আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

:::সাইকেল পোস্টঃ ওরে নীল দরিয়া।:::

::::: দেখবো এবার জগতটাকে ::::: ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমি আর রুবেল ঢাকা থেকে বেরুলাম, ২জন মানুষ ৩টা পাইথন রক প্রো-বাই-সাইকেল। সাথে সাইকেল নেয়াটাও অনেক ঝক্কির। বাসওয়ালার দেখি খুব শৃঙ্খলাপরায়ন হয়ে গেছে, কিছুতেই বাসের ক্যারিয়ারে সাইকেল নিতে দেবেনা। অনেক দৌড়া দৌড়ি করে একটা মফিজ মার্কা গাড়িতে ডাবল টাকা দিয়ে রাজী করাতে হলো। কন্ডাক্টর জেমস বন্ড মার্কা চেহারা নিয়ে বললো, আমি ছাদে উঠতে পারবো না, শরীর খারাপ।

বাধা ছাদা যা করা লাগে আপনারাই করেন। অজ্ঞতা রুবেল নিজেই ছাঁদে উঠে চেইন দিয়ে সব বাঁধলো। রাতে রওনা দিয়েছি, আশা করেছি সকাল ৭টা ৮টার দিকে কক্সবাজার পৌছে যাব। সকাল ১০ টার দিকে জানালা দিয়ে উকি মেরে দেখি কেবল এসেছি কেরানীর হাট পর্যন্ত, বান্দারবানের বাস গুলো কেবল ঢুকছে ঐ পথে। তুমুল বৃষ্টিতে যখন আমরা কক্সবাজারে ঢুকছি ড্রাইভার জানালো ট্রাফিক রুলস অনুযায়ী সে কলাতলী যাবেনা।

কক্সবাজার লোকাল বাস স্ট্যান্ডেই নামতে হবে। সারা শরীরে বর্ষাতি জরিয়ে ব্যাগপোটরার পাশে সাইকেল ৩টা নামাতে নামাতে হুজুর আবু বকর হাজির। দাড়ি টুপিওয়ালা মাওলানা যতোটা সে তার চেয়ে বড় এডভেঞ্চারার। পাহাড়ে সঙ্গে করে বকর’কে নিলে অদ্ধেক চিন্তা দূর হয়ে যায়। খুব ফিট সাইক্লিস্ট, গত বছর হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সটাও করে নিয়েছে।

কক্স সাহেবের তৈরি বাজারের কলাতলীতে ঢুকতে হলো বেশ ভালো সাইজের দুটো টিলা পার হতে হবে। বাসে করে কলাতলীতে ঢোকার সময় এটাই কক্সবাজারের দারুন আকর্ষন। অনেক দূর থেকে আচমকা সাগর চোখের সামনে চলে আসে। কিন্তু সাইকেলের প্যাডেল মেরে এই পাহাড়ে উঠতে গেলে খবর হয়ে যাবে। পায়ে প্রচন্ড চাপ পড়ায় গিয়ার নামাতে গিয়ে দেখি বাসের ঝাকুনিত গিয়ারের পিক আপ ভেঙ্গে গেছে।

কিছুতেই ৭ গিয়ারের নিচে নামেনা। হাত দিয়ে ধস্তা ধস্তি করে ৩এ নামিয়ে প্যাডেল মারতেই সে লাফ দিয়ে আবার ৭ এ ফিরে আসে। আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে চোখ খুলে রাখাও কঠিন। দৈত্যের মতো ঢাকা-কক্সবাজার রুটের বাস গুলো আচমকা পাশে এসে হর্ণ দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলে। এই বাস গুলোকে আমি জমের মতো ভয় পাই।

হাইওয়ে সাইকেল চালাতে দেখলেই তারা যেন ক্ষেপে ওঠে। গত বছরেই সোহাগের একটা ভলভো সাভার স্মৃতি সৌধের কাছে ধাক্কা মেরে আমার এবং আমার সাইকেল দুটোকেই আক্ষরিক অর্থে খোড়া করে দিয়েছিল। যাত্রা শুরু হলো। মেরিন ড্রাইভে রুবেল এবং আবু বকর। হিমছড়ির ওদিকে কোথাও আবু বকর তার বন্ধুদের সাথে খাগড়াছড়ি ঘুরে কক্সবাজারে এসেছিল।

আমরা তাকে ফোন করে থেকে যেতে বলি। ৩জন মিলে সাইকেল ট্রিপ হবে। আবু বকরের হোটেলে ঢুকে ভিজে কাপড় চেঞ্জ করে গেলাম খেতে। পৌষি হোটেলের কোরাল মাছের ভর্তা লোভে পড়ে এত বেশী খেয়ে ফেললাম যে দেখি নড়তেই পারি না। সাইকেল চালাবো কিভাবে।

এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল নামছে। বক্কর বললো, চিন্তা নাই, প্যাডেল মারা তো শুরু করি। যেখানে রাইত হবে সেখানেই কাইত হবো। বিকাল ৪টার দিকে আমরা শুরু করলাম। তার আগে অবশ্য একটা দোকান থেকে সবগুলো সাইকেলের চাকায় ভালো মতো হাওয়া আর তেল দিয়ে নিলাম।

কলাতলীর মোড়ে হাঙ্গরের বড় যেই ভাষ্কর্যটা আছে, সেটার তলা থেকে ছবি টবি তুলে অফিশিয়াল যাত্রা শুরু হলো। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। সরাসরি মেরিন ড্রাইভে উঠে গেলাম। বামে হিমছড়ির পাহাড়ের সারী আর ডানে উদার বঙ্গোপসাগর, আবহাওয়ার কারনে কিছুটা উত্তাল। এটা আমি।

ছবি তুলেছে রুবেল। খুব দ্রুতই প্যাডেল মারতে মারতে হিমছড়ি পৌছে গেলাম। হিমছড়িতে সবাই বীচের পারে একটা দোকানে ঢুকে একটার পরে একটা ডাব শেষ করতে লাগলাম। আমার গিয়ার গুলো কাজ করছিলো না। বার বার ৭ নাম্বারে উঠে যাচ্ছে, লম্বা রুটে চালাতে বেশ কষ্ট হয়।

আবু বক্করের কাছে যন্ত্রপাতি ছিল। সে গিয়ারের তারটা কেটে মুচড়ে শ্যাফটের সাথে কই যেন বেধে দিল। এবার সেটা পার্মানেন্টলি ৬ নাম্বারের কাটায়। মোটামুটি স্পিডে আরামে চালাতে পারবো। সমস্যা একটাই কোন উচু ব্রীজে উঠতে কিংবা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উপরে উঠতে গেলে প্রচন্ড চাপ দিতে হবে পায়ে।

হিমছড়িতে সামান্য বিরতী নিয়ে রওনা হলাম আবার। দেখতে দেখতে পাহাড়ি রাস্তায় চলে এলাম। অসাধারন পথ। পাহাড়ের সারীর গা ছুয়ে সৈকতের পথে। দুধারে বড় বড় গাছ।

একটু পরে পরে ইস্পাতের ব্রীজের উপর দিয়ে ছুটে চলা। স্বর্গীয় পথ একটা। ইনানী পর্যন্ত হোটেল আর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। ইনানী পৌছে দেখি সূর্যাস্তের তখনো অনেক দেরী আছে। এদিকে রাস্তায় কোথায় রাত হবে কি সমাচার, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

ইনানী’তে কয়েকটা হোটেল আছে। ওগুলোতে খোঁজ করলাম। ওদের রুম ট্যারিফ দেখি ফাইভ স্টার স্টাইলে। ধুর চাই বলে আবার পথে নামলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম রাত হলে সাগর সৈকতেই ক্যাম্পিং হবে।

ইনানীর পরে কয়েকটা গ্রাম আছে। ওগুলো পেরুলে বসতী গুলো অনেকক্ষন পর পর। সৈকতের গা ঘেষে অবশ্য কিছু নেই। কিছুক্ষন পর জেলেদের গ্রাম গুলোও আর চোখে পড়ছে না। কিন্তু চারদিকের দৃশ্যপট চোখ ধাঁধানো সুন্দর হয়ে উঠলো।

কক্সবাজারের পরিবেশ দুষন আর মানুষের হৈ হট্টগোল নেই। চারদিক নিরব নির্জন। সাগরের পানি এদিকে ময়লা কালো নয়, বরং স্ফটিক নীল। সরকার নাকি ঘোষনা করেছে শীলখালী বীচ’কে ফরেনার জোন করবে। এই বীচটা অনেক বৈচিত্রময়।

এখানে রাত হয়ে গেছিলো। রুপালী হাঙ্গর, একটু আগেই ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। হঠাত পথের পাশে একটা মসজিদ পড়লো। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। বকর ঢুকলো নামায পড়তে।

অরন্য ঘেরা একটা জনপদ। চারদিকে বড় বড় কড়ই, গর্জন আর রেন্ট্রি গাছ, গাছ ভর্তি পরগাছার দল। পাহাড়ের ভেতরে বনটা ঘন। ঘরে ফিরতে ব্যাস্ত পাখি আর নানা রকম পোকামাকরের গান। মাগরিবের নামাযের পড়ে আরো আরো অনেকক্ষন ঝাপসা আলো থাকে।

আমরা চালিয়ে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিলাম। মেঘলা দিন বলে হয়তো আলো বেশীক্ষন থাকলো না। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এদিকে ভাঙ্গাচোরা রাস্তার অবস্থাও বেশ করুন। এদিকে আগে জেলেদের গ্রাম ছিল।

কিন্তু শীলখালীকে ফরেনার জোন ঘোষনা করায় হোটেল ওয়ালারা বীচ লাগোয়া জায়গা গুলো ধমাধম কিনে নিয়েছে। চারদিকে এস-আলম/ ইউনিক গ্রুপ হরেক রকমের সাইনবোর্ড, জায়গা গুলো বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরাও দেয়া। গ্রামটা চলে গেছে পাহাড়ের উপরে। এরকম একটা গ্রামের নাম বাইল্যাখালি। অন্ধকার আর বৃষ্টির কারনে যখন আর এগুনো সম্ভব না, তখন চোখে পড়লো একটা প্রাসাদ টাইপের বাংলো।

কেয়ারটেকার জানালো প্রতিটা রুমে তালা দিয়ে মালিক চলে গেছে চিটাগাং। তবে সামনে বীচ লাগোয়া চালওয়ালা একটা উঠোনে সে ক্যাম্পিং এর ব্যাবস্থা করতে পারবে। চারদিকে খোলা, হু হু করে সাগরের হাওয়া আসে। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই ক্যাম্প করা হলো। সর্ব কাজের কাজী আবু বকর তক্ষুনি ছুটলো গ্রামের দিকে সাগরের মাছ টাছ পাওয়া যায় কি না।

শার্ক। হ্যামারহেড শার্ক, স্থানীয়রা বলে হাতুরী মাথা। হাঙ্গরের পাখনা এবং শুটকী মাছের বাজারে হট-কেক আমরা খেয়ে দেয়ে রাতে মরার মতো ঘুমিয়ে গেছি। সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। আবার পথে নামতে না নামতেই বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল।

কিছুক্ষন পরে একটা ছোট্ট বাজার চোখে পড়লো। এর পরে একটা ভাঙ্গা ব্রীজ। পুরো এলাকাটার রাস্তাই কাঁচা। এদিক দিয়ে সোজা সামান্য এগুলেই মস্ত বড় গ্রাম্য বাজার- শিলখালী বাজার। এখানে একটা দোকানে ঢুকে গরম গরম জ্বিলাপী আর বনরুটি পাওয়া গেল।

খুঁজে পেতে ফ্রিজের ঠান্ডা পানিরও খোঁজ মিললো। এখানে আমরা সময় বেশী নিয়ে নিলাম, ব্রেক ফাস্টের জন্যে। মেঘলা দিন। পথে নামতে না নামতেই আবার ঝুম বৃষ্টি। কিছু দূর পরেই শিলখালী রিজার্ভ ফরেস্ট।

সৈকত চোখের আড়ালে চলে গেলো। অসাধারন সুন্দর একটা বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা। টেলি লেন্স ব্যাকপ্যাকেই ছিলো। অন্য সময় হলে পাখির ডাক শুনে ধাওয়া করতাম। কিন্তু এখন সেই আগ্রহ নেই।

কাঁচা রাস্তা ধরে আমরা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝরের গতীতে প্যাডেল মারতে লাগলাম। হঠাত লোকালয় ঘন হতে শুরু করলে বুঝলাম। আমরা টেকনাফে এসে পৌছেছি। টেকনাফের মুল শহরে ঢুকে একটা হোটেলে গোসল আর খাওয়া দাওয়া শেরে চলে এলাম বাংলাদেশ ভু-খন্ডের শেষ বিন্দু শাহ-পরীর দ্বীপে। সেখান থেকে মাথিনের কুপের কয়েকটা ছবি টবি তুলে বাসে চেপে ঢাকার পথ ধরলাম।

নাফ নদী। সীমান্তের ওপারের কালচে পাহাড় গুলো রাখাইন স্টেট। টেকনাফে এসে হাজির। শাহ-পরী দ্বীপের জেটি। বাংলাদেশ ভু-খন্ডের সর্বশেষ বিন্দু।

শাহ-পরী দ্বীপে মাঞ্জা মারছে রুবেল। বৃষ্টিস্নাত নাফ নদী। বৃষ্টিস্নাত নাফ নদী। দূরে কালচে সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের তটরেখা। গাংচিল (Little Tern) শাহপরীর দ্বীপের লবন খামার।

রাজ কন্যা মাথিনের বয় ফ্রেন্ড ধীরাজ ভট্টাচার্য। উনি নাকি কলকাতার সিনেমাতে নায়কের চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। আমার কাছে একটুও হ্যান্ডসাম লাগলো না। কলকাতার সুবেশী বাবু ধীরাজ ভট্টাচার্য টেকনাফ থানার পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। থানার পাশে কুয়োতে সখীদের সাথে জলকেলীতে আসতো রাখাইন রাজকন্যা মাথিন।

মাথিন'কে দেখে ধীরাজের-'নেশা লাগিলোরে, বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগিলোরে'। রাখাইন রাজ বাঙ্গালীর সাথে বিয়েতে রাজী ছিলো না। ধীরাজ তাকেও কনভিন্স করলো। এসময় বাবার অসুস্থতার জরুরী টেলিগ্রাম পেয়ে ধীরাজ কলকাতায় ফিরলেন। টেকনাফে ফিরতে পারলেন না অনেক দিন।

যখন ফিরলেন তখন জানলেন বন্ধুয়া বিরহে মাথিন মারা গেছে। মাথিন আর ধীরাজের প্রেম কাহিনী শুরু হয় এই কুয়োর পার থেকে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.