আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রমজান মাসের শিক্ষা:

আজ কেন জানি মানুষ আর অ-মানুষের শবচ্ছেদ করতে ইচ্ছে করছে। এই মাত্র বানানী মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে আসলাম। আমার অফিস এর পাশেই মসজিদ তাও হাতের কাজ সারতে সারতে দেরি হয়েই গেল। খুৎবার শেষ অংশ রাস্তায় শুনতে শুনতে মসজিদে পৌঁছেছি। ততক্ষণে একামত শুরু হয়ে গেছে।

জুম্মার দিন বিশেষ করে রমজান মাসের জুম্মাগুলোতে যেন মহল্লার সব মুসুল্লি পরিবারের সবাইকে নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক, যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে আমাদের সমাজে। তাই মসজিদে তিন ধারণের কোন জায়গা নেই। মসজিদের বাইরে ১০নাম্বার রোড এর এ মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত রাস্তায় মসজিদ কর্তৃপক্ষ সুন্দর করে চটের ছালা বিছিয়ে রেখেছেন। তবু যেন লোক সংকলন হচ্ছে না আজ।

এদিকে একামত প্রায় শেষ। আমি কোন এক চিপায় দেখলাম এক ভদ্রলোক চটের ছালার উপর সৌদি আরব থেকে আনা সুন্দর বড়সড় এক জায়নামাজ বিছিয়ে জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনাকে একটু রিকোয়েস্ট করে বললাম ভাই, আপনি একটু চেপে দাঁড়ালে আমি আপনার জায়নামাজে সেজদাটা দিতে পারব। আমার এক পা না হয় রাস্তার মাটিতেই থাকল। উনি রক্তচক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, নাহ আমি চাপাচাপি করে দাড়াই না।

নামাজের এত সখ থাকলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ুন। - মনটা বড়ই বিষণ্ণ হয়ে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হবে বলে নয়, দেখতে শুনতে এত সুন্দর ভালো মানুষটার ব্যবহারে। - এ হল আমাদের তথাকথিত সুসভ্য সমাজের একজন সুনাগরিক, কিংবা হয়তোবা সুশীল সমাজ খ্যাত কোন ব্যক্তি। ভদ্রলোক বা মানুষ।

এখন আসি তথাকথিত অমানুষের কথায় - আমি ততক্ষণে সেই তথাকথিত ভদ্রলোকের পাশে মিউনিসিপালটির পাকা রাস্তাতে দাঁড়িয়ে গেছি। আমার ঠিক পাশে কোন এক দিন মজুর কিংবা ঘাম ঝরিয়ে খেটে খাওয়া একজন এসে দাঁড়ালো। তার সাথেও জায়নামাজ জাতীয় কোন সভ্য লোকের নামাজের বিছানা থাকার কথা নয়। তবুও সে একটি ছোট গামছা বিছিয়ে আমার পাশে একটু চেপে দাঁড়িয়ে বলল, ভাইজান একটু কষ্ট করলে আমরা দুইজনেই এই গামছায় সেজদা করতে পারব। দুজনের দু পা নাহয় দুই দিকে বের হয়ে থাকলো, তাও রাস্তা তো কত হাবিজাবি আবর্জনায় ভরা ওখানে সেজদা না করে আসেন দুই ভাই মিলে এই গামছায় সেজদা করি।

আমার গামছাটা নামাজ পড়ার জন্য সব সময় পবিত্র আর পরিষ্কার করে রাখি। নামাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি কথা না বাড়িয়ে ওনার কথা মত গামছা দুজনে শেয়ার করে নামাজ শেষ করলাম। সালাম ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই আপনি কি করেন? উনি বললেন আমি বনানী বাজারে দিন মজুরের কাজ করি। আমি খুব সংকোচিত ভাবে ওনাকে বললাম আমি যদি আপনাকে কিছু সাহায্য করতে চাই আপনি কি নেবেন? উনি হেসে বললেন, ধন্যবাদ ভাই, আমার এখনো হাত পা আল্লাহ্‌ কেড়ে নেয় নি, আমি কাজ করে খাই, ভিক্ষে করি না।

কথাটা শুনে আমি একটু লজ্জিত হলেও কেন জানি এক অজানা ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে গেল। আমরা যেখানে বসে নামাজ পড়লাম সেখান থেকে আমার অফিস দেখা যায়। আমি ওনাকে শুধু বললাম - আমরা আজ দুভাই মিলে একসাথে কষ্ট করে জুম্মার নামাজ আদায় করলাম, আপনি আপনার গামছা দিয়া আমাকে অপবিত্র জায়গায় সেজদা দেওয়া থেকে রুখেছেন, আমার অফিসটা চিনিয়ে দিয়ে তাকে বললাম - জীবনে যদি কখনো কোন প্রয়োজন হয় তা হলে "ছোট-বড়", "ধনী-গরিব" ভুলে গিয়ে এই ভাইটার কথা একটু মনে করেন। আজ আপনি আমার অনেক বড় উপকারে এসেছেন, হয়তো বা জীবনের কোন এক সময় আমিও আপনার কোন উপকারে আসতে পারি। উনি হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌।

আপনি যে বললেন এটাই অনেক বেশি পাওয়া আমার জন্য, দোয়া রাখবেন যেন কাজ করে বাকী জীবনটা চলতে পারি, কারো কাছে হাত পাততে না হয়। - এও মানুষ, তবে আমাদের তথা কথিত ভদ্রসমাজের ভাষায় অমানুষ, ভিখারি, কাজের লোক। আমাদের ঠিক পাশে বসা তথাকথিত সুধী সমাজের ভদ্রলোক আমাদের কথা শুনলেন এবং পুরো ঘটনা দেখলেন। তার মনে কোন রেখাপাত করল বলে আমার মনে হলো না। যথারীতি বা-দাল জুম্মা সুন্নত নামাজের নিয়ত করতে দাঁড়াচ্ছেন দেখে আমি ওনাকে দুটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না - উনি সুন্নত নামাজ শুরু করার আগেই ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম - ভাই কি রোযা রেখেছেন? উনি একটু গরম গলায় বললেন - এটা কেমন প্রশ্ন? রোযার দিনে রোযা রাখব না কেন? আমি শুধু ওনাকে বললাম ভাই, উপোষ দিলে রোজা হয় না, আপনি পুরো ঘটনা আড় চোখে দেখেছেন, আমাদের কথা পুরোটা পাশে বসে শুনেছেন।

যদি পারেন এই দিন মজুর ভাই এর কাছে রোযার শিক্ষা নিয়েন। বলে আমি চলে আসলাম। অফিসে এসে সুন্নত পড়তে পড়তে মনটা কেমন যেন খালি আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। সুন্নত নামাজ শেষ করে মানুষ আর অমানুষ এর পার্থক্যটা লিখে ফেললাম। এতে যদি সুশীল সমাজের মানুষদের গাত্রদাহ হয় তাতে আমার কিছু করার নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।