আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে

আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ ! আমি জানতাম আপনি চলে যাবেন। সেদিনই বুঝে ছিলাম যে দিন পত্রিকায় দেখলাম আপনি শাওন কে বলছেন, “তুমি আমাকে এ হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাও। ওরা (ডাক্তাররা) আমাকে এখানে মেরে ফেলবে। ” জানতাম না আপনার চলে যাওয়াটুকু এতোটা নাড়িয়ে দেবে আমার ভিতর-বাহির। যখন খবরটা জেনেছি তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই ছিল না।

এখন মধ্যরাতে ঝাপসা চোখে মনিটরের দিকে অপলক চেয়ে রই, কী-বোর্ডে পড়ে থাকে নিশ্চল আঙুল। ঝাপসা হয়ে আসা চোখে ভেতর ভেসে উঠে আমার কৈশোর। কতইবা তখন বয়স। বারো/ তেরো হবে। বই পড়ার বদভ্যাস তখন আমার সঙ্গী হয়ে গেছে।

মামার টেবিল গল্পের বইয়ের মতো লাগলো দেখে একটা বই হাত টেনে নিলাম। বইয়ের নাম "ময়ূরাক্ষী", লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সেই প্রথম পরিচয় উপন্যাস নামক জিনিসটা সাথে। আপনার সাথেও। তারপর থেকে যেখানেই পেতাম আপনার লেখা, গোগ্রাসে গিলতাম।

বই কেনার জন্য যা টাকা জমাতাম তার অর্ধেক থাকতো আপনার বই কেনার জন্য, আর বাকীটা অন্যান্যদের। এই তো কদিন আগেই, গ্রীষ্মের ছুটিতে চকবাজারে পুরাতন বইয়ের দোকানে থরেথরে সাজানো আপনার বইগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে আসলাম, পকেট শূন্য বলে। এসএসসি পরীক্ষার পরের কথা। করার তেমন কিছু নেই। এক জায়গায় গিয়ে ইংরেজী বলার কসরত করি।

তেমন সুবিধা করতে পারি না। এছাড়া দিনমান অখন্ড অবসর। এক ভাই ধরে নিয়ে গেলেন সিটি কর্পোরেশন লাইব্রেরীতে। এতো এতো বই। আমি পড়লাম অথৈ সাগরে।

কার বই পড়ি? সমাধান পেলাম সাথে সাথেই। হুমায়ূন আহমেদ আছেন না! একে একে আপনার যত বই ঐ লাইব্রেরীতে ছিল পড়ে শেষ করলাম। "আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই" বইটা পড়তে গিয়ে ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনে পড়ে শেষ করতে না পারায় দ্বিতীয় দিন লাইব্রেরী খোলার আগেই গিয়ে হাজির হয়ে ছিলাম তর সইছিল না বলে। টানা দুইদিন পড়ে বইটা শেষ করার পর যা করলাম, আবার প্রথম থেকে পড়া! এতটা পাগলামী জীবনে আর কোন বই নিয়ে করিনি।

বইটাতে লেখা একটা ঘটনা মনে খুব দাগ কেটে ছিল। আমেরিকায় আপনার শিক্ষা জীবনের প্রথম পরীক্ষায় আপনি পেয়েছিলেন শূন্য, আর সহপাঠী অন্ধ ছেলেটা সর্বোচ্চ। আপনার কোর্স টিচার আপনাকে আগে প্রিলিমিনারী কোর্সগুলা করতে বলেছিলেন। এ ঘটনায় আপনার মাঝে যে জেদ চেপে ছিল তার ফলাফল ছিল, ফাইনাল পরীক্ষায় আপনার ১০০তে ১০০ পাওয়া। এখনো, যদি কখনো সাহস হারিয়ে ফেলি এটা স্মরণ করে নিজকে প্রবোধ দেই, সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি, আরো কিছুটা বাকী।

আপনার সাথে পরিচয়ের শুরুটাই ছিল হিমু দিয়ে। তারপর মধ্যরাতে রাস্তায় হাটতে হাটতে নিজকে কতবার হিমু মনে হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। "হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম" পড়ার পর আমি জটিল হিসাব-নিকাশে পড়ে গেলাম। কাউকে পছন্দ হলে ভাবি, কয়টা নীলপদ্ম একে দেয়া যায়? সব দিয়ে দিলে যদি নিজেই বিপদে পড়ে যাই! এ চক্কর থেকে আমার আর বের হওয়া হলো না। সবকটা নীলপদ্ম নিয়ে একাকী ঘুরে বেড়াই, কোন একদিন কারো কাছে সমর্পণ করবো বলে।

হিমু জোছনা পছন্দ করতো, আপনিও। সারা জীবন অপেক্ষায় ছিলেন জোছনার ফূল ধরবেন বলে। পেরেছিলেন কি না জানি না তবে থৈ থৈ জোছনায় সমুদ্র দেখবো বলে আমার আজো দারুচিনি দ্বীপ যাওয়া হয়নি। কোন একদিন যদি বান ডাকা জোছনায় একাকী সাগর তীরে বসে হু হু করে কেঁদে উঠি তার জন্য আপনি ছাড়া আর কাকেই বা আমি দায়ী করবো? শেষের দিকে এসে আপনার উপর অনেকখানি ক্ষিপ্ত ছিলাম। আপনার লেখাগুলো আগের মতো আর টানতো না।

সেটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমার বয়ঃপ্রাপ্তি কিংবা আপনার অতি বাণিজ্যিক লেখা। আপনি বোধহয় আপনার নিজের চেয়ে প্রকাশকের জন্য বেশী লিখছিলেন। তবুও বইমেলায় বের হওয়া মাত্রই আপনার বইটা সবার আগে কিনতাম। এক বসাতেই শেষ করতাম। অভিমান জেগেছে বলে ভালবাসাতো আর মিথ্যে হয়ে যায়নি।

আপনার অনুপস্থিতি সহজেই মেনে নিয়েছি কিন্তু আপনার বই আর বই মেলাতে আসবে না, অটোগ্রাফ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়বো না এটা এখনো মেনে নিতে পারছি না। আপনি ছিলেন বলেই আমাদের প্রজন্ম বই কিনতে শিখছে, বই পড়তে শিখেছে। আপনার বই পড়েছি জেনে নিঃসঙ্গতার সংজ্ঞা। আমাদের শিখিয়েছেন জোছনা দেখতে, বৃষ্টিতে ভিজতে। আপনি নেই বললেই হলো? আমাদের হৃদ মাজারে থেকে আপনাকে সরাবে সাধ্য কার? আপনি মিশে থাকবেন এই বাংলার জল-জোছনা-বৃষ্টি-বর্ষায়।

প্রিয় হুমায়ূন, আমাদের আশ্চর্য কলম জাদুকর , মেঘের ওপারে বাড়ীতে আপনি ভালো থাকুন। "the king is dead, long live the king" ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।