আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রামীনফোনের সেকাল একাল!

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! আমি চাকিরর কথা কখনো ভাবিনি। পূর্বপুরুষেরা সবাই ব্যাবসা করতেন সেই সুত্রে ব্যাবসায়িক পরিবেশে বেড়ে ওঠার দরুন-ছোট থেকেই মগজের ভিতরে গেথে গেছে ব্যাবসা ভিন্ন বেচে থাকা অসম্ভব। বিগত বছরগুলোতে কত উত্থান,পতন অর্থাভাব গিয়েছে এমনকি এখনো যাচ্ছে তবুও চাকরির করার কথা ভাবিনি। মাথার ভিতর সবসময় গিজগিজ করে শত শত ব্যাবসার প্লান! এই ব্যাবসায়িক সুত্র ধরেই গ্রামীন ফোনের সাথে আমার সম্পর্কের সুত্রপাত। বলছি সেই গ্রামীন ফোনের শৈশবের কথা; এভাবে কর্পোরেট কালচর আমাদের দেশে শুরু হয়নি তখনো।

গ্রামীনে সাকুল্যে তখন দুই আড়াইশ কর্মচারী। মহাখালী ব্রাক ভবনের একটা ফ্লোরে সারি সারি চেয়ার টেবিলে বসে উদয় অস্ত কাজ করত সেইসব উদ্যমী তরুনেরা। গ্রামীনের চাকরি তখন মোটেই লোভনীয় ছিল না কারো কাছে। এক দশক পরের মোবাইল কমিউনিকেশনের সেই রমরমা বানিজ্যের কথা কল্পনাতেই আসেনি কারো- এমনকি গ্রামীনের সর্ব্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিরাও ভাবেননি। এমন দূরদর্শী হলে কি মাত্র আট ডিজিটের নম্বর দিয়ে শুরু করত? ভাবতে পারেন গ্রামীন ফোনের সেই সব বিদেশী ডিরেক্টরদের নিজস্ব ব্যাবহারের জন্য একটা গাড়ি পর্যন্ত ছিলনা? বড় ভাইয়ের গাড়ি ব্যাবসার সুবাদে যখন তখন যেকোন ব্রান্ডের একটা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তে পারতাম যেখানে সেখানে।

গ্রামীনে সদ্য চাকরি পাওয়া আমার এক বন্ধুর অনুরোধে তার দুই তরুণী কলিগ আর এক নরওয়েজিয়ান ডাইরেক্টরকে আমার গাড়িতে করে ঘুরতে বেড়িয়েছিলাম আশুলিয়া দিয়ে জাহাঙ্গীর নগর হয়ে সাভার। বিকল্প এই রাস্তাটা তখনো গাড়ি চলাচলের জন্য উপযোগী ছিলনা তেমন। মনে হচ্ছিল যেন কোন গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার উপরে গরু ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। একটা গরুকে ইঙ্গিত করে সেই নরওয়েজিন আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন,এই পশুটাকে তোমাদের ভাষায় কি বল? আমার বন্ধু বলল, গরু।

‘দ্যাট মিনস্, ‘বস?’ আমার সেই বন্ধু হো হো করে হেসে বলল, নো বস, বস অর্থ গুরু আর এটা হচ্ছে গরু। সেই নরোয়েজিয়ানও হেসে বললেন, একই ব্যাপার গরু আর গুরুর মধ্যে খুব বেশী পার্থক্য নেই। নিরহংকার সদালাপী সেই মানুষটাকে আমার সেদিন দারুন ভাল লেগেছিল। কিন্তু এরাতো বেনিয়াদের গজদন্ত- শুধু দেখানোর জন্য খাবার জন্য নয়। গ্রামীনের দ্রুত উত্থানের সাথে সাথে এদেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল অল্প সময় বাদেই।

ব্রাকের সেই অফিসটা ছিল যেন একটা পিকনিক স্পট! প্রান প্রাচূর্য ভরপুর টগবগে সেইসব দরুন তরুনীদের সেকি উচ্ছলতা! কাজ করছে তারা মহা উৎসাহে জান প্রান ঢেলে। করবেই বা না কেন? বিগ বস থেকে শুরু করে জুনিয়র অফিসাররা সবাই কাজ করছে কাধে কাধ মিলিয়ে- কোন সিনিয়র জুনিয়র নেই। আদাব-সালামের লেশ নেই। সবাই মিলে যেন একটা টিম। বড় কোন খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তখন বুঝিনি এখন বুঝি ‘ইট ওয়াজ এ গ্রেট গেম প্লান’!সেলস এন্ড মার্কেটিং,পারচেজ( তখনো সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট নামে বদল হয়নি)প্রকিউরমেন্ট সহ সবাই যেন একখানে তালগোল পাকিয়ে ছিল। কোন ডিপার্টমেন্ট আলাদা করে চেনার উপায় ছিলনা। একে ওকে জিজ্ঞেস করে ডিপার্টমেন্ট খুজে বের করতে হত। আমার সেই এক বন্ধুর সুত্র ধরে সপ্তাহ না ঘুরতেই কয়েক ডজন বন্ধু হয়ে গেল। পারচেজে তখন জনা দুয়েক লোক মাত্র- পঞ্চাশ হাজার টাকার জিনিস কিনতে দশবার ডিরেক্টরের রুমে দৌড়ায়।

কর্পোরেট দুনিয়া তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। ধীরে ধীরে আমিও আমার ব্যাবসার ধরন পাল্টে ফেললাম। একসময় ওরা শুধু ওদের নয় আমাদেরও গ্রাস করে ফেলল… আমার সেই বন্ধুরা এসে গল্প করত-দারুন মজার একেকটা রাতের গল্প। কখনো ডিরেক্টরদের বাসায় কখনো কোন রেস্ট হাউজে কখনো ঢাকার বাইরে। সবাই মিলে তারা হাড়ি হাড়ি মদ গিলেছে-বসও তাল মিলিয়েছে সমান তালে।

সারা রাত মদ জুয়া আর গল্প! যেন সপ্নকেও হার মানায়। সবার হাতে একেটা সেলুলার ফোন ইচ্ছে মত কথা বলার সুযোগ- বিল দেয়ার ঝক্কি নেই(আমরা টি এন্ড টি ফোনের মাসিক বিল দেখেই তখন ভিমড়ি খাই) সামনামাসনি না হলে কি-টেলিফোনে সেই সব গল্প শোনাত! কিন্তু ওরা তখন বোঝেনি। আজো বুদ্ধিদয় হয়েছে কিনা না আল্লা মালুম! ওদের ভিতরের সব নির্যাস বের করে যে ছিবড়া বানিয়ে দিচ্ছিল সেটা তারা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। পাবে ক্যামনে? এরকম চাকরি খোদ বাংলাদেশে বসে আর কজন বাঙ্গালী তরুন করেছে?যেখানকার স্কাই আনলিমিট তুমি ইচ্ছে মত উড়তে পার!বাহ্যিক উদারতা, বন্ধুত্বের টোপ, মদ আর জুয়ার আসর সহ সব কিছুর সার তত্ব হচ্ছে এর বিনিময়ে তুমি তোমার সব প্রতিভা সব সপ্ন সব কল্পনা আমাদেরকে দিয়ে দাও। দু’চার পেগ পেটে পড়লে মাতাল হবার প্রশ্নই আসেনা।

তারাতো বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত স্মার্ট তরুন-কর্পোরেট কলচারের সাথে এটা মোটেই যায় না। কিন্তু হাসতে হাসতে খেলার ফাকে সব বলে দেয়; বাঙ্গালীদের দুর্বলতা, আমাদের পারিবারিক সামাজিক বন্ধনের কথা, আমাদের রাজনৈতিক বৈরিতা,আমাদের আতিথিয়েতা, অযথা অপচয়ের সাংস্কৃতি, আমাদের আবেগ, মুল্যবোধ সবকিছু। আর বসেরা তাদের মাথায় রাখা কম্পিউটারে সব টুকে নেয়। এখন আমরা অনেক ঠগে- খাবার প্যাকেটের মেয়াদ উত্তৃর্নের তারিখ দেখে কিনি( তাও শতকরা ১০ ভাগের বেশী নয়)। তবে আমরা কখনোই কোন কোম্পানীর সেবা নিতে গিয়ে ‘টার্মস এন্ড কন্ডিশন’(শর্তাবলী) পড়িনা।

আর ওদের খেলার এইটেই হল মুল অস্ত্র! শুরু হল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম আজগুবি কিছু নতুন প্যাকেজ। কোনটায় টি এন্ড টির ফোন কল আসে কিন্তু যায়না, কোনটা আসেও না যায়ও না-শুধু মোবাইল টু মোবাইল,কোনটা দেশ কল করা যাবে কিন্তু বিদেশে হবেনা সেই সাথে আরো কত 'নতুন বোতলে পুরনো মদের' প্যাকেজ। সিটিসেলের তখন একচেটিয়া অধিকার খর্ব হয়েছে-বাজারে তারা কোনঠাসা। সেই সুযোগে গ্রামীন জুড়ে দিল ল্যান্ড ফোন থেকে কল আসলে টাকা কাটা হবে( সেই ফাকে ফোন ফ্যাক্সের দোকানদাররা দেদারসে গলা কাটা শুরু করল),আবার মিসকলেও টাকা কাটার পায়তারা চলছিল। আর না বুঝে শুনে কালকে রোজ কেয়ামত কনফার্ম তাই আজকেই শেষবার মোবাইলে কথা বলে নেই, এই ভেবে আবেগী বাঙ্গালী হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাদের সেলস সেন্টারগুলোতে।

এই সুযোগে প্রতিদিন তারা নতুন নতুন বিক্রির রেকর্ড গড়েছে। গোথিয়া কাপ, ডানা কাপ জয় নিয়ে আমাদের যেমন ছিল বাধ ভাঙ্গা উচ্ছাস। একসময় বিটিভিতে প্রচারিত হুমায়ুন আহমেদের নাটক নিয়ে অতি আমাদের নাটুকেপনা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকেট কেনা নিয়ে অসম্ভব পাগলামীর মত গ্রামীনের সিম কেনা নিয়েও বহুত খেল দেখিয়েছে বাঙ্গালী(বাংলাদেশীরা)। একটা সিম কার্ড সত্তুর হাজার টাকাও বিক্রি হয়েছে এই আজব দেশে!!!তবে সেই তাদেরকে ওঁনারা বাঁশ দেবেনা দেবেনকি চৈনিকদের? ...আরো আছে- শেষ হয় নাই... (ব্লগারদের ভাল লাগলে বাকি অংশটুকু পোস্টাইব, নাইলে আজাইরা আমার ব্যাবসার লালবাত্তি জ্বালায় লাভ কি? ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ২৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.