আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে মাদ্রাসা নির্মাণ: জমি দখল ও ক্ষমতা চর্চার সাম্প্রদায়িক ব্যাকরণ

munirshamim@gmail.com
বাংলাদেশের যে কয়টি স্থাপনা তার নির্মাণ শৈলীর গুনে আমাকে খুউব কাছে টানে, বিমোহিত করে, দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির তার মধ্যে অন্যতম। ফলে আমি যখনই দিনাজপুরে গিয়েছি, সুযোগ পেয়েছি তখন সে সুযোগের শতভাগ ব্যবহার করে সামান্য সময়ের জন্যও হলেও কান্তজিউ মন্দির গিয়েছি। এইতো কিছু দিন আগেও গিয়েছিলাম। যথারীতি অনেকগুলো ছবি তুলেছি। ফিরে এসে একটি পোস্টও দিয়েছিলাম... দিনাজপুর থেকে আমার ফিরে আসার মাস না যেতেই সে প্রিয় মন্দিরকে ঘিরে একটি দু:সংবাদ পড়তে হলো।

বাংলাদেশের প্রত্ত্বতাত্ত্বিক স্থাপনার অনন্য নিদর্শন দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরের জমিতে হঠাৎ করে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি মাদ্রাসা। এ ভয়াবহ সা¤প্রদায়িক ঘটনার দু:সংবাদটি ছেপেছে গত শুক্রবারের দৈনিক প্রথমআলো। পত্রিকাটি তার প্রতিবেদনে মাদ্রাসা নির্মাণের বর্ণানায় 'হঠাৎ' শব্দটির সংযোজনে বিশেষায়িত করলেও আমার কাছে মনে হয় না ঘটনাটি হঠাৎ করে ঘটেছে। বরং ঘটনাটিকে একটি সা¤প্রদায়িক শক্তির, যারা হয়তো স্থানীয়ভাবে প্রবল রাজনৈতিক ক্ষমতারও মালিক, দীর্ঘ পরিকল্পনার বহি:প্রকাশ বলেই মনে হয়। যারা মন্দিরের জায়গা দখল করেছে তাদের দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় কী তা স্পস্ট নয়, অন্তত পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে।

তবে এটি স্পস্ট যে, তারা ক্ষমতাবান। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এক বা একাধিক শক্তির সাথে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে একটি ঐতিহাসিক প্রত্ত্বতাত্ত্বিক নিদর্শনের জায়গায় মাদ্রাসা নির্মাণের সাহস ও ক্ষমতা প্রদর্শন সম্ভব হতো না। তাছাড়া মন্দিরের জমিতে মাদ্রাসা নির্মাণের অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে আ'লীগ, বিএনপি সহ কোন রাজনৈতিক দল এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে বলে জানা যায়নি। স্থানীয় পর্যায়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এ দায়িত্বহীন মৌনতাও শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসা নির্মাণকারীদের সা¤প্রদায়িক তৎপরতার পক্ষেই যাচ্ছে। আর এ রকম নিশ্চিত ক্ষমতা বলেই হয়তো মাদ্রাসা নির্মাণকারীদের একজন কোন ভাবেই মাদ্রাসা সরিয়ে ফেলা হবে না বলে দম্ভোক্তি করতে পারছেন।

উচ্ছেদ ও দখলের রাজনীতিতে ধর্ম ও সা¤প্রদায়িকতার কূৎসিত উদাহরণ নতুন নয়, বরং আগের বেশ কিছু ঘটনা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়, অন্তত রাজনৈতিক উপেক্ষায়, সফল হয়েছে বলে একই ব্যকারণের পুনপৌনিক প্রয়োগ করার ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের সাহস পেয়েছে এ সা¤প্রদায়িক শক্তি। মন্দিরের জায়গায় মাদ্রাসা নির্মাণের অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত যদি সফল হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সা¤প্রদায়িক শক্তি তাদের 'জিহাদী জজবার' সফলতা হিসেবে সাধারণ মুসলিমদের কাছে পরিবেশ করতে পারবে। মাদ্রাসা-মসজিদ আল্লাহর ঘর, একবার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে সরাবার রেওয়াজ নেই, তার জন্য দেবতার ঘরকেও যদি ধংশ করে দিতে হয় তাতে আপত্তি নেই-আমাদের সা¤প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণের মনে এ বিশ্বাসটি গভীরভাবে বপন করে দেয়া হয়েছে। আর এ বিষবৃক্ষকে অবলম্বন করেই নির্মাণ করা হয়েছে মাদ্রাসাটি। যাতে সাধারণ এর কাছে বলা যেতে পারে, এখানে মাদ্রসাটি চালু হয়েছে, আল্লাহর বানী একবার উচ্চারণরিত হয়েছে।

সুতরাং এটি আর বন্ধ করা যাবে না। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের কথাগুলো সত্যি হোক, মন্দিরের জায়গায় মাদ্রসাটি টিকে যাক, এটি কোনভাবেই শুভ চাওয়া হতে পারে না। বরং আমরা এখানে কেবল মন্দিরই চাই। তবু ওপরের আশংকটিই যদি সত্যি হয়, যদি সরকার ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে শেষ পর্যন্ত মাদ্রাসাটি টিকে যায়, তবে তার সাথে আরও একটি আশংকা যুক্ত করতে হয়। আর সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ থেকে একটি নয়নাভিরাম স্থাপত্য শৈলীর বিয়োজন।

কারণ কথিত মাদ্রসায় যখন কোমলমতি শিশু-কিশোররা পড়তে শুরু করবে, আস্তে আস্তে এর শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে, তখন এর সা¤প্রদায়িক উদ্যোক্তরা প্রতিদিন এ সব শিশুদের মনে সা¤প্রদায়িকাতার বিষ ছড়িয়ে দিবে। এক সময় মন্দিরের ঘন্টা ধবনির অনুরণণ তাদের কাছে তাদের কাছে কেবলই বেশরীয়তী কাজ হিসেবে অসহনীয় হয়ে পড়বে। পূজারীদের পূজা বন্ধ করে দেয়াটা তাদের ঈমানী দায়িত্বের অংশ মনে করবে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এ সম্ভাবনাগুলো উড়িয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা মনে করি দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দির রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক এবং নৈতিক দায়িত্ব।

কোন আইনী মারপ্যাঁচ এর কথা বলে নয়, বরং সে সাংবিধানিক এবং নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সরকার ও প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত। এ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দাবিদার হিসেবে আ'লীগের দায়িত্বটা মাত্রাগত দিক থেকে অনেক বেশি। আমরা সে বেশির প্রতিফলন দেখতে চাই। মন্দিরের জায়গায় মাদ্রাসা নির্মাণের মতো সা¤প্রদায়িক শক্তির অপতৎপরতা এখনই নিষিদ্ধ করা হোক। যে স্থাপনাটি ইতোমধ্যে স্থাপিত হয়েছে তা উচ্ছেদ করা হোক।

ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি রক্ষার্থে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকার রক্ষায় অপরাপর নাগরিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক শক্তিরও এগিয়ে আসা উচিত। কারণ কান্তজিউ মন্দির শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নয়, বাংলাদেশ তথা বিশ্বের জন্যও একটি ঐতিহাসিক প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি আমাদের সকলের সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় আসুন জনমত গড়ে তুলি..
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.