আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কান্তজিউ মন্দির-দিনাজপুরঃ স্থাপত্য শৈলী ও পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ পৌরানিক কাহিনী (পর্ব-০৪)

মন্দির নির্মাণ-শৈলী : পরিপ্রেক্ষিত বাংলা হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট মন্দির হল ঈশ্বরের ঘর। এটিই ছিল বাংলার প্রাথমিক ধর্মীয় উপসনালয়। স্থাপত্যিক রীতি ও থিমের দিক থেকে বাংলার মন্দিরগুলো উত্তর ভারতীয় মন্দির নির্মাণ রীতি দ্বারা প্রভাবিত। উত্তর ভারতের মন্দিরগুলো নগর রীতিতে নির্মিত। যেগুলিকে গর্ভগৃহ (Sanctim), মণ্ডপ (assembly hall) এবং অর্ধমণ্ডপ (Purch) বলা হয়ে থাকে।

গর্ভগৃহের চূড়াকে (tower) কে বলা হয় রেখা বা শিখর। পুরো কাঠামোকে বলা হয় রেখা বা দেউল। মণ্ডপের কাঠামোকে পিডা দেউল নামে অভিহিত করা হয়। বাংলার অধিকাংশ মন্দির ইটের তৈরি। এখানকার কাদা-মাটি ইট তৈরীর জন্য যুৎসই ও উৎকৃষ্ট।

প্রাচীনকালে কিছু কিছু মন্দির পাথর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। সাধারণত গর্ভগৃহ মন্দিরে পাথরের ব্যবহার চোখে পড়ে। বাংলার মন্দিরের ভিত্তিভূমির নকশাঁ হলো সাধারণভাবে ত্রি বা পঞ্চরথ আকৃতির। গবেষক Datta ও Saraswati বাংলার মন্দিরগুলো ৪ ভাগে ভাগ করেছেন। ক) রেখা দেউল বা শিখর খ) পিডা দেউল বা ভদ্র গ) স্তূপ শীর্ষ ভদ্র ঘ) এবং শিখর শীর্ষ ভদ্র।

বাংলাদেশের প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য পশ্চিম বাংলার সাথে অল্প পরিমাণে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। প্রাচীন কিছু কিছু মন্দির যেমন দিনাজপুরের বৈগ্রামে আবি®কৃত শিবনন্দী মন্দির, বগুড়া জেলার মহাস্থানের গোকুল মেধ, রংপুরের বৈরাত মন্দির, বগুড়ার বৈরাগীর ভিটা, কুমিল্লা জেলার গোবিন্দ ভিটা ও চারপত্র মোড়া প্রভৃতি বিভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি করা হয় বলে গবেষকরা মনে করেন। দিনাজপুরের বৈগ্রামের শিবনন্দী মন্দির ছিল ৪র্থ-৫ম শতকের প্রাথমিক কালের মন্দির। এ মন্দিরের গঠন শৈলী গুপ্ত দুগর মন্দিরটি গোবিন্দ স্বামী বা বিষ্ণুর নামে উৎসর্গকৃত করা হয়। বৈগ্রাম মন্দির ছাড়া অন্যান্য মন্দিরগুলি ৭ম থেকে ১০ম শতকের মধ্যে নির্মিত মন্দির।

চারপত্র মোড়ার একটি তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, এটা ছিল বিষ্ণু মন্দির। প্রাচীন বাংলার অধিকাংশ মন্দির গর্ভগৃহ রীতিতে নির্মিত হয়। কিছু মন্দির মণ্ডপ যুক্ত গর্ভগৃহ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয। এ কথা সত্য যে, মন্দিরের স্পষ্ট নকশা না পাওয়ায় এসব মন্দিরগুলিকে রেখা দেউল, পিডা দেউল, স্তূপশীর্ষভদ্র ও শিখর শীর্ষ ভদ্র এ শ্রেণীগুলিতে বিভক্ত করা বেশ দূরুহ ব্যাপারে। তবে বিভিন্ন এপিগ্রাফিক প্রমাণ, সাহিত্য, ভাস্কর্য, পেইন্টিং এবং স্মৃতিস্তম্ভ থেকে জানা যায় যে, গুপ্ত যুগ থেকেই বাংলায় মন্দির নির্মাণে শাসকবৃন্দ পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

গুপ্তরা ছিল বৈষ্ণব আদর্শে (Vaishnavism) বিশ্বাসী । এ যুগের অসংখ্য বিষ্ণু মূর্তি, লক্ষ্মী মূতি, রাধা মূর্তি ও কৃষ্ণ মূর্তি আবি®কৃত হয়েছে। বাংলায় প্রথম দিকে শিব ও শক্তির পূজা ছড়িয়ে পড়ে। পাল শাসকরা ছিল বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী তথাপি ভাগলপুর তাম্রলিপি, খালিমপুর ও মুঙ্গের তাম্রশাসন থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, পাল শাসকেরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এ সময়কালে রাধাকৃষ্ণ কাহিনী বেশ জনপ্রিয় ছিল।

গবেষক Dutta বলেছেন যে, মুসলিম অভিযানের পূর্বে বর্মণ ও সেন রাজাদের তত্ত্বাবধানে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য মতবাদ অব্যাহত ছিল। ১৬ ১৩ শতক থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত সময়কালে মুসলিম অভিযান ও অনুপ্রবেশের ফলে বাংলার জনসাধারণের সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনের স্বাভাবিক গতিধারা বিঘিœত হয়। ইসলাম বাংলার ব্রাহ্মণ্যধর্ম, হিন্দু জমিদারদের দ্বারা রাধা-কৃষ্ণ সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটে, যার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন হিন্দু শিল্প ও স্থাপত্য থেকে। এই সময়ে রাধা কৃষ্ণ কাহিনী কেন্দ্রিক অসংখ্য মন্দির নির্মিত হয়। এ সমস্ত মন্দিরগুলোতে টেরাকোটার মাধ্যমে অলংকরণ করা হয়।

যেখানে বৈষ্ণব মতাদর্শের নানা দিক ও বিষয় প্রতিফলিত হয়। এগুলির রয়েছে স্বতন্ত্র নির্মাণ রীতি ও ভিন্ন স্টাইল। David Mc Cutchion (১৯৭২) মধ্যযুগের শেষ দিকের মন্দিরগুলোকে সেগুলোর আকার ও স্টাইলের ভিত্তিতে কতগুলো ভাগে বিভক্ত করেছেন। ১৯৭৬ সালে গবেষক Saraswati মন্দিরগুলোর স্থাপত্যিক যে শ্রেণী বিভাগ করেন, তা থেকে David এর শ্রেণী বিভাজন ছিল একটু ভিন্নধর্মী এবং সংশোধিত বলা চলে। এভাগগুলি হলো- ক) সনাতন রীতি (Traditional Style) খ) হাট রীতি (Hut Style) গ) ইন্দো-ইসলামীয় রীতি (Indo-Islamic Style) ঘ) এবং ইউরোপীয় প্রভাবিত রীতি (European-influenced Style) ক) সনাতন রীতি রেখা ও পিডা দেউল এ দু’ প্রকারে বিভক্ত।

রেখা দেউল আবার দু’ভাগে বিভক্ত: (ক) হালকা বক্ররেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত যেমন: উড়িষ্যার মন্দির এবং (খ) বারান্দা ব্যতীত বক্ররেখার মন্দির, যাকে বীরভূম প্রকৃতির মন্দির বলা চলে। এই রীতিতে কেল্লার শিখর বা দেয়ালের মধ্যে তেমন কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। রেখা দেউল পদ্ধতিতে মন্দির অলংকৃত করা হয় আনুভূমিকভাবে। বীরভূমে এ ধরনের মন্দির দেখা যায় বলে একে “Bribhum Variant” বলে। বক্ররেখার মন্দির দেখা যায় বদায়ূন ও বীরভূম জেলায়।

এর শিখরের চূড়াগুলি উপরে উঠতে উঠতে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যায়। তাছাড়া পিরামিড রেখা দেউলের মন্দির ও খুব কম পরিমাণে চোখে পড়ে। অন্যদিকে পিডা দেউল হচ্ছে মূলত উপরের দিকে টাওয়ার সমৃদ্ধ মন্দির গঠন রীতি। যা উত্তর ভারতীয় জগমোহন রীতি নামে পরিচিত। এই ধরনের মন্দির শুধুমাত্র পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় দেখা যায়।

তিনটি বা চারটি আনুভূমিক ক্রমহ্রাসমান বিভাগ এ মন্দিরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। (খ) হাট স্টাইলে অতি সাধারণ গঠনের রীতি অনুসরণ করা হয়, যা বাংলাদেশের নিম্নজীবী মানুষের আবাসস্থল হিসেবে গ্রামীণ পর্যায়ে এর উপস্থিতি ল্যণীয়। কুঁড়েঘর পদ্ধতিতে ঘর নির্মাণে সাধারণত বাঁশ, পাট, কাদামাটি, শন প্রভৃতি উপকরণ হিসেবে কাজে লাগানো হয়। হাট রীতি দু ভাগে বিভক্ত, যথাঃ বাংলা ও চালা। বাংলা আকৃতির মন্দিরের আবার তিনটি রূপ আছে, যথাঃ ১. এক বাংলা বা দো-চালা, ২. জোড় বাংলা বা চারচালা/আটচালা/নবরতœ শিখর এবং ৩. দুটি চার চালার মধ্যে এক বাংলা রীতি।

চালা পদ্ধতির মন্দির নির্মাণ পদ্ধতিতে ৪টি ভাগ পরিলতি হয়, যথা: চার-চালা, আট-চালা, বারো চালা এবং বহু চালাযুক্ত মন্দির। ১৭ গ) ইন্দো-ইসলামীয় রীতির মন্দিরে, হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে, যা মধ্য যুগের শেষ দিকে ল্য করা যায়। স্থাপত্য কাঠামোর এ রীতিকে দু ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন: ১. রত্ন বা শিখর আকৃতি এবং ২. গম্বুজাকৃতি। রত্ন বা শিখর রীতিতে শিখর বা চূড়াগুলি হয় অনেকটা সুঁচালো আকৃতির। অন্যদিকে গম্বুজের ভেতরের অংশ থাকে ফাঁপা এবং মোটামুটি গোলাকৃতির।

তবে উভয়ের শীর্ষে দণ্ডের চিহ্ন থাকে। মনে করা হয় যে, মুঘল স্থাপত্যের প্রভাবে বাংলার ম্িনদরে শিখর বা রতœ বা গম্বুজের ব্যবহার করা হয়। ১৮ ঘ) ইউরোপীয় প্রভাবিত রীতির প্রয়োগ দেখা যায় ১৯ শতকে। বিশেষ করে ইউরোপীয়রা এদেশে চার্চ নির্মাণ শুরু করলে তার পর থেকেই কোন কোন মন্দিরে, এ রীতির প্রয়োগ করা হয়। এই মন্দির হয় বর্গাকৃতির বা অষ্টভূজাকৃতির ছোট মন্দির এবং এর বার্নিশ থাকে বাঁকা।

তাছাড়া ভারতীয় বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যকার মন্দির নির্মাণ রীতির প্রয়োগ বাংলার কিছু কিছু মন্দিরের েেত্র দেখা যায়। যেমন: কান্তজিউ মন্দিরের পোর্ট গুলোর েেত্র ভবিষ্যত মন্দিরের স্থাপত্যিক রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। ১৯ তথ্য নির্দেশিকা: ১৬.Datta, B. K. "Bengal Temples", New Delhi, 1975, Munshilal Monoharlal publishers prt. Lt. pp-4-9.উদ্ধৃত Hoque, M. M. et.al. “Kantajee Temple An Outstanding Monument of Late Madieval Bengal”, publication Dept. of Drik, Dkaha, 2005, P. 38. ১৭.Hoque, M.M et al, "Kantajee Temple An Outstanding Monument of Late Madieval Bengal", publication Dept. of Drik, Dkaha, 2005, pp- 41-43. ১৮.Ibid, pp-43-44 ১৯.Ibid, PP. 44-46. ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.