আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বন্ধবর কামাল লোহানীর জন্মদিনের দর্শনঃ সরদার ফজলুল করিম

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত। বন্ধবর কামাল লোহানীর জন্মদিনের দর্শনঃ সরদার ফজলুল করিম * চিন্তার লিষ্টি করছি। কী কী করতে হবে। * টিকাটুলি, মেয়েদের ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। * সকালে বন্যা এইমাত্র ফোন করেছিল, তার বাবা, মানে কামাল লোহানীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটি লেখা দিতে হবে।

দীপ্তি লোহানী; কামাল লোহানী; তাদের কন্যা বন্যা। আরও ছেলেমেয়ে আছে শুনি কিন্তু আমি নাম মনে রাখতে পারি না। আমি এবং আমার স্ত্রী কলি (সুলতানা রাজিয়া); আমার দুজনেই কামাল লোহানী আর দীপ্তির প্রায় পারিবারিক সদস্য। অথচ কামাল লোহানী সম্পর্কে আমি কী লিখবো? ভাবতে গেলে এই এক সমস্যা। একেবারে কাছের মানুষ, কাছের মানুষ সম্পর্কে না পারি কিছু বলতে, না পারি কিছু লিখতে।

তাই তাঁদের জীবিত অবস্থায়ও আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মদিন পালন করতে গেলে কাছের মানুষদের তো যেতে হয় দূরের মানুষের কাছে। গিয়ে বলতে; আপনি, আপনার আমার বাবা-মা সম্পর্কে কিছু বলুন। কিছু লিখে দিন। আগামী ২৬ জুন আমার তাঁর ৭৯তম জন্মবার্ষিকী পালন করব। এ এক মজার ব্যাপার।

আমরা আমাদের আত্মার আত্মীয়দের সম্পর্কেই কিছু জানিনে। এমনকি তাঁদের জন্মতারিখও নয়। তাঁরাই আমাদের জন্মদাতা। তাঁরাই আমাদের জন্মতারিখ জানেন। তাঁরা আমাদের স্কুলে, কলেজে ভর্তি করান।

আমরা তাঁদের ভর্তি করাইনে। এ সবই ঘটনা। এগুলিই লেখার ব্যাপার। তার মানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে যাঁরা আমাদের বড় করে তোলেন, আমরাই তাঁদের সম্পর্কে কিছু জানি না। কিছু স্মরণ রাখি না।

এমনকি আমাদের জন্মদিন তাঁরা মুখস্থ রাখেন। আমাদের জন্মদিন তাঁরা পালন করেন। সেই তাঁদের জন্মদিন পালন করার ইচ্ছা হলে আমাদের ছুটতে হয় অপরের কাছে আর জিজ্ঞেস করতে হয় আপনারা তাঁর সম্পর্কে কি জানেন? আরে! এত মজার ব্যাপার। কেবল বন্যা আর সাগরের ব্যাপারে না। এ আমার ব্যাপারেও ঘটে।

আমি যে একটু লেখালেখি না করি, তা নয়। একটি জীবনীগ্রন্থকে আমি খুব ভালবাসি। এই যেমন আমাদের শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। বাসন্তী গুহঠাকুরতার কাছে আমি অপরিসীম ঋণে ঋণী। তাঁর একটি গ্রন্থের নামঃ একাত্তরের স্মৃতি।

তার মধ্যে তিনি যে একাত্তরের কতশত ঘটনাকে ধরে রেখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। তাই বলা চলে বাসন্তীকে তাঁর জীবনকাহিনী রক্ষা করে, জীবনকাহিনী রচনা করে আমাদের নিজেদের দায় থেকে রক্ষা করে গেছেন। এই হচ্ছে ইতিহাস সচেতন পিতা-মাতা। তাদের সন্তান তথা তাদের উত্তর-প্রজন্মের জন্য স্মরণীয় করে যাবার দৃষ্টান্ত। এ সবকিছুই সবার জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।

বন্যার জন্য সাগরের জন্য। আসলে এখানেই এক সমস্যা। হাতের আঙ্গুলটাকেও একেবারে নাকের কাছে এনে দেখা যায় না। তাকে দেখতে হলে, তার কোন্টি সোজা, কোন্টি বাঁকা, তা দেখতে হলে একটু দূর থেকে দেখতে হয়। এই কথা সন্তানের কাছে তার পিতা-মাতা সম্পর্কেও সত্য।

পিতা-মাতা আসলে তাদের সন্তানদের একেবারে কাছ থেকে দেখেন না। দেখেন একটু দূর থেকে। তাই বন্যার তারিখটা কবে তা ভুলে যাবেন, এই আশঙ্কায় বন্যার জীবন তারিখ লিখে রাখেন কামাল লোহানী আর দীপ্তি লোহানী। তাই তাঁরা সহজেই তাদের যে কোনো সন্তানদের জন্মদিন পালন করতে পারেন। পারেন না কেবল তাদের নিজেদের জনক-জননীর।

আমার এ কথাটি বন্যার আর সাগরের কাছে; তাদের মা-বাবা জন্মদিন পালনের ক্ষেত্রে যা একটু ঘটনার অভাব ঘটে, সেটি যেন না ঘটে, তার জন্য। এজন্য করণীয় হচ্ছে সময়মত, তোমাদের যা করণীয় তা করা। নিজের মা-বাবাকে একটু দূর থেকে দেখো। খাতা কলম নিয়ে খাতায় লেখো। ক্যাসেট আছে, তোমাদের ইচ্ছামত তাঁদের প্রশ্ন করো।

তাঁদের জবাব ক্যাসেট বন্ধ করো। তাদের বলো তোমাদের আমরা মরতে দেবো না। আমাদের জন্মদাত করে যে ‘পাপ’ তোমরা এই দুর্ভাগা দেশে করছে, আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থেকে তোমাদের সেই ‘পাপ’ ক্ষালন করতে হবে। আরে! এই বোধ যদি আমাদের থাকত, আমাদের সবার থাকত তবেই আমরা বুঝতাম, আমাদের মা-বাবা মরতে পারে না। তার মরে যেহেতু আমরা তাদের দেখি না, চিনি না এবং জানতে চাই না।

আর আমাদের মা-বাবা এতই ভালো মানুষ যে আমাদের এই অক্ষমতা এবং অপরাধের জন্য তারা কেউ বকেনও না। অপরাধী করেন না। যাওয়ার সময়েও বলে যান; তোরা ভাল থাকিস। বন্যা বলেছে আব্বা সম্পর্কে একটু লিখে দিন। বন্যাকে তারিখ দিয়েছি।

এলে সব কথা বলব। বলব এই নাও তোমাদের অপরাধের খতিয়ান। তোমাদের মা-বাবা সম্পর্কে আমরা বাইরের লোক কেমন করে বলব? তোমার বাবা আমার গলায় প্রীতি আর শ্রদ্ধার মালা পরিয়ে দিয়েছেন্ তার সন তারিখন ভুলে গিয়েছি। কিন্তু সে ঘটনা কি ভুলতে পারি? জীবনের ইতিহাসে যখন যা করণীয় তখন তাঁরা তা পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, আমার প্রতিষ্ঠিত সেই প্রতিষ্ঠান থেকে শক্তিমানের দ্বারা বঞ্চিত হয়েছেন।

তোমাদের বাবার মুখ তাতে ম্লান হয়নি। বলেছেন, তাতে কি? আমি আর একটি প্রতিষ্ঠান গড়ব। গড়াই আমার কাছ ভাঙা তো নয়। এটাকেই বলে জীবনদর্শন। মহৎ জীবনদর্শন।

এমন মহৎ দর্শন দিয়ে তৈরি হয় জাতীয় মহৎদর্পণ। সেই দর্পণের শক্তিতে তার উত্তর প্রজন্ম জীবনের শক্তি পায়। জীবনে বাঁচার শক্তি। কিন্তু তোমরা যারা এমন জীবনদর্শনকে ভালবাস, তোমরা যারা এমন জীবনদর্শন তৈরি করতে চাও, তোমাদের সতর্ক থাকতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে।

বাবা যদি এবং যেদিন তোমাদের মঙ্গলের জন্য রাগ করেছেন বা গায়ে হাত দিয়েছেন, তাকে ভাগ্য বলে গ্রহণ করতে হবে। দিনে বিস্মুত হও তো রাতের গভীরে উঠে তোমাদের জীবনের পাতায় স্মৃতির খাতায় তাকে রক্ষা করতে হবে। দেখবে বাবা-মার পরিচয় জানার জন্য অপরজনের কাছে যেতে হবে না। কামাল লোহানী, তোমাদের বাবা আমার অবশ্যই স্নেহভাজন ভাই। কিন্তু আমার দুঃখ, আমরা তো অহোরাত্রি অভিন্ন জীবনযাপন করতে পারিনি।

এমন কি আমাদের বন্দিদশায় প্রকট বন্দিশালায় আবদ্ধ থাকিনি। তবু তিনি আমার এবং আমাদের অতুলণীয় কামাল লোহানী। তাঁর জন্মদিন পালনকে আমি একটি উত্তম করণীয় বলে গণ করি এবং তোমাদের মহৎ এমন উদ্যোগের কৃতিকে আদ্যপান্ত তোমাদের মনের স্মৃতিতে এবং স্মরণের পাতায় মহৎ ভবিষ্যতের জন্য উত্তমরূপে রক্ষা করতে বলি। প্রিয় বর কামাল লোহানী দীর্ঘজীবি হউন এবং এমনি করে তাঁর করণীয় দায়িত্বকে তিনি পালন করতে চলুন এটিই আমার কামনা। সংগ্রহ : শেখ রফিক সম্পাদক: বিপ্লবীদের কথা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।