আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প- সমাপ্তি

কাদের বলেছে, আজ নাকি সে আমাদের একটা সারপ্রাইজ দিবে। বারবার করে বলে রেখেছে, “দুপুর একটার মধ্যে, অষ্ট্যব্যঞ্জনে তোদের ১০০% উপস্থিতি চাই”। অন্য কোন জায়গা হলে তার এই উপস্থিতির আদেশটুকু আমরা কেউই হয়তো বিশেষ আমলে নিতামনা। কিন্তু অষ্ট্যব্যঞ্জন না হোক, অন্তত দু-তিনখানা ব্যঞ্জন পেটে চালান দেওয়ার আশায় আমি ঠিক ঠিক ১টা বাজার ৫ মিনিট আগে উপস্থিত হয়ে উপস্থিতির হার ১০০% করলাম। মতিন, কালাম, জামি, শুভ সবগুলো আমার আগে এসে হা হা, হো হো, হে হে করে যাচ্ছে।

একজন নারী থাকলে হয়তো হাসির শব্দগুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে হি হি ও শোনা যেত। তবে কিছুক্ষণ পরেই শোনা যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, যদিনা শুভর দেওয়া তথ্য ভুল না হয়। কাদের যদিও বলেছে সারপ্রাইজ, কিন্তু বেচারা মনে হয় জানেনা তার হাঁড়ির খবর শুভ ইতিমধ্যেই আমাদের ফাঁস করে দিয়েছে। একেই বলে, বেস্ট ফ্রেন্ডের বিশ্বাসঘাতকতা। সে যাই হোক, শুভর কাছে জানা গেল, কাদের সম্প্রতি প্রেমে পড়েছে এবং তার উপরেও প্রেম পড়েছে।

যদিও তার ইদানীংকালের ফেসবুকীয় আতেল মার্কা স্ট্যাটাস দেখে আমরা এমনই সন্দেহ করেছিলাম। কাদেরের প্রেয়সীটি নাকি দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী। তাকে দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্যই আমাদের এই পেটপূজার ব্যবস্থা। কিন্তু ১ টা ১৫ হতে চললো, যাদের উদ্দেশ্য করে কতিপয় উদরের মহার্ঘ্যের ব্যবস্থা সেই দেবা আর দেবীর দেখা নেই। কে জানে, দেবী হয়তো দেবাকে রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে প্রসাধনী মাখতে একটু বেশী সময় নিয়ে ফেলেছে।

যা হোক, ১ টা ২০ এ অষ্টব্যঞ্জনে দু’জনেরই দেখা মিললো। মেয়েটি সত্যিকারেই অপরূপা। কাদের তার এই বোকা বোকা চেহাড়া দিয়ে এমন রূপসী কিভাবে হস্তগত করলো, এই ভেবে মনে মনে একটা হাল্কা বেদনা অনুভব করলাম। তবে কে জানে, হয়তো মেয়েরা কাদেরকে দেখে বলে, “হি ইজ সো কিউট”। এইযে আমার মাচো ম্যান মার্কা চেহাড়া দিয়েতো মনের মতো একজনকেও ভালোবাসার জালে জড়াতে পারলামনা।

বিরিয়ানীর সাথে সাথে ভাবনাগুলি মাথায় খিচুরি বানিয়ে যাচ্ছিল, আর আমার দুঃখী দুঃখী চোখ বারবার মেয়েটির রূপের ছটায় ঝলসে যাচ্ছিল যেন। মনে মনে একটা কথা- “ইস্ যদি আমারো এমন...”। কাদের সুযোগ পেলেই রশ্মির কথা বলতো। শুনে শুনে সবার কানে পোকা ধরে গেলেও, আমার কেন জানি খুব ভালো লাগতো শুনে। একমাত্র আমারই রশ্মির গল্পে অকৃত্রিম হাস্যমুখ, বাকি সবারই কৃত্রিম।

এই জন্যই হয়তো কাদেরের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আগের চাইতে বেড়ে গেলো। মাঝে মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে রশ্মির সাথে ঘোরা-ঘুরি, একটু ঠাট্টা-তামাশা, কয়েকবার দৃষ্টি বিনিময়, ফোন নাম্বার আদান-প্রদান। কিন্তু তার বা আমার কারোরই ফোনে ইনকামিং কিংবা মিসড কল হিসেবে আমার বা তার নাম্বারের আগমন হয়নি। আমারটা যায়নি সাহসের অভাব, তারটা অপ্রয়োজনীয়তায়। কাদেরকে আমরা তার ভালোবাসার পরিধির কথা জিজ্ঞেস করলেই, কাদের তার বোকা বোকা চেহাড়ায় একটা মায়াবী হাসি ফুটিয়ে বলতো, “কি জানি!!”।

দায়সাড়া এই শব্দ দু’টো আমার বুকে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি করতো। দুটো শব্দের মধ্যে যেন মহাসমুদ্রের গভীরতা। সেই গভীরতায় আমিও কি কাদেরের মতো একই ঢেঊয়ের কলকল ধ্বনি শুনতে পেতাম? ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার পি,এল চলছিল। রাত ১ টা। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে আমার সবচাইতে অপ্রিয় সাবজেক্টের গুষ্টি উদ্ধার করছিলাম।

হঠাৎ আমাকে কাঁপিয়ে দিয়ে ফোনটা ভ্রু ভ্রু করে কেঁপে উঠলো। ডিসপ্লেতে আগমনী ডাক হিসেবে এই নামটা এই প্রথম। রশ্মি। আমি যেন ফোনের ভাইভ্রেশনের চাইতে অনেক গুণ বেশি ভাইভ্রেট করছিলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা যখন ধরলাম, গলার স্বর কন্ঠনালী অতিক্রম করতেই চায়না।

কিন্তু ওইপাশে কেন এতো শ্মশাণ নীরবতা? আমার কন্ঠনালী শেষ পর্যন্ত আমার স্বরকে মুক্তি দিলো বেশ দুর্বল করে দিয়ে-“হ্যা...লো”। ওই পাশ থেকে একটা হালকা ফোঁপানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। এরপর বেশ জোড়েই। ২ ৩ মিনিট পর একটু স্বাভাবিক হয়ে রশ্মি বললো, “দ্বীপ ভাই, প্লিজ আমার একটা উপকার করে দেন। ফোনটা একটু কাদেরের কাছে দিয়ে আসতে পারবেন? ওদের রুমে কেউই ফোন ধরছেনা”।

মহসীন হলের আমার পাশের রুমেই কাদের থাকে। কাদেরের কাছে ফোনটা দিলাম, ১০ কি ১৫ সেকেণ্ড চাপা গলায় কি যেন বললো। এরপর থমথমে মুখ নিয়ে ফোনটা ফিরিয়ে দিল। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলামনা। এইযে, কিছুক্ষণ আগে রশ্মির ফোন পেয়ে আমি কত কল্পনাই না করে ফেলেছিলাম।

কিন্তু একটাতেও কাদেরের কোন অস্তিত্ব ছিলনা, ছিল শুধু আমি আর রশ্মি। কল্পনা এখন বাস্তবতায় আছাড় খেয়ে আমার বুকে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হলো। পরদিন দুপুরে ডাইনিং এ খেতে এসে কাদেরকে ধরলাম, ঘটনার কিছুটা আঁচ করার জন্য। কাদের বেশি কিছু বললনা। শুধু বললো, “সম্পর্কটা মনে হয়ে আর টিকলোনা”।

আমার খুব প্রিয় এক রবীন্দ্রসঙ্গীত আছে- “তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা”। গানটার লাইনে তোমার আমার শব্দ দু’টোয় অদল-বদল হওয়া কি অসম্ভব একটা ব্যাপার? ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে বাকি আর দু’টা পরীক্ষা। সামনের পরীক্ষাটা আমার সেই অপ্রিয় সাবজেক্ট। কাদেরে রুমে গেলাম কিছু না বুঝা জিনিস বুঝে নিতে। কাদের দেখি সটাং হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।

চোখ-মুখ লাল। ঘটনা জিজ্ঞেস করতেই হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললো। বললো, “রশ্মির সামনের মাসে বিয়ে”। এই নিয়েই নাকি এতোদিন ঝামেলা হচ্ছিল ওদের মধ্যে। কাদেরের দুঃখ আমায় কি স্পর্শ করলো? আমার ভিতরে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

ওকে স্বান্তনাটুকুও দিলামনা। চলে এলাম নিজের রুমে। বাইরে তখন বিদ্যুৎ ঝড়। ভিতরেও কি নয়? কাদের রশ্মি। ‘র’ কাদেরের শেষ, রশ্মির শুরু।

কাদেরের ভালোবাসার সমাপ্তি দিয়েই রশ্মির নতুন জীবনের শুরু। রশ্মি এই সমাপ্তির কথা নিয়ে হয়তো মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাবে। কিন্তু অন্য এক সমাপ্তির কথা সে জানতেও পারবেনা কোনদিন, জানবেনা কেউই... ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.