আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অলিম্পিকের গল্পঃ স্বাধীনতা! হে প্রিয় স্বাধীনতা!

“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, ‍স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” বার্লিন অলিম্পিকের ম্যারাথন দৌড়ের বিজয়ীরা অলিম্পিকের ইতিহাসে উপরের ছবিটি একটি আইকনিক ছবি। ছবিটি ১৯৩৬ সালের ৯ আগস্ট বার্লিন অলিম্পিকে তোলা হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, অলিম্পিক ম্যারাথন দৌড়ের পর তিনজন এথলেট বিজয় স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবিতে একদম পিছনে আছেন রৌপ্য বিজয়ী ব্রিটিশ আর্নি হারপার। তিনি এমনিতেই লম্বা, এছাড়া তাঁর হাসিতেও একটা গর্বিত ভাব আছে।

তাঁর সামনে আছেন যথাক্রমে স্বর্ণ আর ব্রোঞ্জ পদকজয়ী দুই জাপানিজ দৌড়বিদ, তাঁদের মধ্যে একজন ওক ট্রি দিয়ে গেঞ্জির মাঝে এম্বুশ করা জাপানের পতাকাটিকে ঢেকে রেখেছেন। তাঁরা জাপানিজ? তাঁদের মুখে হাসি নেই কেনো? তাঁরা মাথা নত করে আছেন কেনো? ১৯৩৬ থেকে এবারে একেবারে ১৯৮৮ সালে চলে যাচ্ছি। ১৭ই সেপ্টেম্বর। সিউল অলিম্পিক স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক অপেক্ষা করছে দেখার জন্য মশাল হাতে কে প্রবেশ করবে! হঠাৎ করে ৭০ বছর বয়স্ক একজন চির তরুণ মশাল হাতে প্রবেশ স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন। কেউ কেউ তাঁকে চিনতে পারলেন না, কিন্তু অধিকাংশই মনে করতে পারলেন ১৯৩৬ সালের সেই দৌড়বিদকে, যিনি ওক ট্রি দিয়ে পতাকা আড়াল করেছিলেন।

স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৮০০০০ দর্শক দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানালেন। তিনি সেই দৌড়বিদ, যিনি বার্লিন অলিম্পিকে ম্যারাথনে স্বর্ন পেয়েছিলেন। কিন্তু সিউল অলিম্পিকে তো কোরিয়ান নাগরিকের মশাল হাতে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার কথা! তাহলে তিনি কি কোরিয়ান? এবার আরও একটু এগিয়ে যাচ্ছি। ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিক। দক্ষিন কোরিয়ার হোয়াং ইয়াং চো জাপানের কোইচি মরিশিতাকে হারিয়ে ম্যারাথনে সবেমাত্র জিতলেন।

দর্শক সারিতে বসা এক বৃদ্ধকে দেখা গেলো অঝোর ধারায় কাঁদতে। একটু ভালোভাবে লক্ষ করার পর দেখা গেলো তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকে স্টেডিয়ামে মশাল হাতে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে জাপানের হয়ে ম্যারাথনে স্বর্ন পদক জয় করেছিলেন। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৯২ সালে এক কোরিয়ানের ম্যারাথন জয়ে প্রচণ্ড আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু কেনো এই আবেগ? ইতিহাসের দিকে তাকাই।

সেখানে দেখা যায় ১৯১০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত কোরিয়া ছিলো জাপানের অধীনে। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকের সময়ও স্বভাবতই কোরিয়ার খেলোয়াড়দের জাপানের নামে খেলানো হয়। এভাবেই শন কি চুং এবং নাম সুং উং- এই দুইজন কোরিয়ান নাগরিককে জাপানের হয়ে খেলতে হয় এবং ৯ই আগস্ট অনুষ্ঠিত ম্যারাথন দৌড়ে শন কি চুং স্বর্ণ এবং নাম সুং উং ব্রোঞ্জ পদক পান। এঁরা দুইজনেই জাপানের নামে খেলেন, কিন্তু হৃদয়ে ছিলো প্রিয় মাতৃভূমি কোরিয়া। তাই তো বিজয় স্তম্ভে শন ওক ট্রি দিয়ে জাপানের পতাকা ঢেকে রাখেন।

কিন্তু নামের কাছে পুরষ্কার হিসেবে কোনো ওক ট্রি না থাকায় তিনি জাপানের পতাকাটিকে আড়াল করতে পারেন নি। অলিম্পিকে শন কি চুং- এর নামটিকেও জাপানি উচ্চারণে শন কির্টে দেখানো হয়। ম্যারাথনে বিজয় হবার পর শন কোরিয়ান ভাষায় বার বার বলছিলেন তিনি কোরিয়ান নাগরিক। কিন্তু দোভাষীর কাজ করা জাপানিজ সেই কথাটিকে পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে কখনই প্রকাশ করেনি। যে কারণে ম্যারাথন দৌড়ের পরের দিন গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা হয়েছিলো “জাপান তিনজন অসাধারণ দৌড়বিদকে এবার বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেছে।

তাঁরা হচ্ছেন, শন- ম্যারাথন বিজয়ী, নাম- সেই একই দৌড়ের তৃতীয় এবং কোহেই মুরাকোসো, যিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যে ৫০০০ এবং ১০০০০ মিটার দৌড় শেষ করতে সক্ষম"; অথচ তিনজনই কোরিয়ান! শন যতদিন বার্লিনে ছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন সবাইকে জানাতে যে তিনি জাপানিজ না। তিনি তাঁর নাম কোরিয়ান অক্ষর দিয়ে স্বাক্ষর করতেন, অটোগ্রাফের পাশে প্রায়ই ছোট করে কোরিয়ার ছবি আঁকতেন। এদিকে সারা বিশ্বে তিনি যখন পরিচিত হচ্ছিলেন জাপানিজ হিসেবে, তখন কোরিয়ার সংবাদপত্রগুলোতে শনের ছবিতে জাপানের পতাকাটিকে মুছে দেওয়া হচ্ছিলো। কোরিয়ার দৈনিক Dong- A llbo, যা এখনও প্রকাশিত হচ্ছে, ১৯৩৬ সালের ২৫ আগস্টে শনের ছবি প্রথম পাতায় ছাপে, জাপানের পতাকাটিকে মুছে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকার পত্রিকাটিকে ৯ মাসের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং এর ৮ জন কর্মচারীকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালায়।

শন কি চুং ১৯১৪ সালে বর্তমান উত্তর কোরিয়ার এক গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ততদিনে কোরিয়া জাপানের অধিকারে। তিনি তাই স্কুলে জাপানিজ ভাষা শিখতেন, কিন্তু গোপনে শিখতেন নিজের মাতৃভাষা। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছিলেন স্কুলের বন্ধুদের সাথে, যারা সাইকেলে চড়তো আর শন পা দিয়ে দৌড়াতেন! স্কুলের শিক্ষকরা তাঁর প্রতিভা বুঝতে পারার সাথে সাথেই তাঁকে সিউলে পাঠিয়ে দেন প্রশিক্ষণের জন্য। তিনি সেখানে পিঠে পাথর বেঁধে এবং পকেটে বালি ভর্তি করে দৌড়াতে লাগলেন।

প্রশিক্ষণ খুব ভালোভাবে কাজ দিলো। তাঁর বয়স যখন ১৭ বছর, প্রথম ম্যারাথনে বিজয়ী হোন। পরবর্তী ৫ বছর, অর্থাৎ ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে ১২টি ম্যারাথনের ৯ টিতে জয়লাভ করেন। এমনকি টোকিও ম্যারাথনে তিনি বিশ্বরেকর্ডও করেন। এত কিছুর পরেও ১৯৩৬ সালে ১২ দিনের ট্রেন জার্নি করে তিনি বার্লিনে আসেন জাপানের প্রতিনিধি হিসেবে, জাপানিজ নাম নিয়ে।

ম্যারাথন দৌড়ে ১৯৩২ সালের অলিম্পিকের ম্যারাথন বিজয়ী আর্জেন্টিনার জাবালা ছিলেন ফেভারিট। স্বভাবতই দৌড়ের প্রথম দিকে জাবালাই এগিয়ে ছিলেন, পিছনে ছিলেন শন কি চুং এবং নাম সুং উং সহ ৫৬ জন। তিন মাইল পর জাবালার খুব কাছেই চলে এসেছিলেন শন। তিনি যখন জাবালাকে অতিক্রম করার জন্য গতি বাড়াবেন, ঠিক তখনই পিছন থেকে কেউ একজন কথা বললেন- আর্নি হারপার। হারপার শনকে বললেন, “এখনই অতিক্রম করার দরকার নেই, জাবালাকে পরিশ্রান্ত হতে দাও”, শন হারপারের ইংরেজি না বুঝলেও, মূলভাবটা বুঝতে পেরেছিলেন।

পরের ১৪ মাইল শন এবং হারপার পাশাপাশি দৌড়ান। এবং ১৯ মাইল পর পরিশ্রান্ত জাবালার গতি ধীর হয়ে গেলে তাঁরা দুইজনেই একসাথে জাবালাকে অতিক্রম করেন। শেষ ১০ মিনিট হারপারের পায়ে ব্লিষ্টার দেখা দেয়, জুতা রক্তে ভরে যায়। এই সময়েই শন হারপারকে অতিক্রম করে প্রথমে চলে আসেন। শন কি চুং বার্লিন অলিম্পিকে ম্যারাথনে ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করছেন দৌড়ের শেষ দিকে শনেরও পায়ে ব্যাথা শুরু হলো।

তারপরও তিনি দৌড়াতে লাগলেন, স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন এবং শেষ রেখাও অতিক্রম করলেন এবং স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালেন। না, সেখানে তাঁর নাম নেই- আছে তাঁর নামের জাপানিজকরণ, তাঁর নিজের দেশ কোরিয়া অনুপস্থিত, কিন্তু আছে সেই দেশের নাম যা তাঁর নিজের দেশকে দখল করে আছে! সেই রাতে জাপানিজ কর্মকর্তা এবং খেলোয়াড়েরা ম্যারাথন বিজয় উপলক্ষ্যে এক পার্টি দেয়। অথচ সেই পার্টিতে শন কিংবা কোরিয়ান কোনো খেলোয়াড় ছিলেন না। সেই সময়টাতে তাঁরা ছিলেন কোরিয়ান জাতীয়তাবাদী এক নেতার বাড়িতে, যেখানে শন জীবনে প্রথম বারের মতো নিষিদ্ধ ঘোষিত কোরিয়ার জাতীয় পতাকা গায়ে দেন। স্বর্ন পদক ছাড়াও শন একটি ব্যতিক্রমধর্মী পুরষ্কার পান।

তিনি একটি গ্রীক ব্রোঞ্জ হেলমেট পুরস্কার হিসেবে পান, যেটা ১৮৭৫ সালে করিন্থের কাছে আবিষ্কৃত হয়। ধারণা করা হয়, হেলমেটটি গ্রীক কারিগরদের দ্বারা ৭৫০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের দিকে তৈরী করা হয়। কিছু নিরাপত্তাজনিত কারণে এই হেলমেটটি তখন বার্লিনেই রেখে আসা হয়েছিলো। ১৯৮০ সালে এটি কোরিয়াকে ফেরত দেওয়া হয়। এই সেই গ্রীক ব্রোঞ্জ হেলমেট।

শন পরবর্তীতে এটি কোরিয়ার জাতীয় যাদুঘরে দিয়ে দেন, যেখানে এটি এখন সংরক্ষিত আছে “National Treasure No. 904.” নামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শন কোরিয়ান ম্যারাথন দলের প্রধান কোচ হোন। বার্লিনের ঘটনার ১৪ বছর পর, কোরিয়া তখন জাপান মুক্ত, শন একদল কোরিয়ান দৌড়বিদকে নিয়ে ১৯৫০ সালের বোষ্টন ম্যারাথনে অংশগ্রহন করতে যান, সেটা ছিলো কোরিয়ান পতাকার অধীনে প্রথম কোনো প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ। তারপর তিনি ১৯৮৮ সালের সিউল অলিম্পিকের মশাল নিয়ে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন। এবং ১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিকে তাঁরই উপস্থিতিতে তাঁর শিষ্য হোয়াং ইয়াং চো সেই শাসক দেশ জাপানের প্রতিযোগীকেই পরাজিত করে কোরিয়ার ইতিহাসে ম্যারাথনের দ্বিতীয় স্বর্ণ জয় করেন (প্রথমটি শনের, জাপানের নামে), একই সাথে শনের বুকে ৫৬ বছর ধরে জমে থাকা একরাশ লজ্জা, ঘৃণা আর হতাশাকে দূর করেন। এই মহান এথলেট ২০০২ সালে ৯০ বছর বয়সে সিউলের কাছে তাঁর মেয়ের বাড়িতে মারা যান।

মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি বলে গিয়েছিলেন, "The Japanese could stop our musicians from playing our songs. They could stop our singers and silence our speakers. But they could not stop me from running." (ঘুরে আসুন আমার সুড়ঙ্গ থেকে, দেখে আসুন অনেক কিছু)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.