড ভালোবাসা আরকি! হাতে তুলে দিলেই হলো। শরিফার সৌন্দর্যবোধ দেখে শরিফের খুব ভালো লাগে।

ক্লাস ফোরে উঠেছে এবার। শরিফের খুব ইচ্ছা অকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। অনেক লেখাপড়া শেখাবে। এই ইচ্ছার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। শরিফের পরিবারের ইতিহাস আজিমপুরের এই বস্তি থেকে বেড়ে ওঠেনি।

শরিফ তখন ছোটো। মা, বাবা আর দাদিসহ চারজনের পরিবার। গ্রামের বাড়িটা ওদের সুন্দর ছিলো। দুটো কুঁড়েঘর, একটা গোয়াল আর ছাপরা চালের রান্নাঘর। বাড়ির চারপাশে কতো গাছ! সারাদিন মাঠে দৌড়াদৌড়ি, সন্ধ্যা হলেই রাজ্যের ঘুম নিয়ে দাদির কোলে আত্মসমর্পণ; ভোর পর্যন্ত আর কিছু বলতে পারে না।

এমনই একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বেড়ালের কান্না শুনে শরিফ অবাক হয়ে যায়। ঘর থেকে বের হতেই দেখে দাওয়ায় বসা দাদির কোলে কাপড়ের পুঁটলিতে কি যেনো হাত-পা নাড়াচ্ছে। কাছে গিয়ে সে দেখে আস্ত একটা মানুষের বাচ্চা! শরিফের আশ্চর্যের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। মানুষ আর বেড়াল এক নাকি? এটা কোথায় পেলো, কিভাবে পেলো এইসব প্রশ্নে জর্জরিত দাদি যখন জানালো যে এটা তার বোন তখন তার আনন্দ আর কে দেখে! খেলাধুলা, পাড়ার বন্ধুরা সব বেমালুম। তারপর থেকে বোনকে নিয়েই শরিফের দিনরাত্রি।

শরিফা ধীরেধীরে বড়ো হচ্ছে, সবে মুখে বোল ফুটেছে। দাদ......দা করে। শরিফ ছুটে আসে। ওকেই বুঝি ডাকছে। ওর মতোই যেনো শরিফা ভাই পাগল।

দুজনের পাগলামিতে বড়োরা বেশ আনন্দ পায়। সুখি পরিবার। একদিন দুপুরের দিকে বাইরে হইচই শুনে শরিফাকে কোলে নিয়ে শরিফ কৌতূহলে বাইরে বের হয়। দেখে পুকুরের ঐদিকে একটা বড়ো জটলা। অনেক মানুষ।

পুকুরপাড়ের আমগাছটা ঘিরে সবাই অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে দুটো নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ভেসে আসছে। বড়োবড়ো লোকগুলোর জন্য শরিফ কিছু দেখতে পায় না। ভিড় ঠেলে সে ভেতরে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু পাশের বাড়ির মতির মা ওকে ঢুকতে দেয় না। শরিফাও ভয় পেয়ে কাঁদছে।

মতির মা শরিফাকে কোলে নিয়ে শরিফের হাত ধরে ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়। দুজনের হাতে দুটো বিচিকলা আর বাটিতে একবাটি মুড়ি খেতে দিয়ে আবার ঐ জটলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় মতির মা। শরিফ বুঝতে পারে না এতো সমাদর কিসের জন্য। সাইদুর মেম্বারের বউ তো আগে বাড়ির আশেপাশেই আসতে দিতো না, আজ হঠাৎ এতো খাতিরের কারণ শরিফের বোধগম্য হয় না। তবু মুড়ি কলা পেয়ে ও খুশি।

শরিফারও কান্না থেমে গেছে। বাইরের হৈহল্লাও কমে এসেছে। কি হলো? শরিফ বের হয়ে দেখে জটলাটা ওদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। শরিফ দৌড়াতে থাকে কিন্তু তার আগেই বাড়ির ভেতর সবাই ঢুকে পড়ে। শরিফ হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছায়।

শরিফা ভাইয়ের দৌড়ে মজা পেয়ে বেশ হাসছিলো। অনেক কষ্টে এবার সে ভেতরে যায়। কেমন একটা গন্ধও। ওর বাবা যেদিন ধানক্ষেতে ঔষধ ছিটাতো সেদিন এমন গন্ধ পাওয়া যেতো। আজ তো দেয়নি, তাহলে? শরিফ উঠোনের মাঝামাঝি যেতে মানুষের ফাঁক দিয়ে দেখে যে ওর মা উবু হয়ে বসে আছে আর একটা লোক মাটিতে চিৎ হয় শোয়া।

শরিফ আরও এগিয়ে যায়। এবার স্পষ্ট দেখতে পায়, ওর বাবা। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে, চোখ বন্ধও। ওর মা নির্বিকার। পড়শিরা ওকে আর এগুতে দেয় না।

তারপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। পুত্রশোকে শরিফের দাদি সেই যে বিছানা ধরলো আর ছাড়লো না। শরিফ, শরিফা আর ওর মা গিয়ে উঠলো মামার বাড়ি। কিন্তু সেখানেও ঠাঁই হলো না বেশিদিন। মামীর দুর্ব্যবহারে শরিফের মা দুসন্তানকে নিয়ে একদিন ঢাকায় পাড়ি দিলো।

এখানে এসে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সবশেষে ঠাঁই হলো আজিমপুর কবরস্থানের পাশের বস্তিতে। শরিফের মা মানুষের বাসায় কাজ করতো। কিন্তু তাতে হয় না। সংসার চালানোর জন্য অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের দায় পড়লো শরিফের কাঁধে। প্রথমে বাদাম বিক্রি তারপর পত্রিকার হকার।

তারপর শরিফা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করলো, চাহিদা আরও বেড়ে গেলো। শরিফকে উপার্জন বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত শ্রম দিতে হলো। অবশ্য এতে তার কোনো আপত্তি নেই। শরিফাকে লেখাপড়া শেখাতেই হবে। বাবার জন্য ওর খুব কষ্ট হয়।

বাবার মতো ওরা আর ঠকতে চায় না। বন্ধক দেয়া বাড়ির জমিটা সাইদুর মেম্বার অপকৌশলে নিরক্ষর বাবার কাছ থেকে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছিলো। কথা ছিলো ফসলি জমিটা থেকে ধান উঠলে বন্ধকের টাকা শোধ করে দেবে, আর কয়েকটা মাস এবাড়িতেই থাকবে। কিন্তু সরল, অশিক্ষিত মানুষ পেয়ে সাইদুর মেম্বার তার বাবাকে ঠকায়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে ওর বাবার গালে সাইদুর জুতো খুলে চড় মারে।

অপমানে, লজ্জায় ওর বাবা আত্মহত্যা করে। এসব কথা ও শোনে ঢাকায় আসার পর, বড়ো হয়ে। তখনই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, শরিফাকে লেখাপড়া করাবে। শিক্ষিত লোকদের কেউ সহজে ঠকাতে পারে না। বেলা বেড়ে চলেছে।

শরিফ দ্রুতপায়ে হাঁটে। এখনও সব পত্রিকা বিক্রি শেষ হয়নি। গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো তাই পত্রিকা অফিসও বন্ধ ছিলো। আজ পত্রিকা বিক্রির কাজটা নেই, সকালবেলাটা ফাঁকা। ফরিদ বললো, চল কোথাও ঘুইরা আহি।

শরিফ রাজি হলো। কোথাও তো যাওয়া হয় না অনেকদিন। তাই প্রতিবেশী বন্ধুর কথা ফেলতে পারলো না। তবে শরিফাকে সঙ্গে নেবে সে। তিনজনে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা মিরপুরের বাসে উঠলো, বোটানিক্যাল গার্ডেন যাবে।

শরিফা বসলো ড্রাইভারের বাঁদিকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে। শরিফ আর ফরিদ পেছনের দিকে। বাসটা কলাবাগান পৌঁছালে একজন মহিলা কোলে ছোটো একটা মেয়েকে নিয়ে ওদের ঠিক পেছনের সিটে জানালার পাশে বসলো। মহিলার হাতে, গলায় সোনার গয়না। আহা! এমন দুএকটা যদি শরিফারও থাকতো।

ওর তো আছে দুনম্বর সিটি গোল্ডের ইমিটেশন। হবে, একদিন হবে। ফরিদ শুনে একটু জোরেই হেসে উঠলো। শরিফ জানালা দিয়ে শহর দেখছিলো। কখন যে তন্দ্রা এসেছিলো বোঝেনি।

চিৎকার শুনে জেগে গেলো। পেছনের সিটের মহিলাটা চিৎকার করছে, চেন নিয়ে গ্যাছে, চেন নিয়ে গ্যাছে। শরিফ দেখে পাশে ফরিদ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ও দৌড়াচ্ছে, রাস্তার ওপাশে। নিশ্চয়ই জানালা দিয়ে টান মেরে নিয়ে গেছে।

হতবিহ্বল শরিফ উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় মহিলা বলে ওঠে- এও ছিলো, ঐ ব্যাটার সাথে এও ছিলো। বাসের দুএকজন যাত্রী সন্দিহান চোখে শরিফের দিকে এগিয়ে আসে। কিছু বলার আগেই দুমদাম কিল ঘুষি পড়তে থাকে। শরিফ চেঁচিয়ে বলে- আমি কিছু করি নাই।

কিন্তু কেউ শোনে না। শরিফ লুটিয়ে পড়ে। গোটাকয়েক মানুষ ওর ওপর উঠে লাফাতে থাকে। শরিফা কিছু বুঝতে পারেনি, ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে দাদ্‌.........দাআআআ......। (পরদিনের পত্রিকার খবর- গণপিটুনিতে পত্রিকার হকার নিহত।

নিজস্ব প্রতিবেদক লিখেছেন যে, পুলিশ বলছে ঘটনাটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতও, একটু ভুল বোঝাবুঝির কারণে ক্ষিপ্ত বাসযাত্রীরা এমন কাজ করেছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।