আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এবং বাংলাদেশের একজন সৌখিন প্রাণিবিজ্ঞানী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড- এর অবস্থান । বঙ্গোপসাগরে এই অঞ্চলে তিমিমাছ দেখতে পাওয়া যায়! যেসব বাংলাদেশি ডানপিটে শীত-গ্রীষ্ম নির্বিচারে দাপিয়ে বেড়ান অরণ্যপাহাড়সমুদ্র- তাদের কাছে এ তথ্যটি মোটেও বিস্ময়কর নয় এবং তাদের কাছে ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’- এই আলংকারিক বাক্যটি মোটেও অপরিচিত নয়। এদের অনেকেই এরই মধ্যে ফিশিংবোটে চেপে সেই সবজে-নীল জলের মনোরম জলজ রাজ্যে ঢুঁ মেরেও এসেছেন; ফ্লিকারে অবিশ্বাস্য সব ছবি আপলোডও করেছেন।

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড সম্বন্ধে বাংলাদেশের গুটিকয়েক পত্রপত্রিকায়ও লেখালেখি হয়েছে; বিশেষ করে ২০০৭ সালে ডেইলি স্টার- এ আসরা রেজা চৌধুরীর দুটি রিপোর্ট। এবং এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৮ সালে ডেইলি স্টার-এর রিপোর্টার আহমেদি হুসেন- এর ‘দ্য বে অভ ওয়ানডার’ শিরোনামে একটি ছবি সম্বলিত অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক রিপোর্ট পাঠককে বিস্মিত করে থাকবে। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগই মানুষের কাছেই আজও বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড একেবারেই অপরিচিত। এই বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক । একুশ শতকে পৌঁছে এতটা অসচেতনা কি মানায় ? কাজেই সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড সম্বন্ধে সচেতন করতেই এই পোস্ট।

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এর মানচিত্র। এর নীচে রয়েছে প্রায় ১৪ কিলো মিটার চওড়া উপত্যকা। সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে যার দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড আসলে বঙ্গোপসাগরের তলায় একটি গভীর উপত্যকা বা মেরিন ভ্যালি। একে আন্ডার ওয়াটার ক্যানিয়নও বলা হয়।

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এ প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। জেলেরা ফিশিংবোট আর মাছধরার ট্রলার করে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এ মাছ ধরতে যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের সেরা চিংড়ির ঘের তো ওই সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এই। জেলেরা ওখানে গিয়ে দেখে যে পানির রং কেমন আলাদা। জেলেরা ঠিকই জানে যে জায়গাটা অনেক গভীর।

কিন্তু এর তলায় যে একটি গভীর উপত্যকা রয়েছে তা তাদের জানার কথা না । তারা ডলফিন দেখে, পপাস (এক ধরণের ছোট ডলফিন) দেখে। কখনও তিমিও দেখে। এই তাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের নীচে উপত্যকা।

বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এর নীচের দৃশ্য অনেকটা এমনই। এই গভীরতার কারণেই সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের আড়ত। উপত্যকার গভীরতা এবং পর্যাপ্ত মাছের জন্যই সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এ ডলফিন, পপাস এবং তিমির আনাগোনা। বঙ্গোপসাগরে ডলফিন- এর উপস্থিতি মেনে নিলেও বাংলাদেশের অনেকেই বঙ্গোপসাগরে তিমির ব্যাপারটা অবশ্য বিশ্বাস করেন না! কিন্তু ওই অঞ্চলের নাম কেনSwatch of no ground বা SONG ? এবং কারাই-বা ওই অদ্ভূত নাম দিয়েছিল? অনেকদিন আগে ব্রিটিশরা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড নামটি দেয়। এর কারণ আছে।

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড যেখানে শুরু সেখানে হঠাৎ করেই পানির গভীরতা বেড়ে গেছে। কাজেই পানির রঙও গেছে বদলে । সোয়াচ নামকরণের এই কারণ। স্যাম্পল হিসেবে কাটা কাপড়ের টুকরোর নাম সোয়াচ হলেও এখানে রঙের পার্থক্য প্রধান বিষয়। আর ব্রিটিশরা সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড কে অতল ভেবেছিল বলেই ‘নো গ্রাউন্ড’ বলেছে।

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড -এ বঙ্গোপসাগরের পানির গভীরতা হঠাৎ করেই ২০ থেকে ৫০ মিটার নেমে গেছে বলে পানির রং বদলে গেছে। আসলে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড-এই গঙ্গা নদীর শেষ পরিনতি। স্যাটেলাইট থেকে রঙের পার্থক্য দেখা যায়। এই ছবিটি তুলেছেন সাব্বির ফেরদৌস। তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড- এর গভীরতা ব্রিটিশরা মাপতে পারেনি। বর্তমানে বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। হোসেইন জামাল তারই ভিত্তিতে বাংলাপিডিয়ায় লিখেছেন: সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এর সর্বমোট এলাকা প্রায় ৩,৮০০ বর্গকিলোমিটার। গভীরতা ১০ মিটার থেকে ১০০ মিটার। তবে এর ৭০% এর গভীরতা ৪০ মিটার- এর বেশি।

এর তলায় রয়েছে কাদা মোশানো বালি। এর ঘনত্ব প্রায় ১৬ কিলোমিটার! সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড -এ বটলনোজ বা বোতলনাকি (এই নামটি আমি দিলাম) ডলফিন। বোতলনাকি ডলফিনের এই ছবিটি তুলেছেন বাংলাদেশে ডলফিন গবেষনার পথিকৃৎ সৌখিন প্রাণি বিজ্ঞানী রুবাইয়াৎ মনসুর মুগলি। সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এর সঙ্গে বাংলাদেশের যে প্রকৃতিপ্রেমি মানুষের নামটি জড়িত তিনি হলেন: রুবাইয়াৎ মনসুর (মুগলি)। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণিদের গবেষনায় তাঁর ভূমিকা অনন্য।

এবং আমি মনে করি তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং গবেষনা সম্বন্ধে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মর জানা দরকার । রুবাইয়াৎ মনসুর কে বরাবরই সুন্দরবন বড় টানত। সুন্দরবনে তাঁর বাবার ট্যুরিস্ট বোট ছিল। নব্বুয়ের দশকে রুবাইয়াৎ মনসুর ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিমি! ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’ এ! ছবি তুলে ছেন সাব্বির ফেরদৌস।

ছবিটির সূত্র: Click This Link সৌভাগ্যক্রমে ২০০২ সালে রুবাইয়াৎ মনসুর এর সঙ্গে প্রাণিবিজ্ঞানী ব্রায়ান স্মিথ -এর পরিচয় হয়। ডক্টর স্মিথ বাংলাদেশের উপকূলে ইরাবতী ডলফিনের খোঁজে এসেছিলেন । ২০০২ সালেই প্রথম জানা গেল যে গঙ্গা নদীর ডলফিন - যা শুশুক নামে পরিচিত- তার পাশাপাশি বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিনও রয়েছে। এরপর রুবাইয়াৎ মনসুর নিজস্ব উদ্যোগে গবেষনা আরম্ভ করেন। মনসুর ২০০৪ সালের মধ্যেই র সুন্দরবনের দক্ষিণের উপকূলের প্রায় ৫০ কিলোমিটার অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারেন যে ডলফিন, পপাস এবং তিমি বাংলাদেশের জলসীমাকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে! পরপাস।

এরা ডলফিন ও তিমি পরিবারের ছোট সামুদ্রিক প্রাণি। তবে পপাস ডলফিনের মতন দেখতে হলেও এর বৈশিষ্ট্যে ডলফিনের চাইতে অনেকই আলাদা। তবে নাবিক ও জেলেরা ছোট ডলফিন বলতে পপাসই বোঝায়। পপাস এরর ঠোঁট ছোট আর দাঁত কোদাল আকৃতির এবং সমতল। যেখানে ডলফিন -এর দাঁত কৌনিক।

প্রাণিবিজ্ঞানী ব্রায়ান সুন্দরবন উপকূলে মনসুর এর তোলা ডলফিন, পপাস এবং তিমির ছবি দেখে মনসুর কে সামুদ্রিক স্তন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করতে বলেন। প্রাণিবিজ্ঞানী ব্রায়ান বলেন যে মনসুর -এর মতো তরুণ বাংলাদেশিদের বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে আসা উচিত। তিমি । ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’ এ! এটি ব্রাইডেস তিমি। এই ছবির কপিরাইট ইন্দ্রনীল কিশোর- এর।

এরপর আর রুবাইয়াৎ মনসুর পিছন ফিরে তাকাননি। তিনি বাংলাদেশ সিটেইসান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট বা বিসিডিপি প্রতিষ্ঠা করেন। বড় স্তন্যপায়ী প্রাণিকে প্রাণিবিজ্ঞানীরা সিটেইসান বলে থাকেন। সে যাই হোক। এরপর মনসুর ২০০৫ সালে সুন্দরবন উপকূলে বোতলনাকি (বটলনোজ ) ডলফিন-এর ফটো আইডেন্টিফিকেশন -এর কাজ আরম্ভ করেন।

এই কাজ করতে গিয়ে মনসুর ক্রমশ জানতে পারেন যে মংলার কাছে প্রায় ৪০ কিলো জুড়ে অবাধ নীলাভ জলে প্রচুর বোতলনাকি ডলফিনের । তবে এরা ফিশিং ট্রলারের কাছে আসে বলে বোটের ব্লেডে প্রায়শই পাখনা কেটে যায়। এই বোতলনাকি ডলফিন-অধ্যূষিত নীলাভ জলই ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’ নামে পরিচিত! মনসুর ২০০৮ সালে ডেইলি স্টার-এর রিপোর্টার আহমেদি হুসেন কে বলেন: in fact, a thriving ground for the whales and dolphins for its unique makeup. আমি আগেই বলেছি যে-‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’- এর অতল গভীরতাই এবং মাছের আধিক্যই ডলফিন পপাস আর তিমিকে টেনে এনেছে। আসলে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড ডলফিন পরপাস ও তিমির হটস্পট। ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’ পৃথিবীর একমাত্র সোয়াচ যেখানে এই তিনটি সামুদ্রিক স্তন্যপ্রাণি একসঙ্গে দেখা যায়! সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এ ব্রাইডেস তিমি।

(এই ছবির কপিরাইট ইন্দ্রনীল কিশোর- এর) সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এ ব্রাইডেস তিমিই বেশি। তবে মাছ ধরার ট্রলার থেকে ছোড়া জালে এরা আহত হয়। এই ছবি তে দেখা যাচ্ছে জাল তিমির লেজের মাংসের বেশ গভীরে ঢুকে গেছে। ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’ এ জেলেদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার। উৎসর্গ: বাংলাদেশে ডলফিন গবেষনার পথিকৃৎ সৌখিন প্রাণি বিজ্ঞানী রুবাইয়াৎ মনসুর মুগলি।

এছাড়া তথ্য ও ছবির জন্য ডেইলি স্টার এর প্রতিবেদক আসরা রেজা চৌধুরী, আহমেদি হুসেন; ফটোগ্রাফার সাব্বির ফৌরদোসকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ‘সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড’এর আরও কিছু ছবি Click This Link ছবি। ইন্টারনেট। তথ্যসূত্র: http://en.wikipedia.org/wiki/Bay_of_Bengal Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link http://www.flickr.com/photos/jexca/4364265679/ Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।