আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হায় হুমায়ূন!

সদাহাস্যময়! আমার আরেকটা স্বপ্ন আছে, সেটা শুনলে তোমরা একটা ধাক্কার মতো খাবে! আমার স্বপ্নটা হলো, ২০২০ সাল পর্যন্ত কোনোরকম বেঁচে থাকা! এর কারণ হলো ২০২০ সালে মানুষ প্রথম মঙ্গল গ্রহে পা দেবে- আমি এ মহান দৃশ্যটি দেখে মরতে চাই....! হুমায়ূন আহমেদ,২০০৭। সাক্ষাৎকার গ্রহণ আরিফুর রহমান ও ওমর শাহেদ, ১৭ মার্চ ২০০৭ এ দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত। বর্তমান প্রজন্মকে আপনার কেমন মনে হয়? হুমায়ূন আহমেদঃ এখনকার ছেলেমেয়েরা আমাদের থেকে অনেক বেশি স্মার্ট। ইন্টারনেট আর বইপত্রের মাধ্যমে সারা পৃথিবী তাদের কাছে খোলা। তাদের বয়সে আমাদের দৌড়টা ছিল খেলার মাঠ, পাশের বাড়ির উঠান, বড়জোর ট্রেনে করে নানা বাড়িতে যাওয়া পর্যন্ত।

তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো আরো বদলে যাবে। আপনি তো বর্তমান প্রজন্মকে অনেকটাই প্রভাবিত করতে পেরেছেন! ওরা অনেকেই আপনার বই পড়ে পড়ে বড় হয়: হিমু হতে চায়, মিসির আলী হতে চায়- এটা আপনি কিভাবে দেখেন? না এটা বললে অনেক বড় কথা বলা হয়ে যাবে, এত বড় কথা আমি নিজের সম্পর্কে কখনোই বলব না। আমি শুধু আমার বইপত্রের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সে জন্য আমি টেলিভিশন ব্যবহার করেছি। একের পর এক চমৎকার সব নাটক দিয়েছি টেলিভিশনে।

আমাদের সময় একটা ফ্যাশন ছিল ইন্ডিয়ান লেখকদের বই পড়া। আমাদের আর কি দোষ, আমরা তো ভাল লেখাটাই পড়বো। যে সময়ে মানিক বন্দোপাধ্যায় লিখছেন, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ আর মুসলমান লেখকরা সেসময় লিখছেন, ‘আনোয়ারা আনোয়ারা’ টাইপের উপন্যাস। পার্থক্যটা প্রায় ১০০ বছরের। বই তো আসলে মনের খাদ্য।

যে বইটি তোমার পড়তে ভাল লাগবে তুমি সে বইটিই কিনবে। অন্য বই বিনা পয়সায় দিলেও তো তুমি নেবে না! এবারের বইমেলায়ও আপনার প্রচুর বই বিক্রি হয়েছে। এ আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাটুকু আপনি কেমন উপভোগ করেন? আমার জনপ্রিয়তা অতিরিক্ত এটা ঠিক। কিন্তু অতিরিক্ত জনপ্রিয় কোন কিছু নিয়ে আমাদের সব সময়ই এক ধরনের সন্দেহ কাজ করে। কারণ জনপ্রিয়তা আর মিডিওক্রেসি কিন্তু একই।

আমার দৃষ্টিতে জনপ্রিয় লেখক তিনিই, যিনি তার লেখাটা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটা কৌশল আয়ত্ত করেছেন, যা অন্য লেখকরা পারেননি! তবে আমি নিজে যা সত্য বলে মনে করি সেটাই সব সময় লেখার চেষ্টা করি। আমি আমার জনপ্রিয়তা দেখে সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম, যখন আমার নাটকের একটি চরিত্র বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেওয়ার দাবিতে সারাদেশের মানুষ আধাপাগল হয়ে গিয়েছিল! আপনার লেখালেখিতে মুক্তিযুদ্ধ বারবার এসেছে...। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি একজন যুবকের চোখ দিয়ে; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসসি পড়ছি। এমএসসি পড়া একটি যুবকের স্বপ্ন থাকে মেয়েকেন্দ্রিক। সে সময়ে সে যদি দেখে এখানে আগুন লাগছে, ওখানে গুলি হচ্ছে, নদীতে লাশ ভেসে যাচ্ছে, বাবার খোঁজ নেই, মিলিটারি মানুষ মেরে ফেলছে; তখন তার ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে।

কাজেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব লেখালেখি করেছি তার পেছনে আমার নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ তোমাদের দেখতে হয়নি। তোমরা একই অর্থে মহাভাগ্যবান, আবার একই অর্থে দুর্ভাগাও। আচ্ছা আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে আপনি কি ভাবেন? আমাদের দুটি রাজনৈতিক দল, দুটি দলের ভেতরে আদর্শগত, গুণগত এবং দোষগত কোনরকম পার্থক্য নেই। দুটিই এক।

একটি দল এক সময় বলত, আমরা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি। পরে দেখা গেল, তারা ফতোয়াবাজদের সঙ্গে মিশেছে। তার মানে কোনোরকম পার্থক্য নেই। তাহলে আমরা দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছি কেন? কেন শিক্ষকদের একদল বিএনপি, একদল আওয়ামী লীগ? কেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার সবাই দুটি দলে বিভক্ত- এ প্রশ্নগুলোর উত্তর না পেয়ে মাঝে মধ্যে লেখক হিসেবে খুব হতাশা বোধ করি। আমার মনে হয়, যারা ছাত্র তারা রাজনীতি করবে কেন? ছাত্ররা করবে পড়াশোনা।

ইউরোপ-আমেরিকা, পৃথিবীর আর কোথাও আছে ছাত্র রাজনীতি? রাজনীতিও তো একটা পেশা। আমরা কাউকে পিওনের চাকরি দেওয়ার সময়ও তো তার যোগ্যতা যাচাই করি, তাহলে একজন রাজনীতিবিদের যোগ্যতা যাচাই করি না কেন? আমাদের দেশে এত প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশভর্তি কয়লা, গ্যাস আর এ গ্যাসের নিচেই আছে তেল। আজকে আমেরিকানরা আমাদের জন্য এত লাফালাফি-ঝাঁপাঝাঁপি করে কেন? আমেরিকান এ বিউটেনিস- ব্যাগ একটা হাতে নিয়ে তার এত দৌড়াদৌড়ি এত ঝাঁপাঝাঁপি! পৃথিবীর কোন দেশের আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এ কাজটা করে? কারণটা কি জানো? কারণটা হচ্ছে স্যাটেলাইট! স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তারা জানে বাংলাদেশের ভেতরে কি আছে। প্রতি রাতে সারা পৃথিবীতে কতগুলো লোক না খেয়ে ঘুমাতে যায় জানো? হিসাবটা জেনে রাখো, ৮৫ কোটি লোক! সৃষ্টির সেরা জীব রাতে ঘুমাতে যাচ্ছে না খেয়ে! কষ্টটা বুঝতে পার? একটা ঘটনা শোন, ছফা ভাইয়ের (আহমদ ছফা)’র সঙ্গে আমার একদিন দেখা হলো।

রিকশা করে তিনি যাচ্ছেন, মুখটুখ শুকনা! তাকে থামিয়ে বললাম, ‘ছফা ভাই, আপনাকে এমন লাগছে কেন? ছফা ভাই বললেন, ‘হুমায়ূন,আমিতো দুইদিন না খাইয়া আছি, ক্ষুধাটা বোঝার চেষ্টা করতেছি; একটা বই লেখব তো ক্ষুধার ওপর! ক্ষুধা, দারিদ্র, দুর্নীতি, বিদেশি প্রভাব- এদের হাত থেকে বাঁচার উপায় কি? উপায় অবশ্যই আছে এবং সে পথে মিডিয়ার হাত ধরে আমরা অনেকখানি এগিয়েও যাচ্ছি। এটাই বিশাল অগ্রগতি। তবে জাতিগতভাবে আমাদের কিছু ক্ষুদ্রতা আছে। আমরা দ্রুত ভুলে যাই! দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করার জন্য আমরা কত রক্ত দিয়েছি। অথচ সেই স্বৈরাচারকে দলে নেওয়ার জন্য কি দড়ি টানাটানি! রাজনীতিবিদরা শুভবোধসম্পন্ন হলেই কেবল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সম্ভব।

আর আমরা যখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াব, অন্যদের কিন্তু খবর আছে! এখনই আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ! পৃথিবীর কয়টা দেশে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ? এত প্রাচুর্যতা সত্ত্বেও আমরা এত পিছিয়ে কেন? এক সময় আমরাই বরং আগায়া ছিলাম। আমাদের এখানে যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, তখন তো আমেরিকান-ইউরোপিয়ানগুলা বান্দর হইয়া গাছে গাছে ঝুলতেছে! সেখান থেকে আজকে আমাদের এ অবস্থা কেন? আমাদের অভাবটা কিসের? আমাদের একটা কৃষক সূর্য ওঠার আগ থেকে সূর্য ডোবার পর পর্যন্ত কাজ করেন। আমাদের কি মেধা বা স্বপ্নের অভাব আছে? জাপানের সঙ্গে তুলনা করি। জাপানে সমুদ্র আছে, আমাদেরও সমুদ্র আছে। ওদের প্রধান খাদ্য ভাত-মাছ, আমাদেরও তাই।

দু’দেশের জনসংখ্যাই অধিক। আজ ওরা কোথায় আর আমরা কোথায়? একটা তথ্য জানিয়ে দেই, পৃথিবীর সুপেয় পানির রিজার্ভের ১৬ ভাগই বাংলাদেশে। বাইরের দেশগুলোতে যখন যাই, তখন বিখ্যাত হ্যারল্ড কোম্পানির শার্টগুলো ওল্টালেই দেখি লেখা, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। তখন যে আনন্দ পাই সেটা তুলনাহীন আনন্দ। এমন মুহূর্তগুলোতে অজান্তেই আমার চোখ ভিজে ওঠে।

একবার আমেরিকান এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি, হঠাৎ দেখি ওপরে লেখা ‘উই সার্ভ দি স্পেশাল লবস্টার ফ্রম বাংলাদেশ’। নতুন প্রজন্মের কাছে আপনার প্রত্যাশা কতটুকু? এ প্রজন্মটা নিয়ে আমি একটু কনফিউজড। কারণ ওদের মেধা যেমন বেশি তেমনি ওদের সামনে গর্ত, খানা-খন্দও বেশি। আমি যখন শুনি ইংরেজি স্কুলগুলোতে নেশাদ্রব্য খুবই সহজলভ্য, ওরা গাঁজাটাজা খাচ্ছে, বয়স ১৫ না হতেই বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে! তখন আমি একটা ধাক্কার মতো খাই, আমার কাছে মনে হয় কোথাও বড় ধরনের কোন সমস্যা আছে। একবার মনে হয় শিক্ষক-অভিভাবক কেউই ঠিকভাবে তাদের শিক্ষা দিতে পারছেন না।

আবার মনে হয় সমাজ তো তার নিজের গতিতেই চলে, ওদের বিধি-নিষেধের বেড়াজালে বন্দি করে কি লাভ! নতুন প্রজন্মের ওপর আপনার আস্হা কেমন? ওদের ওপর আমার আস্হা অবশ্যই আছে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, দেশের প্রতি ওদের মমতাটা আমাদের তুলনায় অনেক কম! ওদের ভিশনটা বাইরের প্রতি। এর কার্যকারণ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে ওদের দোষ দেয়া যাবে না, কারণ ওরা হচ্ছে ‘সিটিজেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। যদিও উন্নত বিশ্বের সুবিধাটা ওরা পাচ্ছে না, তবে সুখের ব্যাপার হচ্ছে, ওরা রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে।

আপনি তো বিশ্বাস করেন আপনার স্বপ্নগুলো রঙিন। সে রঙিন স্বপ্নগুলো কি নিয়ে? আমাদের দেশটা নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখি। লেখকদের নাকি একটা তৃতীয় নয়ন থাকে, আমি জানি না আমার আছে কি-না। যদি থাকে তাহলে সে নয়ন দিয়ে আমি দেখতে পাই, আমেরিকানরা বাংলাদেশে আসার জন্য ভিসার আশায় লাইন দিচ্ছে; কিন্তু আমরা ভিসা দিচ্ছি না! আমার বিশ্বাস, এটা আমি আমার জীবদ্দশাতেই দেখে যেতে পারব। আমাদের দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোর সততাই আমাকে এ সাহস জুগিয়েছে।

শত দুঃখেও তারা হাসতে পারে! আমার আরেকটা স্বপ্ন আছে, সেটা শুনলে তোমরা একটা ধাক্কার মতো খাবে! আমার স্বপ্নটা হলো, ২০২০ সাল পর্যন্ত কোনোরকম বেঁচে থাকা! এর কারণ হলো ২০২০ সালে মানুষ প্রথম মঙ্গল গ্রহে পা দেবে- আমি এ মহান দৃশ্যটি দেখে মরতে চাই....! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.