আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"দোসতো, আরেকটা পরোটা খাওয়া যাইবো?!"

... আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে বলি বাংলায় 'ধুর-বাল'। "দোসতো, আরেকটা পরোটা খাওয়া যাইবো?!" কলেজ জীবনের ঘটনা। চরিত্র আমরা তিন বন্ধু। আমি, ছোটন আর রূপক। যেদিন যেদিন স্যারের কাছে টিউশন পড়া থাকতো না সেদিন সন্ধ্যায় আমরা হাঁটতাম।

হিমুর মতো হাঁটা যাকে বলে। অঞ্জনের গান গাইতে গাইতে হাঁটতাম আর গল্প করতাম। বাসার সামনে রেললাইন। লাইন ধরে হেঁটে চলে যেতাম মহাখালী। ওখান থেকে শাহীন কলেজের সামনে দিয়ে হেঁটে এসে পুরাতন বিমানবন্দরের রাস্তা ধরে আবার ফিরে আসা... কী অসাধারণ সব দিন গেছে! এই সামান্য পথটুকু হেঁটেই আমাদের অবুঝ মনে হিমু হওয়ার সাধ উঁকি দিত... আমাদের অবুঝ হিমুবিলাস! খুব বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলে পাড়ায় ফিরে চা-বিস্কিট খাওয়া হতো।

পাগলার পুলে মোসলেম ভাইয়ের টঙ দোকানের অমৃতসম চা। কড়া লিকারে অল্প করে কনডেন্সড মিল্ক আর আধ-চামচের কম মালটোভা। স্পেসাল চা যাকে বলে। আমাদের নিত্যদিনের চা ছিল ওটা। আর বেশি খিদে পেলে রেলগেটের হোটেলে পরোটা-ভাজি-সবজি খাওয়া।

পাড়ায় তখন নতুন একটা হোটেল দিয়েছে। নাম "কিছুক্ষণ"। নতুন মানে হচ্ছে নতুন দামে নতুন চেয়ার-টেবিলে করে পুরনো রেসিপির খাবার পরিবেশন। সেদিন আমাদের খিদেটা একটু বেশিই লেগেছিল। তিন বন্ধু কোন কিছু চিন্তা না করে ঢুকে পড়লাম "কিছুক্ষণ"-এ।

সবকিছু নতুন দেখে একটু চিন্তাই লাগছিল। কত না জানি দাম নেয় খাবারের। মেন্যু দেখে ভাবলাম যা খাই সমসময় তাই, পরোটা-সবজি। নতুন কিছু ট্রাই করতে গিয়ে বিপদে যেন না পড়ি। কারণ চা খেয়ে আর ভিডিও গেমস খেলে পকেটে পয়সা সীমিত ।

পাড়ায় এমন কোন কেউকেটা টাইপও ছিলাম না যাতে করে টাকা কম পড়লে বাকিতে খাব বা পরে টাকা দিয়ে যাব। গরম গরম পরোটা আর ফ্রেস-স্টিমড সবজি এলো। তিনজনের জিভেই জল। দুটো করে পরোটা সাবাড় করার পর মনতো ভরলই না, এমনকি পেটও না। তিনজনই তিনজনের দিকে তাকাচ্ছি।

কী করব এখন! তিনজনের পকেটে টাকা যা আছে সেই হিসেব করে হোটেলে ঢুকেছিলাম। এখন এর বেশিতো আর অর্ডার দেয়া সম্ভব না। ক্ষুধার্ত চোখে খালি প্লেট নিয়ে বসে আছি। খাওয়া শেষ কিন্তু তখনো সামান্য সবজি বাকি রয়ে গিয়েছে বাটিতে। নীরবতাটা প্রথম ছোটনই ভাঙল।

করুণ গলায় জিগেশ করল, "দেখ না, টাকা আছে কি না পকেটে আর, আরেকটা পরোটা খাইতে মন চাইতেছে। " তিনজনই আঁতিপাঁতি করে পকেট খুঁজলাম। পকেটে সম্বল কেবল তখন পর্যন্ত যা খেয়েছি সেই বিল। তাও খুঁজতে থাকলাম। কয়েন, এক টাকার নোট, খুচরা মিলিয়ে চার টাকা বাড়তি পাওয়া গেল।

যাক, আরো দুটো পরোটা খাওয়া যাবে তাহলে! আমাদের চোখে-মুখে তখন এভারেস্ট জয়ের মতো আনন্দ! এরপর তিন বন্ধু মিলে দুটো পরোটা খেলাম। তিনজনেরই বাটিতে একটু একটু করে রয়ে যাওয়া সবজি দিয়ে। কে কার বাটির সবজি খাচ্ছি সেটা আর মনেই থাকল না। পরোটা দুটো বাড়তি খেতে পারছি এতেই আমাদের আনন্দ। খিদেতো মিটলই, পেটের সাথে সাথে এবার মনটাও ভরে গেল যেন... অমৃতের মতো লাগলো! তারপর অনেক অনেকদিন কেটে গেছে।

কিন্তু স্মৃতিটা হারিয়ে যায়নি। একজন আরেকজনকে কোন না কোন আড্ডায় তা মনে করিয়ে দিতাম। কোন কোন সময় খেতে বসলে দুটো পরোটা আরো বেশিই অর্ডার করতাম। স্মৃতিটা মনে করে নস্টালজিক হতাম। খুব খেয়াল করে দেখলে হয়তো আমাদের চোখের কোণে সামান্য জলের ঝিলিকও দেখা যেতো, হাসতে হাসতে এই স্মৃতি মনে করে... বন্ধুদের সাথে এসব অমূল্য স্মৃতি মনে করতে কোন বিশেষ দিবসের প্রয়োজন হয় না।

কারণ এসব স্মৃতির বাস হৃদয়ের অনেক গভীরে। যা কখনোই ভোলা যায় না। ভুলতে চাইলেও না। বাস্তবতা আর ব্যস্ততার সাথে খাতির করতে গিয়ে আজ বন্ধুরা সবাই দূরে। একই পাড়ায় থাকার পরও একজনের সাথে দেখা হয় খুব কম, আরেকজন আছে হাজারো মাইল দূরে।

তবুও এখনো যখন হোটেলে বসে পরোটা খাই তখন মনে পড়ে কে যেন বলতো, "দোসতো, আরেকটা পরোটা খাওয়া যাইবো?!" ভাল থাকিস রে আমার বন্ধুরা, সবসময়! দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না রইলো না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.