আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তুমিই আমার পাপা

তুমিই আমার পাপা গৌতম দাস ১ এস এম এস আসার বিপ্ বিপ্ শব্দে মিতুলের ঘুমটা ভেঙে যায়, মাথার কাছে রাখা মোবাইলটা টেনে নিয়ে সে ইন বক্স খুলে দেখে, দুটো মেসেজ এসেছে। একটা অলীক পাঠিয়েছে একটা, আর একটা মহিমা। অলীকের মেসেজটাই মিতুল প্রথমে খুলে দেখে। “হৃদি ভেসে গেছে অলকানন্দার জলে - গুড-মর্নিং এন্ড উইশ ইউ এ গুড ডে, মিত। “ মেসেজটা পড়ে মিতুল মনে-মনে হাসতে থাকে।

ডাম্বোটা দেখছি সেদিনের কথাগুলি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে! অলীকও তার মত এবারের টুয়েলভ পাস-আউট। কিছু দিনের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ও চেন্নাই চলে যাচ্ছে। কি কথা প্রসঙ্গে যেন সেদিন অলীকই কথাটা তুলেছিল। দেখ মিত, আফটার অল, উই আর বং, সো উই মাস্ট লার্ন বেঙ্গলী। কোলকাতায় মিতুল যতদিন ছিল, ততদিন সে পাড়ার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তো।

তারপর যেবার সে ক্লাস ফাইভে উঠল সেবারই বাবা-মায়ের হাত ধরে তাকে চলে আসতে হয়েছিল দিল্লি। আর অলীকের তো জন্ম আর বেড়ে ওঠা, দুটোই এই দিল্লি শহরে। তাই ছোটবেলা থেকেই অলীক বা মিতুলের পড়াশোনা এবং দৈনন্দিন জীবনে বাংলার থেকে হিংলিশেরই (হিন্দি + ইংলিশ) চল বেশী। ডাম্বো, আর ইউ সিরিয়াস? আই মিন, তুই কি রিয়েলি বাংলা শিখতে চাস? তাহলে এক কাজ কর, বাড়ি গিয়ে আঙ্কলকে বল তোকে ঐ বইটা কিনে দিতে। কোন বইটা রে মিত? অলীকের গলায় কৌতূহল।

আরে ঐ বইটা, কি যেন নাম? মিতুল চোখ বন্ধ করে বইটার নাম মনে করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। মাই ফুট! কিছুতেই তো বইটার নাম মনে পড়ছে না। বাট আই ক্যান টেল ইউ দ্য নেম অফ দ্য রাইটার, হি ইজ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ওয়ান সেক, মাকে ফোন করে বইটার নাম তোকে এখুনি বলে দিচ্ছি। তপতী অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন যখন মিতুল তাকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখা ঐ বইটার নাম জিজ্ঞাসা করে।

কি ব্যাপার রে মিতুল? তুই কি কোনও কুইজ কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করছিস নাকি? না না মামা। নো কুইজ কম্পিটিশন। আসলে কি হয়েছে জানো, অলীকের মাথায় কোথা থেকে যেন বাংলা শেখার ভুত ঢুকেছে! সো আই আস্কড হিম টু স্টার্ট উইথ দ্যট বুক। ওকে মামা, বাই। ফোনটা ডিস-কানেক্ট করে মিতুল অলীকের দিকে ফিরে বলেছিল, ডাম্বো দ্য নেম অফ দ্যট বুক ইজ বর্ণ-পরিচয়।

বাট আই হ্যভ অ্যা ডাউট, দিল্লিতে কি ঐ বইটা পাওয়া যাবে? দ্যটস নট অ্যা প্রবলেম ইয়ার। দিল্লিতে না পাই, কোলকাতা থেকে আনিয়ে নেব। কাকুকে বললে উনি ঠিক কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেবেন। বাই দ্য ওয়ে, কি আছে রে বইটায়? অলীক যখন শোনে যে সে বাংলা অ্যালফাবেট শিখবে তখন বলে উঠেছিল না রে মিত, ও ভাবে হবে না। ঐ সব অ-আ-ক-খ লেখা শিখে আমি এখন কি করব? আর আমাকে ও সব শেখাবেও বা কে? যতদিন দিল্লিতে আছি ততদিন না হয় ড্যাড বা মাম আছে টু গাইড মি।

বাট আফটার ফিউ ডেজ, হোয়েন আই শ্যাল বি ইন চেন্নাই, দেন হু উইল টিচ মি অল দিজ? তার চেয়ে এক কাজ করি, তুই আর আমি এখন থেকে যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলব তখন লেট’স স্পিক ইন বেঙ্গলি ওনলি। অলীকের কথা শুনে মিতুল হাসতে হাসতে বলে উঠেছিল ডাম্বো লেট’স স্পিক ইন বলে তুই যদি বাংলায় কথা বলা চালু করতে চাস তাহলে দেখবি কোনোদিনই আর আমাদের বাংলায় কথা বলা হবে না। যাই হোক সেদিনের পর থেকে অলীক কিন্তু যখনই তার সঙ্গে কথা বলছে সে বাংলাতেই কথা বলছে। আর শুধু বাংলাতেই কথা বলা না, মাঝে-মাঝেই এ ধরনের টেক্সটও পাঠাচ্ছে তাকে। “হৃদি ভেসে গেছে অলকানন্দার জলে” লাইনটা মিতুলের যেন খুব শোনা-শোনা লাগছে।

ইয়াপ, মনে পরেছে, কিছুদিন আগে মা যে বাংলা মুভিটা দেখছিল সেখানেই এই লাইনটা একজন কেউ রিসাইট করছিলেন। তার মানে ডাম্বোটা আজকাল বাড়িতে বসে বাংলা মুভিও দেখছে! মিতুল একটা টেক্সট পাঠিয়ে দেয়। “তোকেও সুপ্রভাত জানাই। আর লাইনটা কিন্তু হেব্বি কোট করেছিস। বাই দ্য ওয়ে, লাইনটার মানে কি রে?” মিতুলের দৃঢ় বিশ্বাস ডাম্বো নিজেও সম্ভবত জানে না, মানে-টা।

অলীককে মেসেজটা পাঠিয়ে মিতুল দ্বিতীয় মেসেজটা খুলে দেখে। ওঃ মাই গড! কাল মাঝ রাতে নিফটের এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়ে গিয়েছে। এক লাফে সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে, আর চিল্লিয়ে বলে ওঠে পা, শিগগিরি ল্যাপিটা অন করো তো, রেজাল্ট ইজ আউট। ২ সকালে টয়লেটে আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে অলোক যখন প্রতিদিন এই কাজটা করে তখন তার মনে হয় পৃথিবীতে এর চেয়ে কঠিন আর কোনও কাজ নেই। এমন কি সে যে দিন-ভর অফিসে বড় বড় বাড়ির নকশা বানায় সেই কাজটাও এর তুলনায় মনে হয় অনেক সহজ।

কিছুতেই সে আর তার ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়িটাকে সোজা করে শেপ করতে পারে না। আর তার এই প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখে তপতী মাঝে-মাঝে তাকে কথার হুল ফোটাতেও ছাড়ে না। শুনেছি তো বাপু তোমাদের অফিসে কোনও মহিলা নেই, তাহলে কার জন্য বলো তো রোজ রোজ সকালে এই চার গাছা দাড়ি নিয়ে এত মেহনত করো? মিতুল অত জোড়ে পা বলে ডেকে ওঠাতে অলোকের হাতটা কেপে ওঠে। ইস্ আজও দাড়ির দফা-রফা! তা, দাড়ির যা হওয়ার তা না হয় পরে দেখা যাবে, কিন্তু মেয়েটার হলো কি? এই সাত-সকালে এরকম চিল্লা-মিল্লি করছে কেন? আয়না দিয়ে দাড়িটার দিকে একবার করুণ দৃষ্টি বুলিয়ে অলোক টয়লেট থেকেই চিল্লিয়ে ওঠে, কি হয়েছে রে মিতু? নিফটের রেজাল্ট বেড়িয়েছে নাকি? ইয়েস পা। মহিমা মেসেজ করেছে।

কাল মাঝ রাতেই লিস্ট আউট হয়ে গিয়েছে। অলোকের জন্য ওয়েট না করে মিতুল ততক্ষণে ল্যাপটপটা অন করে ফেলেছিল। পা, আমি সাইটটা খুলছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসে রেজাল্টটা দেখে দাও। মিতুলের এটা একটা সংস্কার।

নিজে সে কখনও তার রেজাল্ট দেখে না। অলোককেই তার রেজাল্ট দেখে দিতে হয়। মেয়ের অন্ধ বিশ্বাস যে বাবা রেজাল্ট দেখলে তার রেজাল্ট নাকি বেটার হয়। বাপ-মেয়ের চিল্লাচিল্লিতে তপতীও ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিল। কি হয়েছে রে মিতুল? নিফটের রেজাল্ট বেড়িয়েছে? মিতুল ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে তপতী ঠাকুরের আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আর সেখানে রাখা কমসে কম দশ রকমের ঠাকুরের ছবির সামনে হাত জোড় করে বলতে থাকে, ঠাকুর, আমাদের মিতুলটা যেন চান্স পেয়ে যায়। ৩ মিতুলের এবার থার্ড ইয়ার। প্রথম চারটে সেমিস্টারে সে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। আর তাই এ-বছরের কলেজ স্পনসরড ফরেন ট্রিপে তার নাম সিলেক্টেড হয়েছে। বাড়িতে এসে ফরেন ট্রিপটার ব্যাপারে বাবা-মাকে মিতুল জানালে দুজনেই খুব খুশী।

পা তো বলেই ফেলে, মিতু এটা কিন্তু তোর জীবনের খুব বড় একটা স্টেপিং এন্ড ইউ মাস্ট এক্সপ্লোর ইট টু দ্য বেস্ট পসিবল এক্সটেন্ট। ছোট বেলা থেকেই মিতুল দেখে এসেছে যে বাবা-মা তার ছোট-ছোট সাফল্যেও হই-চই করে সারা বাড়ি একেবারে মাথায় করে তোলে। কিন্তু বিদেশ যাওয়া, তা-ও আবার বাড়ির লোক ছাড়া! মায়ের সম্মতির ব্যাপারে তাই মিতুলের মনে একটু খটকা ছিল। কিন্তু তাকে অবাক করে তপতীও কিন্তু এক বাক্যে তার বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে তার সায় দিয়ে দিয়েছিল। মা-বাবা ছাড়া আরও একজন খুব খুশী।

এ-বছরই রঙ্গন পাশ আউট করেছে তাদের কলেজ থেকে। আর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে একটা বড় টেক্সটাইল কোম্পানিতে ডিজাইনারের চাকরিও পেয়ে গিয়েছে। কলেজ শুরুর প্রথম দিকে যেদিন রঙ্গনের সঙ্গে তার প্রথম ক্যান্টিনে আলাপ হয়েছিল সেই দিন থেকেই কিন্তু মিতুলের মনের মধ্যে একটা কেমন যেন উথাল-পাথাল শুরু হয়ে গিয়েছিল। আসলে রঙ্গনের ওভার-অল লুকটাই অদ্ভুত এবং সেটা কেমন যেন মনের মধ্যে আবেশ ছড়িয়ে যায়। সম বয়সী হাজারো ছেলের ভিড়ের মাঝেও তাই ওর ওই লুকটা ওকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।

ছিপ ছিপে লম্বা। মাথায় এক রাশ কালো এলো-মেলো চুল। পড়নে সব সময় রঙ চটা জিনসের উপর ডার্ক কালারের লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবী। গালে না কাটা দাড়ির একটা হালকা রেশ। গভীর অথচ মায়াবী দুটো চোখ।

সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক বাউণ্ডুলে পানা আঁকা রঙ্গনের চেহারায়। আর ঐ বাউণ্ডুলে পানাটার দুর্নিবার আকর্ষণ মিতুল আলাপ হওয়ার পর কিছুতেই আর অস্বীকার করতে পারেনি। ৪ তাদের বিয়ের আর দিন পনেরর মতো বাকী। মিতুলদের বাড়িতে তো বটেই, রঙ্গনদের বাড়িতেও পুরো-দমে বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। রঙ্গনের বাবা এই কালই দিল্লিতে তিন দিন কাটিয়ে আবার কোলকাতায় ফিরে গেলেন।

ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে পরামর্শ তো ছিলই, তা ছাড়াও মিতুলের বাবা-মায়ের সঙ্গেও ওনার কিছু আলাপ-আলোচনা ছিল। মিতুলের হবু শাশুড়িরও আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহুর্তে বাতের ব্যথায় উনি কাবু হয়ে পড়ায় আর আসতে পারেননি। মিতুলদের বাড়িতে উৎসবের রেশটা অবশ্য সেই মাস-খানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। বিয়ের দিন ফিক্সড হওয়ার পর থেকেই পা রোজ একটা রুল টানা খাতায় সম্ভাব্য সব কাজের নতুন-নতুন লিস্ট বানিয়ে ফেলছে। আর সন্ধ্যা বেলায় অফিস থেকে ফিরে মাকে নিয়ে বসে যাচ্ছে ঐ খাতাটা খুলে।

আর এই সবের মাঝে আজকাল মিতুলের মনটা মাঝে-মাঝে কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। এত দিনের প্রেমের সার্থক পরিণতি বা রঙ্গনকে একান্ত করে পাওয়া এসবের মাঝেও যখন মনে পরে এই বাড়ি বা বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা তখন মিতুলের মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। বিশেষ করে পা-কে ছেড়ে থাকবার কথাটা মনে পরলেই মিতুলের দুচোখের কোনা জলে ভরে আসে। ছোটবেলা থেকেই পা তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তার কাছে সে কোনোদিন কিছু লুকোয়-নি।

তার সব গোপন কথা নির্দ্বিধায় সে পায়ের সঙ্গে শেয়ার করেছে। স্কুল বাঙ্ক করে দিল্লি হাঁটে ঘুরে বেড়ানো, স্কুলে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে বাড়ি না ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়া, লাইব্রেরীতে তাকে রঙ্গনের প্রপোজ করা, রঙ্গনের সঙ্গে ঝগড়া, দিনের শেষে কোনও কিছুই অলোকের অজানা থাকত না। মিতুল তাকে যেন সব কিছু না বলে নিজের মনে শান্তি পেত না। ৫ সাউথ দিল্লির চাইনিজ রেস্টুরেন্টটায় এখন মিতুল রঙ্গনের মুখোমুখি। সিলিংয়ের আড়াল থেকে ভেসে আসা হালকা আলোর শেডগুলি রেস্টুরেন্টের মধ্যে কেমন যেন আলো-আঁধারীর সৃষ্টি করেছে।

তাদের টেবিলটা কোনের দিকে, অন্ধকারটা এখানে যেন একটু বেশীই। অন্য দিন হলে এতক্ষণে মিতুল টেবিল চেঞ্জ করার জন্য বয়কে বলত। আজ কিন্তু মিতুলের মনে হচ্ছে মাঝের এই অন্ধকারটা তাকে হয়তো বা সাহায্য করবে রঙ্গনকে ঐ কথাগুলি বলবার সময়। বয় এসে ডিনার সার্ভ করে দিয়ে গেলে মিতুল টেবিলে রাখা রঙ্গনের একটা হাত তুলে নেয়। রঙ্গন, আই ওয়ান্ট টু টেল ইউ সাম থিং।

ভাবছ হয়তো যে এতদিন বাদে আজ আবার নতুন করে কি জানানোর আছে। বাট বিলিভ মি, আমার নিজের সম্পর্কে এই কথাগুলি আমি নিজেও কাল অবধি জানতাম না। একটানা কথা বলে মিতুল একটু থামে। আর তারপরে রঙ্গনের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে, রঙ্গন, কালই আমি পা-য়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে এতদিন ধরে নিজের যে পরিচয়টা আমি ক্যারি করছিলাম, সেটা সত্যি নয়। আর সেটা জানবার পর আমার মনে হলো ইউ শ্যুড অলসো নো ইট, ইউ শ্যুড অলসো নো যে আমি আসলে কে? আর সেই কথা জানার পর তুমি কিন্তু স্বচ্ছন্দে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা নতুন করে ভেবে দেখতে পারো।

আমি কখনোই চাইব না যে কোনো দাঁয় বদ্ধতা তোমাকে বাধ্য করুক সম্পর্কটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কথাগুলি বলতে বলতে মিতুলের গলাটা অবরুদ্ধ কান্নায় বুজে আসে। রঙ্গন যেন অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক, মিতুলের হাতটা ছাড়িয়ে তাদের দুজনার প্লেটে খাওয়ার সার্ভ করতে করতে সে স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে, ওকে, মিতুল তোমার কথা আমি পরে শুনছি, তার আগে তুমি আমার একটা কথা শোনো। আসলে কি জানো মিতুল, আমার মনে হয় যে কথাটা তুমি বলবে বলে আজ আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে এসেছ আমি সেই কথাটা জানি। আর কথাটা শুধু আমিই না, আমার বাবা-মাও জানেন।

মিতুলের অবাক হওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে রঙ্গন বলতে থাকে, আরে পাগলী, তুমিই তো বলো যে তোমার পা-কে নাকি তোমার থেকে বেশী কেউ আর চেনে না? তাহলে তুমি কি করে ভাবলে যে ঐ রকম একটা মানুষ সব সত্যকে লুকিয়ে রেখে তোমাকে আমাদের বাড়িতে ঘর করতে পাঠাবেন? মিতুলের দু-চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা মুছিয়ে দিতে দিতে রঙ্গন বলতে থাকে কেঁদো না মিতা। দেখ, জন্মগত ভাবে আমরা কি পরিচয় নিয়ে এই পৃথিবীতে আসব তা আমাদের হাতে থাকে না। আর তাই জন্মগত পরিচয়টাকে আমি খুব একটা গুরুত্বও দেই না। আমার কাছে মানুষের আসল পরিচয় তার কাজ আর তার ব্যবহার। আর এই শিক্ষাটা আমি আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি।

তাই যেদিন তোমার পা আমাদের কোলকাতার বাড়িতে এসে বাবা-মাকে সব ঘটনা জানিয়ে বলেছিলেন যে তুমি ওনার ঔরসজাত সন্তান নও সেদিন কিন্তু আমার বাবা-মায়ের মনে তোমার বা তোমার পায়ের সম্পর্কে কোনও বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়নি। বরঞ্চ আমাদের সবার মনে ঐ মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। ভাবো তো কি অসামান্য একজন মানুষকে তুমি তোমার জীবনে পেয়েছ যিনি এক মুহুর্ত্তের জন্যও দ্বিধা করেননি বন্ধুর সব কৃত কর্মের দাঁয় নিজের উপরে তুলে নিতে যাতে তুমি এই পৃথিবীর আলো দেখতে পাও, যাতে তোমার মা সারা জীবন সমাজের চোখে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। মিতুল, হতে পারে তিনি তোমার জন্মদাতা পিতা নন, কিন্তু আমার কাছে তিনিই তোমার আসল বাবা। আর শুধু তাই নয়, ঘটনাটা জানার পর থেকে আমার চোখেই শুধু নয়, আমার বাবা-মায়ের চোখেও উনি কিন্তু আগের থেকেও অনেক বেশী সম্মানীয় হয়ে উঠেছেন।

৬ কিছুটা পা-য়ের মুখে শোনা আর কিছুটা কাল সারা রাত ধরে পা-য়ের দেওয়া ডাইরির পাতাগুলি পড়ে জানা। মাষ্টার ডিগ্রী করার সময় কলেজে তপতীর যেবার ফাইনাল ইয়ার ছিল সেই বছরই ছ-মাসের ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে তাদের কলেজে পড়াতে এসেছিলেন প্রফেসার সুধাংশু রায়। হাসি-খুশী প্রাণোচ্ছল অল্প বয়স্ক এই প্রফেসরটি কিন্তু অতি অল্প সময়েই ছাত্র-ছাত্রী মহলে বেশ সোর-গোল ফেলে দিয়েছিলেন। স্পেশালই ছাত্রী মহলে তার টল-ডার্ক-হ্যান্ড-সাম চেহারা নিয়ে আলোচনার অন্ত ছিল না। অন্য সবার মতো তপতীও সেদিন ভেসে গিয়েছিল সুধাংশুর সেই চেহারার এবং ব্যক্তিত্বের মাদকতায়।

কলেজ শেষে তাই তাদের দেখা-সাক্ষাত হতে শুরু হয়েছিল বিভিন্ন পার্কে বা রেস্টুরেন্টের পর্দা ঢাকা কেবিনে। আর সেই দেখা সাক্ষাতের এক-এক দিনে সুধাংশুর সঙ্গে এসে উদয় হতো অলোক মানে সুধাংশুর বন্ধু। প্রায় রবিবারই তখন তপতী বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে সুধাংশুর সঙ্গে চলে যেত আউ-টিংয়ে। সারা দিনের জন্য তারা হারিয়ে যেত শহর ছেড়ে অনেক দূরে - ছোট্ট কোনও গ্রামের মাটিতে। আবার কখনও বা নাম না জানা কোনও নদীর পাড়ে।

এরকমই এক হারিয়ে যাওয়ার দিনে সুধাংশুর এক বন্ধুর খালি বাগান বাড়িতে তপতী নিজেকে সমর্পণ করেছিল। ঘটনাটার মাস দুয়েকের বাদে তপতী একদিন বোঝে যে সে অন্তঃসত্ত্বা। ততদিনে অবশ্য সুধাংশুর কলেজে পড়ানোর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রেগনেন্সীর ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে তপতী সেদিন ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছিল সুধাংশুকে লেক মার্কেটের সেই কফি-শপটায়। কফি পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে সব কিছু জানিয়ে তপতী সুধাংশুর মুখের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল এবার কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একবার তুমি আমার বড়দার সঙ্গে কথা বলো যাতে উনি তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাদের বিয়ের কথাটা বলতে পারেন।

কফি-শপ থেকে বেড়িয়ে তারা যখন ফুট-পাথ ধরে হাঁটছিল, ফুটপাথের পাতা চৌকো-চৌকো সিমেন্টের স্লাব গুলির দিকে তাকিয়ে সুধাংশু বলে উঠেছিল তপতী আমি যা বলছি তা শুধু আমার একার ভালোর জন্য নয়, একটু মন দিয়ে কথাগুলো শোনো, দেখবে এতে আমাদের দুজনারই ভালো হবে। অহেতুক ইমোশনাল হয়ে লাভ নেই। লেট’স বি মোর প্রাকটিক্যাল। একটু থেমে সিগারেট ধরিয়ে সুধাংশু তারপর বলে উঠেছিল তপতী আমার কি মনে হয় জানো, এই মুহুর্তে আমাদের পক্ষে বাচ্চাটার জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। তুমি বরঞ্চ বাচ্চাটা অ্যাবরশন করিয়ে নাও।

তপতীর মৌনতায় সুধাংশু যেন নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল সেদিন। গলায় খানিকটা গাম্ভীর্য এনে সে ফের বলে উঠেছিল আর কয়েক মাসের মধ্যেই তোমার ফাইনাল পরীক্ষা। ইন রিয়েল সেন্স, এ সময় এ ধরনের সিচুয়েশন কিন্তু তোমার ক্যারিয়ারের পক্ষে খুব একটা ভালো নয় আর তাছাড়া... কথার মাঝে সুধাংশু আচমকা থেমে যাওয়াতে তপতী তার চোখে চোখ রেখে বলে উঠেছিল আর তাছাড়া? তাছাড়া আরো একটা সমস্যা আছে। কিছুদিন আগে বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য একটি সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন। ইউ নো তপতী, আমি বাবা-মাকে সেদিন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়।

বুঝতেই পারছ, এখন যদি আমি বাড়িতে গিয়ে বলি যে এখুনি তোমায় বিয়ে করতে চাই তাহলে বাবা-মা বাড়িতে খুব ঝামেলা করবেন। সেদিন হাঁটতে-হাঁটতে রাসবিহারীর মোড়ে পৌছনো অবধি সুধাংশু এর পর অনেক কথাই বলে গিয়েছিল। তবে তার বেশীরভাগ কথা তপতীর কানে পৌছয়-নি। আসলে তপতী তখন ব্যস্ত ছিল ভিতর থেকে উগড়ে আসা কান্নাটাকে চেপে রাখতে যাতে সেটা পথ চলতি মানুষের চোখে না পরে। সেদিন বাড়ি ফিরে তপতী একবার ভেবেছিল যে নিজেকে শেষ করে ফেলবে।

কিন্তু নিজের পেটের ওপর হাত রেখে সে যেন কার হৃদ-স্পন্দন শুনতে পায়। আর তাই কিছুদিন একা-একা নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করবার পর সে আবার ডায়াল করেছিল সুধাংশুর বাড়ির ফোন নম্বরে। কিন্তু সেদিন ঐ নম্বরে ফোন যাচ্ছিল না। অনেকবার চেষ্টা করেও তপতী যখন সুধাংশুদের নম্বরে যোগাযোগ করে উঠতে পারে না তখন সে ফোন করেছিল অলোককে। অলোককে ফোন করে তপতী রিকোয়েস্ট করেছিল যে সে যেন সুধাংশুর সঙ্গে একবার যোগাযোগ করে জানিয়ে দেয় যে তপতী তাকে ইমিডিয়েটলি দেখা করতে বলেছে।

পরের দু-দিন তপতী বাড়িতে প্রায় সারাক্ষণ ফোনের কাছে বসে থাকলেও সুধাংশু বা অলোক কেউ ফোন করেনি। আর তাই তপতী আবার অলোককে ফোন করেছিল। সরি তপতী, ইন-ফ্যাক্ট কাল থেকেই ভাবছিলাম যে তোমাকে ফোন করি। কিন্তু সাম-হাউ ফোনটা আর করা হয়ে ওঠেনি। একটু থেমে অলোক বলে উঠেছিল, তপতী আজ-কালের মধ্যে তুমি কি একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে? অলোক তাকে এভাবে দেখা করতে বলায় তপতীর অবচেতন মনে কে যেন সেদিন নিঃশব্দে বলে উঠেছিল যে কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।

আর তাই সে অলোককে জিজ্ঞাসা করেছিল সুধাংশুর সঙ্গে তোমার যোগাযোগ হয়নি অলোক? তুমি ওকে বলোনি যে আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই? সেই দিন বিকেলে তপতী হাজরা মোড়ের এক ফুড-পার্লারে অলোকের সঙ্গে দেখা করেছিল। আর তখনই অলোক তাকে জানিয়েছিল যে সুধাংশুদের বাড়ির ফোনটা কিছুদিন ধরে খারাপ থাকায় অনেক চেষ্টা করেও সে যখন সুধাংশুর সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারে না, তখন কাল সে ওর বাড়িতে গিয়েছিল। সুধাংশু সেই সময় বাড়িতেই ছিল এবং সুধাংশুর মুখ থেকেই সে জানতে পারে যে সামনের মাসে তার বিয়ে। সুধাংশুর বাবা নাকি তার ছোটবেলাতেই তাদের পালটি ঘরের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিলেন। শুধু বিয়েই নয়।

বিয়ের পরের মাসে সুধাংশু বৌ নিয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে ওখানকার একটা কলেজে রিসার্চের কাজ করতে। পার্লারের মাঝে সেদিন তপতী ডুকরে কেঁদে ওঠাতে অলোক তাড়াতাড়ি তপতীর হাত দুটো ধরে বলে উঠেছিল তপতী, প্লিজ কন্ট্রোল ইওর সেলফ। এটা পাবলিক প্লেস। সবাই তোমাকে কিন্তু দেখছে। অলোকের কথাতে কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে তপতী বলে উঠেছিল অলোক, আমার এখন কি হবে? সুধাংশুকে বিশ্বাস করে আমি যে আমার সব কিছু দিয়ে দিয়েছি।

অলোকের হাতটা তখনও তপতীর হাতে ধরা ছিল, তপতীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে যেন কি বোঝবার চেষ্টা করছিল। কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবে আমায়? আর ইউ ক্যারিং? এন্ড ইফ ইয়েস, দেন ডিড ইউ কনভে দিজ টু সুধাংশু? তপতীর মৌনতাই সেদিন অলোককে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। ৭ এর পরের দু-তিন মাস পৃথিবীর অনেক কিছুই একই রকম ভাবে চলতে থাকলেও তপতী আর অলোকের সম্পর্কটা কিন্তু প্রতিদিন নিঃশব্দে একটু-একটু করে বদলে যাচ্ছিল। আর সেই বদলের স্রোতে, আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের এক বিকেলে কোর্টের ম্যারেজ রেজিস্টারকে সাক্ষী রেখে অলোক তপতীকে নিজের বৌ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিল। ৮ কিছুক্ষণ আগে রঙ্গন তাকে বাড়ির সামনে ড্রপ করে দিয়ে গেছে।

সিঁড়ির ধাপগুলো আজ যেন কিছুতেই আর শেষ হচ্ছিল না। তবু সময়ের নিয়মে এক সময় সব সিঁড়ি পাড় করে মিতুল এসে দাঁড়ায় তাদের ফ্লাটের দরজাটার সামনে। কলিং বেল বাজাতে বাড়ির সব সময়ের কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেয়। সে যখন জুতো খুলে জায়গা মতো রাখছিল কাজের মেয়েটি তখন জানায় যে মা ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছে, আর বলেছে যে তাকে যেন খাওয়ার সময় না ডাকা হয়। দিদি যখন খাবে বলবে, আমি তোমার আর বাবুর খাওয়ার বেড়ে দেব।

মিতুল বাবার ঘরটায় একবার উঁকি মারে, না সেখানে আজ অলোককে হুমড়ি খেয়ে হিসেবের খাতায় যোগ-বিয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে না। কাজের মেয়েটাকে ডেকে মিতুল জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় যে অলোক নাকি আজ অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই ব্যলকণিতে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। মিতুল ব্যলকণিতে এসে দেখে অলোক হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে রাতের কালো আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিঃশব্দে সে অলোকের চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়ায়। আর তার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে দূরের রাস্তায় ছুড়ে ফেলে।

পা, ডাক্তার তোমায় সিগারেট খেতে বাড়ন করেছে না? কেন তুমি ডাক্তারের কথা শোনো না? কথা বলে না অলোক, মিতুলের মাথায় নিজের হাতটা রাখে। অলোকের স্পর্শে মিতুলের দু চোখ বেয়ে জলের ধারাটা তার বাঁধ ভাঙ্গে। বন্যার মতো তার দু’চোখ ছাপিয়ে জল আসে মিতুলের। জানো না পা, তুমি না থাকলে আমি শুধু আমার বাবাকেই হারাবো না, আমার বেস্ট-ফ্রেন্ডকেও আমি হারিয়ে ফেলব জীবনের থেকে। ব্যলকণির শুকনো মেঝেটা সেদিন অনেক রাত অবধি ভিজে গিয়েছিল দুটো অসম বয়সী বন্ধুর চোখের জলে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।