আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাণ্ডা বেড়ি’র অমানবিকতা আর কতকাল!

আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত স্বাধীন হয়েছি সেই কবেই। কিন্তু বর্গী শাসনের কালা-কানুন জগদ্দল পাথরের মতোই চেপে আছে এখনও বুকের ওপর। খোদ আদালতের সামনেই নিত্য দৃষ্টিগোচর হয় এমনই একটি দৃশ্য।

এটা হচ্ছে অভিযুক্তদের হাতে পায়ে পরানো ডাণ্ডা বেড়ি এবং আড়ুয়া বেড়ি। তথাকথিত আইন প্রতিপালনের নামে কখনো প্রতিহিংসাবশতঃ আবার কখনো অর্থোপার্জনের জন্য এইসব বেড়ি পরানো হয়। কারাগারে বন্দিদের শায়েস্তা করার জন্য রয়েছে নানাধরণের শাস্তির ব্যবস্থা। ডান্ডা বেড়ি এবং আড়ুয়া বেড়ি হচ্ছে এমনই দুটি শাস্তি। ডান্ডা বেড়ি হচ্ছে বন্দী বা বিচারাধীন অভিযুক্ত ব্যক্তির পায়ে মোটা লোহার রিং পড়িয়ে তাতে শেকল এঁটে তা ওই বন্দির হাতে ধরিয়ে দেয়া।

কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সময় পর্যন্ত তাকে এটি পড়ে থাকতে হবে। ওঠা, বসা, হাঁটা, চলা, ঘুমানো সবই এ বেড়ি পড়েই করতে হয় সংশ্লিষ্ট বন্দির। যারা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে অবাধ্য তাদেরকে দু’পায়ে রিংয়ের সাথে একটি একফুট লম্বা লোহার রড লাগিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বন্দি দু’পা একত্র করতে পারে না। তাকে হাঁটতে হয় দু’পা ফাঁক করে, ঘুমাতে হয় চিৎ হয়ে বা উপুড় হয়ে।

এর নাম আড়ুয়া বেড়ি। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন শাস্তির নামে, বিচারের নামে কি নির্যাতন চলে মানুষের ওপর। প্রসঙ্গত, আমাদের পবিত্র সংবিধানে মানুষকে নির্মম ও হিংস্র শাস্তি দানের বিপক্ষে বলা হয়েছে। সাধরণত, একসঙ্গে ৩টি মামলার আসামি হলে তাকে কোর্টে নেয়া হয় ডান্ডা বেড়ি পড়িয়ে। এসব বেড়ি সব একই মাপের।

ফলে ওইসব বেড়ি পরিহিত অপেক্ষাকৃত খবৃকায় বা দীর্ঘকায় ব্যক্তি বিশেষের ভোগান্তি দেখে চোখে জল এসে যায়। কোর্টের সিঁড়ি ভেঙ্গে অভিযুক্তদের যখন আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়, তখন তাদের কষ্ট মেনে নেয়া যায় না। অনেকে সিঁড়িতে উপুর হয়ে পড়ে যান। এতটুকু থামার ফুরসৎ নেই। তখনও সামনে থেকে নয়তো পেছন থেকে তাড়িয়ে নেওয়া হয় গবাদি পশুর মত।

তবে এ ব্যবস্থা অবশ্য সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য নয়। এখানেও আছে বৈষম্য। শুধু যাদের কেউ নেই, নেই কোনো রাজনৈতিক বা সম্মানিত খেলাপীর তকমা এ শুধু তাদের জন্যই। রাষ্ট্রের চোখে যেন কেবল এরাই অপরাধী। ৩ মামলা কেন ৩০ মামলার অভিযুক্ত বা অপরাধী রাজনৈতিক ব্যাক্তিদেরকে বেশীরভাগ সময় জামাই আদরেই আনা-নেওয়া করা হয় কোর্টে।

কারাগারেও মাশাল্লাহ্ জামাই আদরেই থাকেন তারা। অবশ্য সরকারের কোপানলে পতিত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ডিমোশন লক্ষ্য করা যায় মাঝে মধ্যে। কারাগারেও অনেককে সার্বক্ষণিক এ ডান্ডা বেড়ি পড়িয়ে রাখা হয়। তাই বন্দিরা ডান্ডা-বেড়ি আতংকে ভোগে সবসময়। এজন্য সুবেদার বা জমাদারকে খুশী রাখতে বন্দিদের সার্বক্ষণিক সচেষ্ট থাকতে হয়।

জেল কোডের ভিত্তিতে জেল হেফাজতে কাউকে ডান্ডা-বেড়ি বা হাত-কড়া পড়ানো হয়। এই বিধান গড়ে উঠেছে ১৮৯৪ সালের প্রিজন অ্যাক্ট, ১৯৮১ সালের প্রিজনার্স অ্যাক্ট এবং ১৮১৮ সালের ৩ নম্বর রেগুলেশনের ভিত্তিতে। শেষেরটি বেঙ্গল কোড নামেই পরিচিত। জেলের ভেতর কেউ অপরাধ করলে তার নিষ্পত্তির নিয়ম রয়েছে জেল কোডের ১৯ নং অধ্যায়ে। এ অধ্যায়ের ৭০৮ নং বিধান অনুযায়ী জেল সুপারিনটেনডেন্ট কারাগারের অভ্যন্তরে অপরাধের জন্য ১১ধরণের লঘু ও ১১ধরনের গুরুতর শাস্তি বিধানের ক্ষমতা প্রাপ্ত।

গুরুতর শাস্তির মধ্যে রয়েছে সকল বন্দিদের থেকে আলাদা করে কাউকে ৭দিনের জন্য কোনো সেলে আটক রাখা, ৩০ দিনের জন্য ডান্ডা-বেড়ি পড়ানো ইত্যাদি। অপরাধী সাব্যস্তকরণের কোনো সাবলীল নিয়ম নেই। কর্তার ইচ্ছায় এখানে কীর্তন হয়। তিনি অপরাধী মনে করলে অপরাধী। তাছাড়া কোনো অপরাধই অপরাধ না।

তবে এসব শাস্তি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্ত কিছু কিছু বিশেষ বন্দিদের ক্ষেত্রে অতি বিরল পরিস্থিতিতে প্রয়োগের বিধান রয়েছে। বিচারাধীন আসামি বা রাজবন্দীদের এধরণের গুরুদণ্ড দেয়া যায় না। কারণ ৭০৮ নং বিধানটি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এই বিধানটিকেও মেনে নেয়া যায় না। যুক্তির ধোপে এটিও টেকে না।

তবুও গায়ের জোর বলে একটা কথা তো আছেই। কিন্তু আমাদের সংবিধান যেখানে মানুষকে নির্মম ও হিংস্র শাস্তি দানের বিপক্ষে সেক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্যাটাগরির জেল বন্দীদের হাত-কড়া এবং ডান্ডা-বেড়ি পড়ানো সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী। তাছাড়া জেল কর্তৃপক্ষ যেভাবে হরহামেশা খেয়ালখুশি মতো বিচারাধীন বন্দি এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং ভাগ্য বিরম্বিত রাজনৈতিক বন্দিদের হাত-কড়া ও ডান্ডা-বেড়ি পড়াচ্ছেন তা বিদ্যমান আইনের সরাসরি লংঘন। এমনটা করার কোনো আইনগত অধিকার তাদের নেই। তারা যুক্তি দেখাবেন যে, নিরাপত্তার কারণে এমনটি করা হচ্ছে।

কিন্তু এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। সংবিধান লঙ্ঘিত কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ‍ আমাদের সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে আছে, আইনসম্মত নিরপেক্ষ আদালত কর্তৃক প্রকাশ্য বিচার ব্যতিত কাউকে কোনো ধরনের শাস্তি দেওয়া যাবে না। ৩৫ (৫)নং অনুচ্ছেদে বলা আছে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না, কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না। এছাড়া আইনসম্মত অধিকার ছাড়া কারো শারীরিক ক্ষতিসাধন সংবিধানের ৩১ ধারারও লঙ্ঘন।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কারাবন্দিদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে অনুসৃত যে নূন্যতম নীতিমালা তৈরি করেছে সেখানকার ৩৩ নং অনুচ্ছেদে ডান্ডা-বেড়ি পড়ানোকে অমানবিক বলা হয়েছে। বাংলাদেশে কিন্তু স্রেফ বন্দিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যও ডান্ডা বেড়ি পড়ানোর অভিযোগও রয়েছে। তবে চলমান ব্যতিব্যস্ত জীবনের জটিল পাক-চক্রে এরকম শত শত অভিযোগ প্রতিকারহীনতার গহ্বরে মুখ লুকায়। এর মাঝেই এগিয়ে চলছে প্রিয় স্বদেশ। তারপরেও কথা থেকে যায়।

কারণ, কত ব্যাপারেই তো আমাদের উচ্চ আদালত এগিয়ে এসেছে। দিয়েছে কত যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। যদি এ বিষয়ে উচ্চ আদালত একটু দৃষ্টি দিতেন, তবে অবসান হতো যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ অমানবিকতার। হয় তো কেই একজন এগিয়ে আসবেন কোনো একদিন। কোনো এক ভোরে দেশবাসী দেখবে পত্রিকার পাতায় বড় শিরোনামে- “উচ্চ আদালত ডান্ডা-বেড়ি ও আড়ুয়া বেড়ি পরানোকে নিষিদ্ধ করলো।

” শুরু হবে এক নতুন যুগের। এই ইতিবাচক সংবাদটির অপেক্ষায় চেয়ে আছি। লেখক: মানবাধিকারকর্মী বাংলাদেশ সময়: ১১০৯ ঘণ্টা, ২৬ জুলাই, ২০১২ সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।