আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তখন ক্ষণিকের জন্য আদালত নিশ্চুপ ছিলেন। কেন নিশ্চুপ ??

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে হাসপাতাল ইউনিটের ২৫৬ আসামির মধ্যে ২৫৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে ১০০ টাকা করে জরিমানা এবং দু’জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। পিলখানার দরবার হলে স্থাপিত বিশেষ আদালত-১০-এ শনিবার বিডিআরের এসব বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হয়। রায় ঘোষণা করেন এ বিশেষ আদালতের সভাপতি ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পরিচালক (প্রশাসন) কর্নেল খোন্দকার ওবায়দুল আহসান। রায়ে ৩৪ জনকে সর্বোচ্চ সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ছয় জনকে সর্বনিু চার মাস, ২৬ জনকে এক বছর, ১১১ জনকে দু’বছর, দু’জনকে দু’বছর ছয় মাস, ৩৮ জনকে তিন বছর, ১০ জনকে চার বছর, ১১ জনকে পাঁচ বছর, ১৫ জনকে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

সাজাপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ১০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়। বিচার চলাকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ মে ২০৬ নম্বর আসামি সিপাহী (৪৮১৪০) জহিরুল ইসলাম মারা যান। রায় ঘোষণার সময় আদালত তার নাম মামলা থেকে বাদ দেন। শনিবারের রায়ে খালাস পেয়েছেন ৯২ নম্বর আসামি নায়েক মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট (৪৪৮৯৩) মোঃ কুতুব উদ্দিন ও ১৯৮ নম্বর আসামি সিপাহী (৭১৯৯২) মোঃ জাকির হোসেন। এ দু’জন আসামি দোষ স্বীকার করে আদালতের বিশেষ অনুকম্পা প্রার্থনা করেছিলেন।

বিচারিক বিবেচনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন। আর কোন মামলা না থাকলে তাদের শিগগির কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ারও নির্দেশ দেন আদালত। এ মামলায় ৩২ জন আসামি দোষ স্বীকার করে আদালতের কাছে বিশেষ অনুকম্পা চাইলেও ৩০ জনকে সর্বনিু চার মাস থেকে সর্বোচ্চ চার বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত। শনিবার সকাল সোয়া ১০টায় বিশেষ আদালতের বিচারকরা এজলাসে বসেন। এরপর রায় ঘোষণা শুরুর আগে বিশেষ আদালত-১০-এর সভাপতি কর্নেল খোন্দকার ওবায়দুল আহসান মামলার বিচার্য বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা করেন।

এরপরই একজন করে দাঁড় করিয়ে রায় পড়ে শোনানো শুরু করেন তিনি। এ মামলার দ্বিতীয় আসামি সুবেদার (মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট) রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে দাঁড় করিয়ে যখন সাত বছরের সাজার ঘোষণা দেয়া হয়, তখনই তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, ‘আপনি আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিলেন। আল¬াহ এর বিচার করবে। ’ তখন ক্ষণিকের জন্য আদালত নিশ্চুপ ছিলেন। পরে আদালতের সভাপতি মামলার প্রসিকিউটরের উদ্দেশ্যে বলেন, আসামিদের কেউ যাতে কোন কথা না বলে।

আজকে তো তাদের কথা বলার দিন নয়। ’ পরে আবার তিনি রায় পড়ে শোনানো শুরু করেন। রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দু’জন করে কাঠগড়া থেকে কড়া পাহারায় নিয়ে যাওয়া হয় দরবার হলের বাইরে অপেক্ষমাণ প্রিজন ভ্যানে। এসময় অনেক আসামিকেই কাঁদতে দেখা যায়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে শনিবার পিলখানাজুড়ে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা।

পিলখানার সব গেটেই বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। পিলখানার বিভিন্ন স্থানেও সতর্ক অবস্থান নেয় পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। পিলখানার ভেতর প্রবেশের সময় সব যানবাহনকেই তল¬াশি করা হয়। আদালতের গেটে বসানো হয় আর্চওয়ে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা আদালতের ভেতর ও বাইরে ছিলেন তৎপর।

দুপুর সাড়ে ১২টায় রায় ঘোষণা শেষে কর্নেল খোন্দকার ওবায়দুল আহসান বিচারকাজে সহযোগিতার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক ও আদালত সংশি¬ষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। এ মামলার প্রসিকিউটর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল আলীম জানান, সুষ্ঠু বিচারের স্বার্থে ও শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় আদালত বিবেচনায় নিয়েছেন সেগুলো হচ্ছে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৫ ও ১৫২ মোতাবেক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মতো শৃংখল বাহিনীর জন্য প্রণীত নিজস্ব আইনকে সমুন্নত রাখা। দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত এ বাহিনীর শৃংখলা রক্ষার জন্য প্রচলিত আইনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। অপরাধের প্রকৃতির পাশাপাশি আসামিদের আগেকার আচরণবিধি, বিদ্রোহের সময় তাদের পদবি ও নিয়োগ বিবেচনা করা হয়েছে। আসামি ও তাদের নিকটাÍীয়দের স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য কোন স্বীকৃতি এবং বিডিআরে চাকরির ক্ষেত্রে কোন পদক ও মেডেলপ্রাপ্ত কিনা তা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

সর্বোপরি গ্রেফতারের পর থেকে আসামিদের এ পর্যন্ত জেলহাজতে থাকার মেয়াদও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। প্রসিকিউটর আরও জানান, ২০১০ সালের ২৮ এপ্রিল ব্যাটালিয়নের জেসিও নায়েব সুবেদার (মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট) মোঃ নান্নু মিয়া বাদী হয়ে হাসপাতাল ইউনিটের সুবেদার মেজর হাফিজ উদ্দিনসহ ২৫৬ জনকে আসামি করে বিশেষ আদালত-৬-এ অভিযোগ দায়ের করেন। পরে বিশেষ আদালত পুনর্গঠনের পর মামলাটি বিশেষ আদালত-১০-এ স্থানান্তর করা হয়। সর্বমোট ৪০ কার্যদিবসে এ মামলার নিষ্পত্তি করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে ৯৯ জন প্রত্যক্ষদর্শী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

আসামিদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৯ জন। এ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ৪৬ জন পিলখানা হত্যাযজ্ঞ মামলারও আসামি। এ মামলাটি মহানগর দায়রা জজ আদালতের বখশিবাজারের বিশেষ এজলাসে বিচারাধীন রয়েছে। অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ ও আতাউর রহমানসহ ১৫ জন আইনজীবী এ সময় আসামিদের পক্ষে আইনি সহায়তা দিয়েছেন। এছাড়া আসামিদের পক্ষে ফ্রেন্ডস অব দ্য অ্যাকিউজড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মেজর এটিএম রেজাউল করিম।

রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটরকে সহায়তা করেন বিশেষ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল, মঞ্জুর আলম, রফিকুল ইসলাম মিঠু ও প্রশান্ত কুমার কর্মকার। বিশেষ আদালত-১০-এর অন্য সদস্যরা হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধুরী, মেজর এএনএম ফজলুল আজম ও অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শ্রী ভীষ্ম দেব চক্রবর্তী। এর আগে রেকর্ড উইংয়ের ১১১ জন, সেক্টর সদর ইউনিটের ৮৪ জন, রাইফেলস সিকিউরিটি ইউনিটের (আরএসইউ) ১০৯ জন, ২৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের ৬৫৭ জন, সিগন্যাল সেক্টর ইউনিটের ১৮২ জন, ৩৬ ব্যাটালিয়নের ৩০৯ জন ও ১৩ ব্যাটালিয়নের ৬১১ জনকে সাতটি বিদ্রোহ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। পিলখানায় বিদ্রোহের অভিযোগে দায়ের হওয়া ১১টি মামলার মধ্যে সর্বশেষ হাসপাতাল ইউনিটের বিদ্রোহ মামলাসহ আটটি মামলার নিষ্পত্তি করা হল। আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : মামলার প্রসিকিউটর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল আলীম জানান, এ বিদ্রোহ মামলায় ১৮টি অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত বিচার করেছে।

অভিযোগগুলো হচ্ছে মহাপরিচালকের আদেশ অমান্য করে দরবার হল ত্যাগ, নিয়োগধারী হওয়া সত্ত্বেও অধীনস্থদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করা ও বিদ্রোহসংক্রান্ত সংবাদ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করা। ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্রোহ প্রতিরোধ, প্রতিহত ও বাধা প্রদানে বিরত থাকা ও অস্ত্রলুটের সময় বিদ্রোহীদের বাধা না দিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশগ্রহণ। নিয়ম বহির্ভূতভাবে স্বেচ্ছায় পিলখানার বিভিন্ন কোত ও ম্যাগাজিন ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় অন্য রোগীদের সামনে বিদ্রোহের সপক্ষে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া, অনুমতি ছাড়া ওয়ার্ড থেকে বাইরে চলে যাওয়া, স্বেচ্ছায় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ সরিয়ে ফেলা, হাসপাতালের মরচুয়ারিতে গাদাগাদি করে লুকিয়ে রাখা, তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা, অফিসারদের গাড়ি ভাংচুর, বিদ্রোহ সম্পর্কে অবগত হয়ে বিদ্রোহ শুরুর আগে পিলখানা ত্যাগ, দম্ভোক্তিকর ও সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য, বিদ্রোহে সক্রিয় থেকে পরবর্তীকালে অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকা। বিদ্রোহে অবৈধভাবে অস্ত্র ব্যবহারের আলামত পাওয়া ও তাদের নিজস্ব বাক্স, বিছানা, ইউনিফর্ম ও তাদের বাসস্থান থেকে অফিসারদের ব্যবহƒত মূল্যবান সামগ্রী, অস্ত্র, অ্যামুনেশন, গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।

পিলখানার ভেতর গাড়িতে চড়ে মাইকিং করে বিদ্রোহের পক্ষে উত্তেজনাকর ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানের বিষয়টিও অভিযোগ হিসেবে আমলে নেয়া হয়। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ধারণকৃত স্থির ও ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করা হয় বলে জানান প্রসিকিউটর। যাদের সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে : সুবেদার রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, নায়েব সুবেদার তোরাব হোসেন খান, নায়েব সুবেদার মনোরঞ্জন সরকার, নায়েব সুবেদার আবু সাঈদ মিয়া, নায়েক আসাদুজ্জামান, ল্যান্স নায়েক খন্দকার মিজানুর আলী, ল্যান্স নায়েক জিডি সৈয়দ এনামুল কবির, সিপাহী রাশেদুল ইসলাম, সিপাহী জিডি জয়নুল আবেদীন, হাবিলদার আবুল বাসার, নায়েক মোক্তার হোসেন, নায়েক অগ্নিশ্বর দাস, সিপাহী সামসুল হক, সিপাহী জিডি মোসলেহ উদ্দিন, সিপাহী লেলিন চাকমা, আলমগীর কবির, জিয়াউদ্দিন বাবলু, শফিকুল ইসলাম, মোতাহার হোসেন, রাজিব মিয়া, রেজাউল ইসলাম, থৈ অং মারমা, সোহেল রানা, রিপন হোসেন, শাহাদাত হোসাইন, শাহজালাল সিকদার, রবিউল আলম, নায়েক সিরাজুল ইসলাম, নায়েক আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার হুমায়ুন কবির, হাবিলদার রফিক মিয়া, নায়েক মতিউর রহমান খান, মোঃ মাসুদ ও সিপাহী নিশান মোল¬া। Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।