আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অলিম্পিকের গল্পঃ অসাধারণ পিতৃস্নেহ আর অসীম সাহসিকতার গল্প

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” ১৯৯২ সাল। বার্সেলোনা অলিম্পিক। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে ৪০০ মিটার দৌড়ের সেমি ফাইনাল। প্রতিযোগীরা সবাই স্টার্টিং পয়েন্টে গিয়ে তৈরী হচ্ছে। হঠাৎ করে পিস্তলের গুলির আওয়াজ শোনা গেলো- দৌড় শুরু হলো।

প্রতিযোগীরা যখন দূরত্বের মাঝপথে, একজন প্রতিযোগী হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির জন্য ট্র্যাকে বসে পরলেন। রেডক্রসের একজন চিকিৎসক দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন, সাথে গেলেন আরো দুজন লোক স্ট্রেচার নিয়ে। কিন্তু সেই প্রতিযোগী অলিম্পিক থেকে স্ট্রেচারে করে বেরিয়ে যেতে চাইলেন না, বরঞ্চ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার দৌড়াতে শুরু করলেন। তিনি হচ্ছেন ডেরেক রেডমন্ড, ইংল্যান্ডের প্রতিযোগী। ডেরেক রেডমন্ড- ব্যাথায় কাতর ডেরেক রেডমন্ড যখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছেন, তখন নিরাপত্তা রক্ষীদের বাধা অতিক্রম করে একজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি ডেরেকের পাশে এসে ডেরেকের সাথে দৌড়াতে লাগলেন।

কিছু পরেই দেখা গেলো ডেরেক সেই ব্যক্তিটির ঘাড়ে মাথা দিয়ে ৪০০ মিটারের বাকী পথটুকু অতিক্রম করলেন। ততক্ষণে স্টেডিয়ামের প্রায় ৬৫০০০ দর্শক দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে ডেরেক রেডমণ্ড এবং সেই ব্যক্তিটিকে অভিবাদন জানাচ্ছে। তাঁরা দুইজনেই হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হচ্ছেন জিমি রেডমন্ড, ডেরেক রেডমণ্ডের বাবা! ডেরেক রেডমন্ড- বাবার সাথে ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করছেন অলিম্পিকের ইতিহাসে এই দৃশ্যটি শুধু সাহসিকতা আর উৎসাহেরই প্রতীক হয়ে রইলো না, একই সাথে সাক্ষী হয়ে রইলো অসাধারণ পিতৃস্নেহের। ডেরেক রেডমণ্ড- ইনজুরি ছিলো যার নিত্যসঙ্গী।

হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির জন্য ১৯৮৬ সালে কমনওয়েলথ গেমস মিস করার পর, ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ড দলের সদস্য। সেখানেও ৪০০ মিটার দৌড়ের প্রথম রাউন্ড শুরু হবার ঠিক ৯০ সেকেন্ড আগে একিলিস টেন্ডনে ইনজুরির জন্য অলিম্পিক থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেন। ইনজুরি থেকে সুস্থ হয়ে ১৯৯১ সালে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ানশিপে ৪X৪০০ মিটার দৌড়ে ফেভারিট আমেরিকাকে হারিয়ে স্বর্ণ পদক পান। এরপর অষ্টম বারের মতো অস্ত্রপচার করে সেরা ফর্মে বার্সেলোনাতে আসেন। ৮০০ মিটারে প্রথম রাউন্ডে তাঁর ক্যারিয়ার সেরা টাইমিং করেন।

ইংল্যান্ডবাসীর সাথে সাথে তাঁর পরিবারের সদস্যরাও আশায় বুক বাঁধতে থাকেন অলিম্পিক পদকের জন্য। ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনে তাঁর মা জেনী রেডমণ্ড এবং বোন নয় মাসের প্রেগন্যান্ট ২৮ বছর বয়স্ক কারেন টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে থাকলেন ডেরেককে। স্টেডিয়ামে দর্শকের সারিতে বসা ছিলেন তাঁর বাবা। ডেরেক যখন খুঁড়িয়ে দৌড়ানো শুরু করলেন, তাঁর বাবা জিমি রেডমন্ড এসে তাঁকে থামতে বললেন। কিন্তু ডেরেক থামতে চাইলেন না, তিনি চাইলেন না তাঁর অলিম্পিকের সমাপ্তি এইভাবে হোক।

জিমি তখন বললেন, "Well then, we're going to finish this together." তাঁরা একসাথেই দৌড় শেষ করলেন, ধীরলয়ে, পিতা আর পুত্র। নর্দাম্পটনে ডেরেকের মা টিভিতে এই দৃশ্য দেখে ফুঁপিয়ে উঠলেন। ভাইকে ট্র্যাকে পরে যেতে দেখে ডেরেকের বোনের জরায়ুর সংকোচন শুরু হয়ে যায়। পরে সাংবাদিকদের কাছে ডেরেকের মা বলেছিলেন, তাঁর ছেলেকে এর আগে একবারই এতোটা কষ্ট পেতে দেখেছিলেন, যখন ষষ্ঠ জন্মদিনে ডেরেক একটা বাই সাইকেল কিনতে চেয়েও পান নি। এই ঘটনার পর অনেকেই ডেরেককে সহানুভূতি জানিয়ে মেসেজ পাঠান।

তাদের মধ্যে একজন কানাডিয়ান, যার সাথে ডেরেকের কখনোই আর দেখা হয় নি, লিখেছিলেন, "Long after the names of the medallists have faded from our minds, you will be remembered for having finished, for having tried so hard, for having a father to demonstrate the strength of his love for his son. I thank you, and I will always remember your race and I will always remember you – the purest, most courageous example of grit and determination I have seen." ২০ বছর আগের এই মেসেজটি যেনো এখনো সত্য, যেমন সত্য ছিলো সেই দুই যুগ আগের আরেকটি ঘটনাও। লরেন্স লেমিয়েক্স, কানাডিয়ান সেইলর। ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে ফিন ক্লাসে (Finn Class) প্রতিদ্বন্দীতা করছিলেন। সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখে মূল অলিম্পিক ভেন্যু সিউল থেকে প্রায় ৪৫০ কিমি দূরে পুসান নদীতে সেইলিং-এর প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আবহাওয়া তখন ছিলো শান্ত, নদীও ছিলো স্থির।

একই সাথে সেইলিং-এর কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ক্লাসের রেস চলছিলো। লরেন্স খুব ভালো সেইলর। সে তাঁর ফিন ক্লাসে তখন অনেক এগিয়ে, দ্বিতীয় স্থানে। নিশ্চিত একটি পদকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মনে অলিম্পিক পদক পাবার আনন্দ, দেশবাসীকে কিছু দিতে পারার আনন্দ! ঘটনার সূত্রপাত তখনই।

হঠাৎ করেই আবহাওয়া অস্থির হতে লাগলো, বাতাসের গতিবেগ ১৫ নট থেকে ৩৫ নটে চলে গেলো, পুসান হয়ে উঠলো অশান্ত। দুই সিঙ্গাপুরিয়ান সেইলর জোসেফ চ্যাঙ এবং শিউ শাহ, ৪৭০ ক্লাসের প্রতিযোগী, সেই অশান্ত পুসানে পরে গেলেন, চলে গেলেন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ঠিক সেই সময়েই কাছাকাছি ছিলেন একমাত্র লরেন্স লেমিয়েক্স। তিনি দূর থেকে তাদেরকে দেখলেন। একবার চিন্তা করলেন, নিশ্চিত পদকের দিকে যাবেন, নাকি পদকের আশা ছেড়ে দিয়ে দুইজন ডুবন্ত মানুষকে রক্ষা করবেন? লরেন্স লেমিয়েক্স একজন মানুষ, তিনি মানুষের কাজই করলেন।

প্রবল বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে সেই দুইজন সিঙ্গাপুরিয়ানকে উদ্ধার করলেন। রেসকিউ টিম এসে তাদেরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবার পর, লরেন্স আবার সমাপ্তি রেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। যার দ্বিতীয় হওয়া ছিলো নিশ্চিত, তিনি হলেন ২২তম! লরেন্স লেমিয়েক্স মজার ব্যাপার হলো, এই উদ্ধার পর্বের কাহিনী কোনো সিঙ্গাপুরী মিডিয়াতে আসে নি, যেহেতু এটা সিঙ্গাপুরের অলিম্পিক দলের ব্যর্থতার কাহিনীই বর্ণনা করবে! কি বিচিত্র এই পৃথিবী! কেউ পদকের আশা ছেড়ে দিয়ে মানুষ উদ্ধার করে, আবার কেউ কেউ সেটা প্রচারও করতে চায় না, তাদের জন্য বিব্রতকর হবে বলে! কিন্তু সবাই একই ভুল করেননি। প্রতিযোগিতা শেষ হবার পরই ইন্টারন্যাশনাল ইয়ট রেসিং ইউনিয়নের বিচারকরা সর্বসম্মতক্রমে লরেন্স লেমিয়েক্সকে দ্বিতীয় ঘোষনা করেন, দুইজনকে বাঁচাতে যাবার আগে যে পজিশনে তিনি ছিলেন। পদক বিতরনী অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সেই সময়কার সভাপতি হুয়ান আন্তনিও সামারাঞ্চ স্পোর্টসম্যানশিপের জন্য লরেন্সকে পিয়েরে দ্য কুবার্তিন পদক প্রদান করেন, যা ১৯৬৪ সালে এই পদক চালু হবার পর মাত্র ১১ জন ব্যক্তি পেয়েছেন।

এই সময়ে লরেন্সকে উদ্দেশ্য করে সামারাঞ্চ বলেন, "By your sportsmanship, self-sacrifice and courage, you embody all that is right with the Olympic ideal." তাই এই ঘটনার ২৪ বছর পরও আমরা লরেন্সের অলিম্পিক পদক পাওয়া নিয়ে কথা বলি না, কথা বলি তাঁর অসীম সাহসিকতাকে নিয়ে, যে সাহসিকতার জোরেই তিনি পেরেছিলেন দুইজন বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে। (ঘুরে আসুন আমার সুড়ঙ্গ থেকে, দেখে আসুন অনেক কিছু) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.