আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্রাদারহুড

মিসরে এখন চলছে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড-সমর্থিত রাজনৈতিক নেতাদের শাসন। দশকের পর দশক ধরে রেস্তোরাঁ, মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপন বৈঠক করার পর দেশটির একসময়ের নিষিদ্ধ এই গোষ্ঠী-সমর্থিত নেতা-কর্মীরা এখন সরব হয়ে উঠেছেন। এখন আর গোপনে নয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও মতামত ঠাঁই পেয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট ভবন ও প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে। তবে তাঁদের এই কর্মকাণ্ড সাবলীলভাবে কত দূর এগিয়ে যেতে পারবে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার শরিকদের জন্য অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে এসেছে।

আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই েশে মুসলিম ব্রাদারহুডের ছত্রছায়ায় থাকা দলগুলো এখন শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সাফল্য মুসলিম ব্রাদারহুডকে এখন দুই কূল রক্ষার কঠিন এক চাপে ফেলেছে। একদিকে আছে রক্ষণশীল মুসলিমদের সন্তুষ্ট রাখা, যারা দলটিকে ভোট দিয়ে তাদের সমর্থন জানিয়েছে। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের মিসরীয়রা ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী দেশের সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন চায় না। তাদেরও মন রক্ষার চেষ্টা করতে হবে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সরকারকে।

এখনো পর্যন্ত সমঝোতামূলক একটা অবস্থা দেখা যাচ্ছে। যেখানে, সম্পূর্ণভাবে কোনো এক পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখা না গেলেও, অন্তত বড় ধরনের বিবাদ এড়িয়ে চলার কৌশল নিয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুড। চলতি মাসে মিসর সফরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে কোনো একটা দলের পক্ষ নেবে না যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে এ অবস্থায় একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে মিসরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ব্রাদারহুডের জন্য এক চ্যালেঞ্জই বটে। যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক আন্দোলনের এক বিশেষজ্ঞ খলিল-আল-আনানি বলেন, ‘ব্রাদারহুডের জন্য সবকিছুই যেন হয়ে উঠেছে মীমাংসা ও আলোচনার বিষয়।

’ তিনি বলেন, দলটি বুঝতে পারছে, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে তা তাদের রাজনৈতিক প্রাপ্তিকে বিপদগ্রস্ত করতে পারে। একই সঙ্গে সমাজের রক্ষণশীলদেরও সন্তুষ্ট রাখতে হবে। এদিকে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীরা ভয় পাচ্ছে, ইসলামপন্থী এই সরকার জনগণের পোশাক নির্ধারণেও হস্তক্ষেপ করবে? তাদের হাতে কি সংগীত-সিনেমার মৃত্যু ঘটবে? কিংবা প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করবে? আর এ ব্যাপারে মিসরের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ খ্রিষ্টানদের উদ্বেগটাই বেশি। এ ছাড়া দেশটির পর্যটন ব্যবসায়ীরা ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের ওপর আবার কোনো খড়্গ নেমে আসে কি না? ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুরসি। পাশাপাশি ইসলামের বিধান অনুসারে দেশ পরিচালনার ইঙ্গিতও পাওয়া যায় নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তাঁর দেওয়া বক্তব্যে।

তাগাম্মু বামপন্থী দলের প্রধান রিফাত-এল-সায়ীদ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে তারা কী করছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কাজেই পুনঃপুন প্রতিশ্রুতি এখানে অর্থহীন। ’ কিছু মিসরীয় এ কারণে উদ্বিগ্ন যে ইসলামপন্থীদের সাফল্যে গোঁড়া ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো সাহস ও আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করেছে। পথেঘাটে তারা এখন তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে তত্পর হতে পারে। মুরসি জয়লাভের কয়েক দিন পর সুয়েজ শহরে প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বের হলে এক তরুণকে ছুুরিকাঘাতে হত্যা করে তিনজন লোক, যারা কিনা ‘ফাইট ভাইস অ্যান্ড প্রমোট ভার্চু’ (পাপ ঠেকাও, পুণ্য বাড়াও) নামের একটি অবৈধ দল গঠনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে।

ব্রাদারহুড অবশ্য বলছে, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং তাদের দলের সদস্যদের ছদ্মবেশ ধারণ করে মোবারকের সমর্থকেরাই এসব করছে। কাজেই মিসরের সমাজ-ব্যবস্থার আধুনিকায়নে পরিবর্তন বা রূপান্তর কতটা এগিয়ে নিতে পারবে ব্রাদারহুড, তা এখন দেখার বিষয়। ১৯২৮ সালে শহুরে বুদ্ধিজীবীদের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রকৌশলী, শিক্ষক ও চিকিত্সকদের দ্বারা পরিচালিত দলটি বলছে, তারা মিসরকে ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় না। অর্থনীতির বিচারে সরকারকে মূল্যায়ন: ব্রাদারহুড ভালোভাবেই জানে যে মিসরীয়রা প্রথমেই দেখবে এই দলটি দেশের গভীর খাতে পড়ে যাওয়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পারছে কি না, দারিদ্র্য দূর করতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কি না।

তার মানে দেশটির পর্যটন বা বাণিজ্য খাতে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা এড়াতে উত্সাহব্যঞ্জক পদক্ষেপ নিতে হবে। মিসরে একটি আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক দেশ পরিচালনা করতে চায় ব্রাদারহুডের সদস্যরা। দলটির নির্বাহী বোর্ডের এক কর্মকর্তা শেখ আবদুল রহমান আল-বার বলেন, শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করে দেশের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও পুলিশের অন্যায় আচরণ (যেমন: অত্যাচার-নিপীড়ন ও আড়িপাতা) দূর করে এবং যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রয়োগ করবে বর্তমান সরকার। তিনি বলেন, ‘যেখানেই সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিছু দেখবেন, সেটাই আল্লাহর আইন। ’ আবদুল রহমান আরও বলেন, ‘জনগণের পোশাকের ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান আরোপ করা হবে না।

ইদানীং নারীদের মধ্যে স্বেচ্ছায় মাথায় স্কার্ফ পরার চল বেড়ে গেছে। আমরা তো সেটা না পরতে তাদের বাধা দিতে পারি না। পোশাক-আশাকের ব্যাপারে সৈকতের পর্যটকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। ’ ব্যাংক সুদের ব্যাপারেও ব্রাদারহুড শরিয়াহ অনুসরণ করতে পারে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামে সুদ হারাম হলেও মিসরে তা বিলোপ করা যাবে না।

অন্যান্য বিবেচ্য বিষয়: আশঙ্কার কথা হলো, কট্টর ইসলামি সংগঠনগুলোও শরিয়া আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনার কথা বলে আসছে। এর মধ্যে নব্বইয়ের দশকে দেশের আইনকানুনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া আল গামা আল-ইসলামিয়াও রয়েছে। এই দলটি এখন ন্যায়বিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান এবং অবৈধ ও বিনা বিচারে কাউকে বন্দী রাখার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলছে। মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত হত্যায় সংশ্লিষ্টতার দায়ে ৩০ বছর জেল খাটা তারেক আল জুমর বলেন, ‘আর এসবই শরিয়াহর প্রধান বিষয়। ’ আল গামা দলের সাবেক সদস্য ও ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর বিশেষজ্ঞ কামাল হাবিব বলেন, গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি এখন মূলধারার রাজনীতিতে চলে এসেছে।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানে দলগুলো শরিয়াহকে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তারা দেখল, সমাজে অত্যন্ত জটিল কিছু বিষয়ের মুখোমুখি হচ্ছে তারা। তখন তারা আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসে। এ জন্য ইসলামপন্থীরা এখন সমাজে তাদের রক্ষণশীল সমর্থকদের কাছে গর্বের বিষয় বলে পরিচিত ক্ষেত্রগুলোতে সুসংহত ও টেকসই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে। পার্লামেন্টের প্রথম কয়েক মাসের অধিবেশনে কয়েকটি ইসলামিক দলের নবনির্বাচিত আইনপ্রণেতারা বিচ্ছেদে নারীদের অধিকার বন্ধ করার চাপ দিচ্ছেন।

এ ছাড়া ধর্ম অবমাননার শাস্তিও কঠোর করতে চাইছেন তাঁরা। যদিও এসব প্রস্তাব হিসেবেই পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হয়েছে। এসবের কোনোটিই এখনো আইনে পরিণত করা হয়নি। এ ব্যাপারে ব্রাদারহুডের কর্মকর্তা আবদুল রহমানের ভবিষ্যদ্বাণী অনেকটা এ রকম, মদ উত্পাদন ও বিপণনের সঙ্গে মুসলিমদের সংশ্লিষ্টতায় নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। অবশ্য, অমুসলিমরা এর বাইরে থাকবে।

মিসরের নতুন সংবিধানে ইসলামিক আইনের ভূমিকাই সবকিছু নির্ধারণ করবে—যারা এটা ভাববে, তাদের হাতে সংবিধান থাকাটা ভয়ংকর বলে দাবি করছেন শাহাতা মোহামেদ শাহাতা নামের এক আইনজীবী। আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস হিসেবে একটি প্রস্তাবনা সংবিধানে যুক্ত হতে পারে। এ ছাড়া কায়রোর হাজার বছরের প্রাচীন আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে ইসলামিক আইনের ব্যাখ্যার ভার দেওয়া হতে পারে। এ জন্য আরেকটি প্রস্তাবনা আসতে পারে সংবিধানে। এ ব্যাপারে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ আনানি বলেন, ‘আল-আজহারের ব্যাখ্যা যদি গণতন্ত্রের পক্ষে না যায়, তবে তখন কী হবে?’ তবে এ ব্যাপারে তাঁর পূর্বাভাস হলো, ব্রাদারহুড আপসমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।

কারণ ক্ষমতায় থাকার জন্য দলটি সম্ভাব্য সবকিছুই করতে পারে। রয়টার্স ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.